জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর: লাখ লাখ অভিযোগ দেখভালে রয়েছেন মাত্র ৯০ কর্মকর্তা

মোহাম্মদ নুরুদ্দিন একটি নামকরা কোম্পানি থেকে দুই দরজার নতুন রেফ্রিজারেটর কিনে খুব আনন্দিত ছিলেন। কিন্তু খুব শিগগিরই তার আনন্দ হতাশায় বদলে যায়। কারণ কেনার মাত্র কয়েকদিন পরেই তিনি লক্ষ্য করেন, রেফ্রিজারেটরের বাম দিকের দরজার হাতলের চারপাশে পানির বাষ্প জমে থাকছে।
তিনি যে প্রতিষ্ঠানের থেকে রেফ্রিজারেটরটি কিনেছিলেন সমস্যাটি তাদের জানান। এরপর প্রতিষ্ঠানটিও এ সমস্যা সমাধানে একাধিকবার টেকনিশিয়ান পাঠিয়েছিল। তারা বিভিন্নভাবে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু বাষ্প জমা থামছিল না। এক মাস পেরিয়ে গেলেও এই সমস্যার সমাধান হয়নি।
অধৈর্য হয়ে নুরুদ্দিন বিষয়টি ই-মেইলের মাধ্যমে কোম্পানির কাছে জানান। কিন্তু দুই মাস বারবার যোগাযোগের পরেও তিনি এই সমস্যার প্রতিকার পাননি। আর কোনো উপায় না থাকায় তিনি সাহায্যের জন্য জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের দ্বারস্থ হন।
নুরুদ্দিন বলেন, 'আমি অভিযোগ জমা দেওয়ার ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে তারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। কোম্পানির প্রতিনিধি নির্ধারিত প্রথম দিন আসেননি, তবে পরে তিনি আসেন এবং নির্ধারিত দিনে আসতে না পারায় ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তিনি আমাকে ১৫ দিনের মধ্যে আমার রেফ্রিজারেটর পরিবর্তন করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।'
কিন্তু ২০ দিন পেরিয়ে গেলেও প্রতিষ্ঠানটি ফ্রিজ বদলে দিতে ব্যর্থ হলে নুরুদ্দিন আবারও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
এবার ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা প্রতিষ্ঠানটিকে [রেফ্রিজারেটর বিক্রি করা কোম্পানি] সতর্ক করেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে তারা ব্যবস্থা নেন। কিছুদিন পর তারা নুরুদ্দিনকে তার রেফ্রিজারেটরের পরিবর্তে একটি নতুন রেফ্রিজারেটর দেয়।
নুরুদ্দিন বলেন, 'ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিপ্তরের সহযোগিতায় আমি সত্যিই খুশি।'
তিনি জানান, 'তবে সেখানকার [ভোক্তা অধিকার কমিশন] একজন কর্মকর্তা এক সময় তাকে বলেছিলেন যে তারা খুব কর্মী সংকটে আছেন। কারণ তারা প্রতিদিন শত শত মামলা পাচ্ছেন, তবে দক্ষতার সঙ্গে সেগুলো পরিচালনা করার মতো পর্যাপ্ত কর্মকর্তার অভাব রয়েছে।'
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড (টিবিএস) সম্প্রতি রমজান মাসের একদিন রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অফিস পরিদর্শন করে। সেসময় অফিসটি একেবারে সুনসান ছিল, কারণ বেশিরভাগ অফিসার মাঠে ছিলেন। রমজান মাসে বাংলাদেশে ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত মুনাফার জন্য পণ্যের দাম বাড়ায়, যার ফলে ভোক্তারা অধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়। ফলে মাঠ পরিদর্শনে দীর্ঘ সময় ব্যয় করেন কর্মকর্তারা।
তবে শুনানির জন্য বাইরে কয়েকজন মানুষ অপেক্ষা করছিলেন।
কিন্তু মাত্র দুই জন অফিসার অফিসে ছিলেন, তাদের মধ্যে একজন অভিযোগ নিচ্ছিলেন এবং অন্যজন সেগুলো যাচাই-বাছাই করছিলেন।
তাদের কাজের চাপ এবং মামলা পরিচালনার জন্য তাদের পর্যাপ্ত জনবল আছে কি-না জানতে চাইলে দুজনই নিজেদের উদ্বেগের কথা জানান।
অভিযোগ শাখার উপ-পরিচালক মাসুম আরেফিন বলেন, 'অবশ্যই আমাদের কর্মীর অভাব রয়েছে। ঢাকায় মহাপরিচালক ছাড়া কর্মকর্তা রয়েছেন মাত্র ১৯ জন। আজ তাদের মধ্যে ১৩ জন মাঠে রয়েছেন এবং আমি এখানে একাই শুনানি পরিচালনা করছি, কারণ অভিযোগ আসতেই থাকে। এখানে গুরুতর কর্মী সংকট রয়েছে।'
তিনি বলেন, 'এসব মামলা পরিচালনা করা কঠিন।'
তিনি আরও বলেন, 'শুধু তাই না, পেঁয়াজ ও নিত্যপণ্যের দাম তদারকি, নোটিশ জারি করা এবং অন্যান্য কাজের দীর্ঘ তালিকা ইত্যাদি প্রতিনিয়ত নানা চ্যালেঞ্জ থাকে।'
তিনি বলেন, '১৮ কোটি মানুষের দায়িত্বে রয়েছেন মাত্র ৯০ জন অফিসার।'
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ সংস্থাটি ভোক্তাদের মধ্যে সুপরিচিত এবং নিজেদের অধিকার রক্ষায় জনগণের মধ্যে ক্রমেই এটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
অফিসে লিফটের জন্য অপেক্ষা করার সময় আমরা দুজন ব্যক্তিকে লক্ষ্য করলাম-এদের একজন গ্রাহক, অন্যজন ব্যবসায়ী।
গ্রাহক সন্তুষ্ট মুখে ব্যবসায়ীকে বলছিলেন, 'দয়া করে আমার ওপর রাগ করবেন না। আপনারা আমার অধিকার লঙ্ঘন করেছেন এবং ভোক্তা অধিকার আপনাকে শাস্তি দিয়ে সমস্যার সমাধান করেছে।'
ব্যবসায়ীকে খুশি মনে না হলেও অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হলেন। অফিসে এ ধরনের ভোক্তাদের উপস্থিতি খুব সাধারণ দৃশ্য।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, 'কাজের চাপ অত্যধিক। ভোক্তা অধিকার ৩০০ কর্মকর্তার জন্য অনুরোধ করলেও, দেওয়া হয়েছে মাত্র ১২ জনকে।'
অন্যদিকে মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান ব্যাখ্যা করে বলেন, 'কিছু কর্মী অন্যত্র চলে যাওয়ায় কর্মকর্তার ঘাটতি দেখা দিয়েছে।'
এ ব্যাপারে সরকারকে অবহিত করেছি বলেও জানান তিনি।
তবে তিনি বলেন, 'আমরা আমাদের নিয়মিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছি এবং আমি বিশ্বাস করি আমাদের যে জনবল আছে তা যথেষ্ট।'
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ সংস্থার তদন্ত বিভাগের উপ-পরিচালক শাহনাজ সুলতানা নিজ উদ্যোগে বিষয়টি দেখভাল করছেন।
তিনি বলেন, 'অবশ্যই আমাদের জনবলের ঘাটতি রয়েছে- এটা স্পষ্ট। যদি ৫০০টি অভিযোগ আসে, তবে আমাকে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৩০০টি মামলা সামলাতে হয় এবং গড়ে আমি ১৫০টি মামলা সামলাচ্ছি।'
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বলেন, 'আমার ডিপার্টমেন্টে আর কেউ নেই। আমি একা কাজ করছি এবং অন্যান্য বিভাগের সহায়তার ওপর নির্ভর করছি। কিন্তু একজন ডেপুটি ডিরেক্টরের তো সাপোর্ট দরকার, তাই না? এখানকার আরও অনেকের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা।'
শাহনাজ বলেন, 'চিঠি, ইমেল এবং অন্যান্য মাধ্যমে অভিযোগগুলো আসে। কিছু অভিযোগ অসম্পূর্ণ থাকে—ঠিকানা বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থাকে না। তাই প্রথমে এগুলো বাছাই করতে হয়। এরপর আসে জরিমানা আরোপের প্রক্রিয়া, তা ব্যাংকে জমা দেওয়া, রেকর্ড রাখা, চিঠি পাঠানো এবং নোটিশ জারি করার কাজ।'
তিনি আরও বলেন, 'একটি অভিযোগ সমাধান করা এক দিনের কাজ নয়। জটিল মামলাগুলোর ক্ষেত্রে তিন দিন পর্যন্ত শুনানি হতে পারে, তারপরে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়।'
তিনি বলেন, 'ধরা যাক, আমি আজ একটি অভিযোগ পেলাম। আমাকে প্রথমে একটি চিঠি পোস্ট করতে হবে এবং প্রতিক্রিয়া পাওয়ার জন্য অন্তত এক সপ্তাহ সময় দিতে হবে। এরপর উভয় পক্ষ আমাদের কাছে আসে, যদি তারা শর্তগুলো মেনে নেয় এবং একপক্ষ জরিমানা পরিশোধ করতে রাজি হয়, তবে মামলাটি এক দিনেই সমাধান হতে পারে। তবে কখনো কখনো তিনটি শুনানি পর্যন্ত সময় নিতে হয়, যার ফলে পুরো প্রক্রিয়াটি শেষ করতে ২০ দিন পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।'
তিনি আরও বলেন, 'প্রতিটি অভিযোগ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে অনেকগুলো কাজ করতে হয়।'
নুরুদ্দিন জানান, মানুষকে তিনি যখন তার পুরোনো রেফ্রিজেটরের বদলে নতুন রেফ্রিজেটির পাওয়ার কথা বলেন, সবাই খুব অবাক হয়।
তিনি বলেন, 'কোনো সমস্যা হলে, ভোক্তা অধিকার কমিশনে যান। তারা সহজেই সাড়া দেন এবং তারা মানুষকে সাহায্য করতে ইচ্ছুক।'
তিনি আরও বলেন, 'আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, যদি আপনি তাদের কাছে পৌঁছাতে পারেন, তাহলে অবশ্যই তাদের কাছে আপনার প্রয়োজনীয় সাহায্য পাবেন।'