গোপনে বৈশ্বিক সম্পত্তির সাম্রাজ্য গড়ে তোলা বাংলাদেশি রাজনীতিক

অরল্যান্ডো থেকে উত্তরে সড়কপথে এক ঘণ্টার দূরত্বে ফ্লোরিডার অকালা ন্যাশনাল ফরেস্টের পশ্চিম সীমান্তে এমন একটি জায়গা রয়েছে, যা নিয়ে খুব শিগগিরই আন্তর্জাতিক মামলা শুরু হতে পারে। জায়গাটির পরিমাণ অর্ধ একর।
ম্যারিয়ন কাউন্টির সম্পত্তি মূল্যায়নকারীর রেকর্ডে দেখা যায়, ২০ বছর আগে বাংলাদেশের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জমিটি কিনেছিলেন। সম্পত্তিটির মূল্য ৪৮ হাজার ডলার। ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের এমপি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে সাইফুজ্জামানের গড়ে তোলা অবিশ্বাস্য রিয়েল এস্টেট সাম্রাজ্যের প্রথম দিকের সম্পদের একটি এই জমি।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমস (এফটি) ১৯৯২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে কমপক্ষে ২৯৫ মিলিয়ন ডলারে সাইফুজ্জামান বা তার পরিবারের সদস্যদের কেনা ৪৮২টি সম্পত্তি চিহ্নিত করেছে।
শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে যারা দেশ থেকে শত শত কোটি টাকা পাচার করেছেন, সেসব অর্থ দেশে ফেরাতে চায় বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার। এজন্য সরকারের কাছে এসব ব্যক্তির তালিকায় শীর্ষে রয়েছেন সাইফুজ্জামান।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, দুবাই ও যুক্তরাজ্যের একাধিক শহরে সাইফুজ্জামানের সম্পত্তি রয়েছে।পতিত শেখ হাসিনা সরকারের ভূমিমন্ত্রী হওয়ার আগে তিনি পাঁচ বছরেরও বেশি সময় সংসদ সদস্য ছিলেন। ২০২৩ সালে তিনি সংসদে জানিয়েছিলেন, তার যে সম্পদ রয়েছে, তার মূল্য ২.৩ মিলিয়ন ডলার।
২০১৭ সালে তার সর্বশেষ ঘোষিত আয়কর রিটার্নে বলা হয়, তার কোনো বিদেশি আয় নেই।
শেখ হাসিনার শাসনামলে দেশের অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের মতো সাইফুজ্জামান এবং তার কয়েকজন আত্মীয় বাংলাদেশের একটি ব্যাংক থেকে টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের দেওয়া তথ্যমতে, শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে অন্তত ১৬ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছেন।
তিনি আরও বলেন, 'তিনি (সাইফুজ্জামান) ভূমিমন্ত্রী ছিলেন, মনে হয় তিনি ভূমি ভালবাসেন।'
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এফটিকে বলেছেন, 'এগুলো জনগণের অর্থ। তারা প্রকাশ্য দিবালোকেই এগুলো নিয়ে গেছেন। কারণ, তাদের হাতে রাষ্ট্রযন্ত্র ছিল।'

ফাঁস হওয়া এবং সরকারি সূত্র অনুযায়ী এফটি'র এক বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়, সাইফুজ্জামান এবং তার পরিবারের মালিকানাধীন সম্পদের পরিমাণ আগে প্রকাশিত সম্পদের তুলনায় অনেক বেশি। তাদের নামে যুক্তরাজ্যে ৩১৫টি ; দুবাইয়ে ১৪২টি; নিউ ইয়র্কে ১৬টি; ফ্লোরিডায় ৬টি এবং নিউ জার্সিতে ৩টি সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে।
এফটির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার সাইফুজ্জামানের মতো আরও যাদের চিহ্নিত করেছে, তাদের সবার মিলিয়ে সিঙ্গাপুর ও কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে ৫৭৮ মিলিয়ন ডলার মূল্যের সম্পদ রয়েছে।
ড. ইউনুস এসব ব্যক্তির ব্যাংক লুটপাটের ঘটনাকে 'ডাকাতি' হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, এই অর্থ 'ফেরত আনতে হবে'।
বর্তমান সরকার এখন বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের পুনর্গঠন শুরু করছে। এ কারণে সরকার বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার চেষ্টা করছে। সরকারের দাবি, দেশের অর্থনীতি পুনর্গঠনের জন্য এই অর্থ প্রয়োজন।
এই প্রচেষ্টা হবে দেশের বিচার ব্যবস্থা এবং প্রশাসনের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। কারণ এখনও এসব জায়গায় শেখ হাসিনার অনুগত লোকেরা রয়েছেন। এমনকি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারাও স্বীকার করেছেন যে এসব ব্যক্তি তাদের এই প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
মার্কোস-পরবর্তী ফিলিপাইন থেকে শুরু করে ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ পরবর্তী ইউক্রেন পর্যন্ত যেসব সরকার কথিত ক্লেপটোক্রেটিক শাসনের পর ক্ষমতা দখল করেছে, তারা অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করেছে। কিন্তু সেই প্রচেষ্টাগুলো আইনি বা অন্যান্য কারণে ব্যর্থ হয়েছে। তারা খুব কমই সফল হয়েছেন।
বাংলাদেশ এই প্রচেষ্টা শুরু করার পর পরই মার্কিন ট্রেজারি প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে আসছে। এর প্রথম পদক্ষেপ হবে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দেশীয় আইনি মামলা করা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য দেশের কাছে আনুষ্ঠানিক আন্তর্জাতিক আইনি সহায়তা চাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া; যা ভবিষ্যতে সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক মামলাগুলোর পথ সুগম করবে।
ড. ইউনূস বলেন, যদি আমার দেশের চুরি হওয়া অর্থ আপনার দেশে জমা থাকে, আমি মনে করি এগুলো ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করা সেসব দেশেরও দায়িত্ব।
যুক্তরাজ্যে সাইফুজ্জামানের সম্পত্তি সাম্রাজ্যের ব্যাপকতা এবং সাবেক মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিককে তার খালা শেখ হাসিনার মিত্রদের লন্ডনে একটি ফ্ল্যাট দেওয়ার বিষয়টিও অর্থনৈতিক অপরাধ ও অবৈধ অর্থায়ন রোধে ব্রিটিশ সরকারের দক্ষতার বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি আয়োজিত যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী সমন্বয় কেন্দ্র বলেছে, তারা সাবেক সরকারের দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ও এর আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে সহায়তা করার সুযোগগুলো খতিয়ে দেখছে।
এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য একাধিকবার অনুরোধ করা হলেও সাইফুজ্জামান সাড়া দেননি।
তার ভাই আনিসুজ্জামান চৌধুরী এক ই-মেইলে বলেছেন, তার নিজের আলাদা ব্যবসা আছে। তিনি 'যথাযথ উপায়ে' সম্পদ কিনেছেন এবং তাদের বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, 'আগের সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার' কারণে তাদের পরিবারের দিকে আঙুল তোলা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক বনে যাওয়া পরিবারগুলোর মতোই সাইফুজ্জামানের পরিবার।
অন্তর্বর্তী সরকারের দাবি, ব্যবসায়ী পরিবারগুলোর সংঘবদ্ধ জোট আওয়ামী শাসনকে দৃঢ় করতে ১৫ বছর ধরে ক্রমবর্ধমানভাবে দমনমূলক নীতি টিকিয়ে রেখেছিল।
সাইফুজ্জামানের বাবা আখতারুজ্জামান চৌধুরী ছিলেন আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদ এবং শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সহযোগী। তিনি ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) প্রতিষ্ঠাতা পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ছিলেন। তিনি ইউসিবির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুটি সহিংস ঘটনার জেরে কুখ্যাত হয়ে ওঠেন।

প্রথমটি ১৯৯৩ সালের ৮ এপ্রিল ইউসিবির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুমায়ুন জহিরকে তার বাসার বাইরে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে আখতারুজ্জামান গ্রেপ্তার হলেও পরে জামিনে মুক্তি পেয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে এবং শেখ হাসিনা প্রথম প্রধানমন্ত্রী হলে আখতারুজ্জামান ঢাকায় ফিরে আসেন। তিনি জামিনে ছিলেন। তবে তার বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে থেমে যায়।
দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে ১৯৯৯ সালে, যখন আখতারুজ্জামান বন্দুকের মুখে ইউসিবি দখলের চেষ্টা করেন এবং বোর্ডকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন।
পরে আদালত বহিষ্কৃত চেয়ারম্যানকে পুনর্বহাল করেন এবং দুই বছর পর শেখ হাসিনা ক্ষমতা হারান।
তবে ২০০৯ সালে তিনি আবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফিরে আসার পর আখতারুজ্জামান আবারও ইউসিবির পরিচালনা পর্ষদে যোগ দেন।
২০১২ সালে তিনি মারা গেলেও সাইফুজ্জামানের নেতৃত্বে তার পরিবার ইউসিবির ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ আরও দৃঢ় করতে সক্ষম হয়।
গত বছর শেখ হাসিনার পতনের পরও কেন্দ্রীয় ব্যাংক এটি সংস্কার করার আগ পর্যন্ত এর পরিচালনা পর্ষদে সাইফুজ্জামানের আধিপত্য ছিল।
শেখ হাসিনার শাসনামলে ব্যবসায়ী এলিটরা আওয়ামী লীগে সম্পদের যোগান দিয়ে বিরোধীদের দমন করার সুযোগ দিয়েছিল এবং ক্ষমতা হারানোর আগে পর্যন্ত হাসিনাকে কার্যত সব ধরনের চ্যালেঞ্জ থেকে মুক্ত রেখেছিল।
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক মুশফিক মোবারক বলেন, 'রাজনৈতিক নেতারা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে তাদের সাঙ্গপাঙ্গদের বড় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ওপর দখলদারিত্ব বজায় রাখতে সহায়তা করেছিল; যারা তাদের মালিকানার অংশীদারিত্ব ব্যবহার করে 'ঋণ'এর মাধ্যমে কোটি কোটি ডলার পাচার করেছিল এবং পরে ক্ষতিপূরণ হিসেবে সেইসব রাজনীতিবিদদের বিদেশে রিয়েল এস্টেট উপহার দিয়েছিল।
আগস্টে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার পুলিশ ও বিচার বিভাগসহ আওয়ামী লীগের হাতে দখল হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার কাজ শুরু করেছে।
গত ডিসেম্বরে ড. ইউনূসের অনুমোদিত বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা নিয়ে এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনার শাসনামলে অর্থ পাচারের কারণে বছরে ১৬ বিলিয়ন ডলার হারিয়েছে বাংলাদেশ।
প্রতিবেদনে বড় বড় সরকারি প্রকল্পে ব্যয়, কর অব্যাহতি এবং ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
ইউসিবিতে বরাবরই তার পরিবারের সংখ্যাগরিষ্ঠ শেয়ার ছিল উল্লেখ করে আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, 'আমরা ব্যাংকের বোর্ডে থাকা অবস্থায় কোনো ব্যক্তিগত লাভ গ্রহণের কোনো প্রমাণ নেই। সব ঋণ দেশের আইন এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী অনুমোদিত হয়েছিল।'
যারা পাচার হওয়া অর্থের কিছু পরিমাণ হলেও ফেরানোর চেষ্টা করছেন, তাদের এই সম্পত্তি সাম্রাজ্যের পরিসর, তাদের ভৌগলিক জটিলতা এবং অভিযুক্তদের কেনা সম্পত্তি লুকানোর প্রচেষ্টা প্রভৃতির বিরুদ্ধে লড়তে হবে।
সাইফুজ্জামানের ক্ষেত্রে এফটি যেসব সম্পত্তি চিহ্নিত করেছে, সেগুলোর সঙ্গে তার নাম সরাসরি জড়িত। তবে, এছাড়াও অনেক সম্পদ এজেন্টের মাধ্যমে কেনা হয়েছে।
গত বছর আল-জাজিরার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে সাইফুজ্জামানের এস্টেট এজেন্ট রিপন মাহমুদের বক্তব্য রেকর্ড করা হয়।
সে সময় রিপন বলেছিলেন, তার ক্লায়েন্ট সরাসরি নগদ সম্পত্তি কেনার বিষয়টি এড়িয়ে চলেন। কারণ 'বড় অর্থ, বড় সংখ্যা সবাইকে সতর্ক করে তোলে'।
তিনি আরও বলেন, 'তার ক্লায়েন্ট মর্টগেজ ব্যবহার করেন যাতে পরে তিনি বলতে পারেন: 'আমি নগদে এসব সম্পত্তি কিনিনি। আমি ব্যাংক ঋণ নিয়েছি।'
২০১৯ সালে ভূমিমন্ত্রী হওয়ার পর সাইফুজ্জামানের হঠাৎ করে বাড়ি কেনার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে একটি ঋণ সংস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কোম্পানি হাউসের রেকর্ড অনুসারে, ব্রিটিশ ব্যবসায়ী পরেশ রাজার মালিকানাধীন মার্কেট ফিনান্সিয়াল সলিউশন নামে একটি ঋণদাতার সঙ্গে যুক্ত সংস্থাগুলোর মাধ্যমে ব্রিটিশ সম্পত্তির বেশিরভাগ কেনা হয়েছে।
এই সংস্থাগুলো প্রথম ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে সাইফুজ্জামান-সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে ঋণ দেওয়া শুরু করে এবং সংস্থাগুলোর নিবন্ধিত ৪৯৫টি সম্পত্তির মধ্যে ২৯১টিতে তাদের নাম জড়িত।
শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর অনেক ঋণ পরিশোধ করা হয়। ২০২৪ সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে সাইফুজ্জামান ও তার পরিবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো হঠাৎ করেই তাদের ৩৫২টি মর্টগেজের মধ্যে ২৫৯টি পরিশোধ করেছে। সম্ভবত কিছু সম্পত্তি হস্তান্তরও করা হয়েছে।
এফটি'র দেখা রেকর্ডগুলো ইঙ্গিত দেয় যে দুবাইয়ের কিছু সম্পত্তি তখন বিক্রি করা হয়েছে।
আর গত জানুয়ারিতে সাইফুজ্জামানের যুক্তরাজ্যের ব্যবসায়গুলোর বৃহত্তম ঋণদাতা সিঙ্গাপুরের ডিবিএস ব্যাংক তার ১২টি সম্পত্তি ফিরে পাওয়ার জন্য কাগজপত্র জমা দেয়।

ডিবিএসের এক মুখপাত্র বলেছেন: '২০২৪ সালের শুরুর দিকে, ডিবিএস কিছু সমস্যা শনাক্ত করেছিল। পরে এগুলোর যথাযথ পর্যালোচনা শুরু ও শেষ হয়েছে।'
সাইফুজ্জামান কীভাবে যুক্তরাজ্যে অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং চেক পাস করেছেন সে সম্পর্কে রাজা এবং ডিবিএসকে জিজ্ঞাসা করেছিল এফটি। এ সম্পর্কে ডিবিএস 'কোনো নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্ট বা ব্যক্তির বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি'।
রাজার আইনজীবীরা বলছেন, মার্কেট ফিনান্সিয়াল সলিউশনের একটি বড় আন্ডাররাইটিং টিম রয়েছে, যারা প্রতিটি ঋণ যাচাই-বাছাই করে বিস্তারিত ও পুঙ্খানুপুঙ্খ এএমএল ও অন্যান্য চেক করে।
তারা বলেন, রাজার 'বাংলাদেশ বা হাসিনা সরকারের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই'।
তারা আরও বলেন, সম্পত্তি এজেন্ট মাহমুদ 'গোপন ক্যামেরায় তাদের সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দেওয়ায় তাদের ক্লায়েন্টের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন এবং সেই দাবিগুলো প্রত্যাহার করেছেন'।
মাহমুদের আইনজীবীরা দাবি করেছেন, তার (মাহমুদ) মাতৃভাষা ইংরেজি না। এর মানে 'মাহমুদ যা বলেছেন তার ভুল ব্যাখ্যা এবং ভুল অর্থ তৈরির ঝুঁকি রয়েছে'।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বেন কাউডক—যিনি যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশি অভিজাতদের মালিকানাধীন সম্পত্তি তদন্ত করেছেন—বলেছেন, 'একজন সম্ভাব্য ক্লায়েন্টের ধনসম্পদের উৎস বোঝা প্রাইভেট সেক্টরের ভূমিকার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে প্রথম ধাপ হিসেবে কাজ করে।'
তিনি আরও বলেন, 'ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ক্লায়েন্টদের তথ্য পর্যাপ্ত যাচাই করতে বা কর্তৃপক্ষের কাছে সন্দেহজনক কার্যকলাপের প্রতিবেদন সরবরাহ করতে ব্যর্থ হচ্ছে।'
বাংলাদেশি ও বিদেশি কর্মকর্তারা বলছেন, সম্পদ পুনরুদ্ধারের জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে লুট হওয়া ব্যাংকগুলোর ফরেনসিক অডিট এবং জটিল লেনদেন ট্র্যাক করা প্রয়োজন হবে।
বাংলাদেশ থেকে বিদেশ যাওয়ার পথে চালকসহ একাধিক কর্মীর হাত বদল হয়ে অর্থ পাচার হতে পারে।
দেশের ব্যাংকগুলোর সম্পদ মান পর্যালোচনা এবং শেখ হাসিনাসহ দশটি নেতৃস্থানীয় পরিবারের সম্পদ সন্ধানে ১০টি যৌথ তদন্ত দল গঠন করতে ডেলয়েট, ইওয়াই এবং কেপিএমজির সঙ্গে চুক্তি করেছে ঢাকা।
বাংলাদেশের টাস্ক ফোর্সগুলো কোন কোন পরিবারকে টার্গেট করছে তা অন্তর্বর্তী সরকার জনসম্মূখে প্রকাশ না করলেও একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলছেন, তাদের মধ্যে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান এবং এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের পরিবার রয়েছে। দু'জনেরই বিরুদ্ধে সন্দেহজনক ব্যাংক ঋণ থেকে লাভবান হওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
কোম্পানির রেকর্ডে দেখা যায়, সাইফুল আলমের স্থায়ী বাসস্থান সিঙ্গাপুরে ২১.৯ মিলিয়ন ডলারের একটি ম্যানশন রয়েছে। দেশটিতে তিনি হোটেলসহ বাণিজ্যিক রিয়েল এস্টেট কিনেছেন, যার মূল্য আনুমানিক ৪৬৯ মিলিয়ন ডলার।
সাইফুল আলম এবং তার ঘনিষ্ট আত্মীয়দের আইনজীবীরা বলেছেন, এই অভিযোগগুলো তারা 'সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন'।
এছাড়াও তারা বলেছেন, এই ব্যবসায়ীর 'ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বহু বছর ধরে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ অডিট করেছে এবং কোনো অনিয়ম পাওয়া যায়নি'।
তারা আরও বলেছেন, তারা 'তাদের বিনিয়োগের সুরক্ষায় আন্তর্জাতিক আইনি পদক্ষেপ শুরু করতেও প্রস্তুত'।
আহমেদ আকবর সোবহান এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্যের অনুরোধের সাড়া দেননি।
এফটি'র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আহমেদ আকবর সোবহান এবং তার পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাজ্যে ২৬টি সম্পত্তি কিনেছেন, যার মোট মূল্য অন্তত ৬৫ মিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আহমেদ আকবর সোবহান এবং তার পরিবারের কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে বৈদেশিক সম্পদসহ সম্পত্তি লুকানোর অভিযোগ তদন্ত করছে।
বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের কাছে শুধু দেশের অভিজাত পরিবারগুলোর বিরুদ্ধেই এই ধরনের অভিযোগ নেই, বরং আওয়ামী লীগের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নেতা এবং দেশের শক্তিশালী গার্মেন্ট-রপ্তানি শিল্পের প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধেও বিদেশে সম্পত্তি অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ- টরন্টো ধনী বাংলাদেশিদের মধ্যে এত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে যে এটি 'বেগম পাড়া' শব্দের সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অন্টারিওর জমি রেজিস্ট্রি ফাইলিংয়ে এফটি'র করা অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাবেক আওয়ামী এমপির স্ত্রীর মালিকানাধীন ১৩ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ১২টি সম্পত্তি রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো এক মিলিয়ন ডলার মূল্যের একটি বাড়ি।
ড. ইউনূস এফটিকে বলেছেন, কানাডায় বাংলাদেশের পাচার হওয়া 'উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ' রয়েছে। এছাড়া তার প্রশাসন বিশ্বাস করে, বাংলাদেশি এলিটদের গচ্ছিত বিপুল সম্পত্তি দুবাইয়ে রয়েছে, সেখান থেকে এগুলো পুনরুদ্ধার করা সবচেয়ে কঠিন হতে পারে।
ওয়াশিংটনের থিংক-ট্যাংক সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজের (সিফোরএডিএস) সংগৃহীত সম্পত্তির মালিকানার রেকর্ডের একটি ডাটাবেস ব্যবহার করে এফটি তাদের বিশ্লেষণ করেছে।
এতে ২০২২ সালের ৯৮টি সম্পত্তির রেকর্ড দেখানো হয়েছে, যার আনুমানিক মূল্য ২৮ মিলিয়ন ডলার। তবে, আরও ৩৯টি ঠিকানা রয়েছে যার তথ্য অসম্পূর্ণ। সাইফুজ্জামানের ভাই আনিসুজ্জামান আরও পাঁচটি সম্পত্তির মালিক হিসেবে তালিকাভুক্ত রয়েছেন।
ডেটাবেসে দেখা গেছে, অ্যান্থনি জোসেফ আবু-জাউদ, একজন ব্রোকার; তিনি বেশ কয়েক বছর ধরে সাইফুজ্জামানের সম্পত্তি পোর্টফোলিওর একটি অংশ পরিচালনা করেছেন।
তিনি বলেন, 'সাইফুজ্জামান দুবাইতে নিজেকে ভূমিমন্ত্রী এবং ইউসিবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলেন। এবং সকল ডেভেলপাররা তাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন।'
তবে আবু-জাউদ জানান যে গত বছর সাইফুজ্জামানের সম্পত্তি নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর তার কোম্পানি তার সঙ্গে কাজ করা বন্ধ করে দেয়।
সাইফুজ্জামান তার ভাড়ার ব্যবসায় সম্ভবত ভালেই মুনাফা করেছে। কারণ বিশ্বব্যাপী মেট্রোপলিটন এলাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় ট্র্যাক করা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মার্সারের মতে, টানা দুই বছর ধরে দুবাইয়ে ভাড়ার হার ২০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে।
সাইফুজ্জামান দুবাইয়ের রেসট্র্যাকের কাছে একটি নির্জন এলাকায় পোলো রেসিডেন্সেস নামক একটি প্রজেক্টে প্রায় পুরো একটি ভবন কিনেছিলেন। এই প্রজেক্টে অনেক লো-রাইজ ইউনিট রয়েছে।
তিনি বাংলাদেশের এমপি থাকাকালীন পোলো রেসিডেন্স এ-২ নামের ওই ভবনের অ্যাপার্টমেন্টগুলো কিনেছিলেন। কিন্তু সাইফুজ্জামান এই অ্যাপার্টমেন্টগুলোর সম্পত্তি রেকর্ডে তার বসবাসের স্থান হিসেবে আমেরিকান সামোয়ার কথা উল্লেখ করেছিলেন।