চাঁটগাইয়া বিয়ে মানেই কি মহা ধুমধামে আয়োজন? না আর কিছু!

সামনে সোহানার (ছদ্মনাম) এচএসসি পরীক্ষা, কিন্তু এখন বিয়েতে কী করবে, কী পরবে, কোথায় সাজবে তাই নিয়েই সব চিন্তা। বংশের বড় মেয়ে, তাই নিজের ও পরিবারেরও অনেক শখ এ বিয়ে নিয়ে।
সোহানাদের এলাকায় সোহানার দাদা বেশ চেনাজানা ব্যক্তি ছিলেন। আর্থসামাজিক অবস্থানের দিক থেকেও তাদের মর্যাদা বেশ ভালো। চট্টগ্রাম শহরেই আছে তাদের পাঁচতলা একটি বাড়ি। যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠা সোহানার বাবা আর চাচা থাকেন বিদেশে।
বিয়ে উপলক্ষ্যে সোহানাদের পুরো গলিতে আলোকসজ্জা করা হয়েছে, যাতে এলাকার লোকজন জানে কোন বাসার কোন সাহেবের মেয়ের বিয়ে। এছাড়া, বাসার নিচে গ্যারেজে চলছে ফার্নিচার তৈরির কাজ—আলমারি, সোফাসেট, খাট, ড্রেসিং টেবিল ইত্যাদি রাখা। একটা গরু আর দুটো ছাগলও বাঁধা আছে গেটের সামনে।
এলাকার লোকজন আসে আর আলোচনা করে যায় কত দিয়ে কেনা হলো সে গরু এবং কত কেজি মাংস হতে পারে তাতে। ছোটো বাচ্চাদের নাচগান, হৈহৈ-রইরই তো আছেই। সবমিলিয়ে জমজমাট আর আনন্দমুখর এক চিত্র রাহাত্তারপুলের তাজউদ্দীন শাহ মাজারের গলিতে।
সোহানার বাবা-চাচাও খুব খুশি। এলাকার মুরুব্বিরা এসে জানিয়ে যাচ্ছেন, আয়োজন আর প্রস্তুতি বেশ ভালো চলছে। এমন ধুমধাম বিয়ে না হলে কি আর চাঁটগাইয়া বিয়ে মানায়! মানায় না সত্যি।
যদি প্রশ্ন করা হয় বাংলাদেশের কোন অঞ্চলের বিয়েতে সবচেয়ে আনন্দ আয়োজন হয়, নিঃসন্দেহে নাম আসবে চট্টগ্রাম অঞ্চলের। চট্টগ্রামের বিয়ে মানেই এলাহি কান্ড। যেমন আয়োজন, তেমন খাওয়াদাওয়ার পর্ব, তেমনই লোকসমাগম। উৎসব আয়োজনের কোনো কমতি নেই বলেই হয়তো অন্য জেলার লোকজনের কাছে এ অঞ্চলের বিয়ে অনেক রঙ্গিন।
কিন্তু চাঁটগাইয়াবাসী জানেন, এ ধুমধাম আয়োজনের সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায় সারাজীবনের সঞ্চয়, বিক্রি করে দিতে হয় জমিজমা, ধার নিতে হয় অর্থকড়ি। যেমন এ সোহানার বাবাকেই ধার করতে হয়েছে পাঁচ লাখ টাকার ওপরে। খরচ হয়েছে ১৮-১৯ লাখের মতো। এ টাকা শোধ করার জন্য সামনের দুই বছরে ছুটিতে আর দেশে আসা হবেনা তাদের। টাকা শোধ হবার পর আবার ছুটি নিয়ে আসতে পারবেন।
কিন্তু এতে তেমন আক্ষেপ নেই তাদের। কেননা মেয়ের বিয়ে দিতে হলে টাকা এমন খরচ হবেই। ছেলেপক্ষের দাবিদাওয়া মেটাতে না পারলে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি নিয়ে কথা শুনতে হতো। তাই মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে দশ লাখ টাকা ধার নেওয়া এমনকিছু নয়।
তাছাড়া এলাকাবাসীর সামনেও মাথা উঁচু করার একটা ব্যাপার আছে! সবাই যেহেতু জানে তাদের বিদেশি পয়সা আছে, সুতরাং বিয়েটা তাক লাগানো হবে এ তো কাম্য।
মাহালত মুরুব্বি ও 'ফুলনিশান'
বিয়ের কথা পাকাপাকি করতে যেদিন বরপক্ষ এল সোহানাদের বাড়িতে, সেদিন পরিবারের বাইরেও সে সভায় উপস্থিত ছিলেন এলাকার জনা পাঁচেক মুরুব্বি। অপরদিকে বরপক্ষ থেকেও এসেছেন ছয়জন মুরুব্বি।
চট্টগ্রামের ভাষায় এ এলাকার মুরুব্বিদের বলা হয় মাহালত সর্দার। মাহাত বা মাহালত শব্দের অর্থ হচ্ছে মহল্লা। চট্টগ্রামের মানুষ জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে-শাদী, খানা-মেজবানীর মতো বিভিন্ন উৎসব বা আয়োজনে ও বিপদে আপদে এলাকার মুরুব্বিদের সঙ্গে আলোচনা করে থাকে। তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। আঞ্চলিক ভাষায় এটিকে মাহালত বলা হয়।
মাহালতের অধিবাসীগণকে মাহালত বা মাহালতী বলা হয় যার অর্থ হচ্ছে সমাজ সদস্য। বিয়ের কথা পাকাপাকি করতে বরপক্ষ যেদিন আবার আসে মেয়ের বাড়িতে, সেদিন এ মাহালত অধিবাসীগণকে উপস্থিত থাকতে হয়।

এ দিন ছেলের পরিবার মেয়েকে সোনার অলংকার দিয়ে নিশান রেখে যান, যেন আর কোনো পাত্রের কাছে তাদের হবু বউকে দেখানো না হয়। চট্টগ্রামের ভাষায় এদিনটিকে বলা হয় বউজোড়া বা ফুলনিশান।
বিয়ে ঠিক হলো, তাই মেয়েকে সোনার অলংকার দিয়ে নিশান রেখে যাওয়া হলো। তবে এ নিশান দেওয়া হয় একদম শেষ পর্যায়ে। যখন বিয়ের তারিখ, কাবিনের হিসেব, সোনার হিসেব, বর-বউ সাজানি খরচ, কী পরিমাণ খরচ হবে তা বলে দেওয়া হয়।
এছাড়া বিয়েতে কতজনকে খাওয়ানো হবে, কী কী পদ রাখতে হবে, কী কী দিতে হবে মেয়ের সঙ্গে, ছেলেপক্ষের কয়জনকে কী কী দিতে হবে—এ সবধরনের ফর্দ নিয়ে আলোচনা করে একমত হওয়া যায় তখনই।
তবে, ফুলনিশান বা বউজোড়া নাম দুটি যতটা সুন্দর, বর-কনের জন্য দিনটি যে ততটাই সুন্দর হবে তা নয়! এ ব্যাপারে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর ওমেন-এর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ছাত্রী বলেন, 'প্রতিটা বিয়েতে এ নিশানের দিন একটা বিশ্রী পর্যায়ের ঝগড়া হয়। কারণ বরপক্ষ যতটা পারে চাপিয়ে দিতে থাকে। তাদের শখ ইচ্ছে পূরণ করা ছাড়া উপায় থাকেনা শেষমেশ।'
সোহানার মা-চাচির সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সোহানার বিয়েতেও এমন ফর্দ ছিল। যেমন ছেলে, ছেলের ভাইকে এবং বড় বোনের জামাইকে সোনার আংটি দিতে হবে। কয়েক পদের আসবাবপত্র দিতে হবে, বিয়েতে ৫০০ জন খাওয়াতে হবে।
এছাড়া কী কী খাবারের পদ থাকতে হবে, মাছের কয়টি রান্না, মাংসের ধরন কয়টি—এমনকি সোহানার বিয়ে যে কমিউনিটি সেন্টারে হয়েছে, সেটিও বরপক্ষেরই ঠিক করে দেওয়া। তবে এ নিয়ে কোনো কথা কাটাকাটি বা ঝামেলা হয়নি। কারণ মেয়েপক্ষ হলে ছেলেদের চাহিদাগুলো মেনে নিতে হয়—এটাই স্বাভাবিক।
আগের দিনে এ ফর্দগুলো লিখে নিয়ে আসা হতো তালিকা করে। কিন্তু এখন মুখে মুখেই বলে দেওয়া হয়। অনেকে আবার মুখে কিছু না চাইলেও পরে কথা শোনায়। সোহানার চাচিকেও কথা শুনতে হয়েছিল বিয়ে হয়ে আসার পর। তাই মেয়ে যেন সুখে থাকে—সে কথা ভেবে বাবা-মায়েরাই ফর্দ না থাকলেও উপহার হিসেবে পাঠিয়ে দেন।
তবে এসব ফর্দ নিয়ে আলাপ আলোচনায় কনে বা বরের আত্মীয়স্বজনরা সরাসরি কোনো অংশ নিতে পারেন না। সাধারণত এসব আলোচনা, দর কষাকষি করে থাকেন দু'পক্ষের এলাকার সর্দার বা মাহালত মুরুব্বিরা। এ কারণেই মাহালত অধিবাসীদের উপস্থিত থাকতে হয় সেদিন।
তারাই সব কিছু দেখে তাদের প্রস্তাবে সম্মতি প্রদান করলে, তখন বরের পিতা বা মাতা ফুলনিশানস্বরূপ কনেকে সোনার অলংকার উপহার দেন। কোথাও কোথাও রুমালে বেঁধে এ উপহার ফুলনিশান স্বরূপ কনের পিতার হাতে দেন। অতঃপর দুই বেয়াই কোলাকুলি করে সালাম বিনিময় করেন।
মাহালতের দায়িত্ব কিন্তু এখানেই শেষ নয়। বিয়ের শেষ পর্যন্ত তাদের ওপর বিভিন্ন দায়িত্ব ন্যস্ত থাকে।
পানসালাত, তেলাই ও সোহাগকাটা
এ দিনের রান্নাবান্নার আয়োজনও হয় মোটামুটি কাবিনের মতো করে। মোট ১২০ জন মানুষ হয়েছিল সোহানার ফুলনিশানের দিন। এ ১২০ জন ছাড়াও আরও ৫০ জনের খাবার রান্না করে পাঠাতে হয়েছিল সেদিন সোহানার পরিবারকে।
এরপর শুরু হয় আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী সবাইকে বিয়ের খবর জানানো। সেখানেও আছে ভিন্নতা। বিয়ের সময় প্রতিবেশীদের পান ও মিষ্টি দিয়ে বিয়ের খবর জানান তারা।
সোহানার বিয়েতেও তারা ভাড়াটিয়া ও আশেপাশের বাড়িগুলোতে ঘরে বানানো মিষ্টি, পিঠা, নিমকি ও পান দিয়ে বিয়ের খবর জানিয়েছিল।
বিয়ের দুদিন আগে 'পানসালাত' নামে একটি আয়োজন হয় পুরুষদের নিয়ে। চা-নাস্তা খেয়ে তারা বিয়ের দিনের দায়িত্ব বুঝে নেন। এরপর ধীরে ধীরে চলে আসে কাঙ্ক্ষিত সে দিন।

অন্যান্য অঞ্চলের মতো তাদেরও হলুদ, মেহেদির পর্ব আছে। মেহেদি অনুষ্ঠানে 'সোহাগকাটা' নামের এক বিশেষ আয়োজন থাকে। ছেলের বোন বরণকুলা নিয়ে ভাইয়ের মাথার চারদিকে ঘোরায়।
তারপর বোন বরণকুলার সেজদীপের ধোঁয়া হতে ডানহাতের বৃদ্ধা ও অনামিকা আঙুলের সাহায্যে কালি নিয়ে ভাইয়ের দু'চোখের ভ্রুতে কাজল লাগিয়ে দেয়। একেই 'সোহাগকাটা' বলা হয়। অনেক সময় মায়েরাও এ কাজ করে থাকেন।
মেয়েদের বেলায় মায়েরা কোলে নিয়ে মেয়েকে হলুদ মাখায়। সোহানার বেলায় তার মা করেছিল। সোহাগকাটা অনুষ্ঠানের পরপরই মেহেদি বা হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়।
বিবাহের রীতিনীতি ও পরিবর্তন
এখন তো মিশ্র সংস্কৃতিতে বৈচিত্র্যগুলো আলাদা করে সবসময় মানা হয় না। তবে নিয়ম ছিল, হলুদের দিন গোসলের সময় পাঁচ বা সাতজন সধবা মা বা বউয়ের আঁচল ছুঁয়ে হলুদ-সরষে তেল মিশিয়ে বর-কনের মাথায় দেওয়া হতো।
এটি আঞ্চলিকভাবে 'তেলাই' নামে পরিচিত। আবার পাঁচ পুকুর বা পাঁচ ঘাট থেকে পানি এনে গোসল করানোর রীতিও আছে। পাঁচ পুকুরের পানি দিয়ে গোসল করানোর ব্যাপারটি শুধু কনের বেলায় নয়, বরের বেলাতেও প্রযোজ্য। তবে এটি গ্রামাঞ্চলেই এখনো মানা হয়।
শহরে এখন বিয়ের আগের দিন বা বিয়ের দিন বর যায় সেলুনে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে এখনো বিয়ের দিন বরকে চুল কামাতে আসে নাপিত। আর সে নাপিত ও চুল কামাই ঘিরেও রয়েছে নানা রীতি।
পরিবারের যারা বরযাত্রী হবে, তারা প্রথমে চুল কামাই করে। এরপর বরের পালা। একখানি জলচৌকি রাখা হয় তার সামনে। নিয়ম হলো, দুলাভাই বা ভগ্নীপতি বরকে সঙ্গে নিয়ে এসে জলচৌকিতে বসিয়ে দেন।
নাপিতের জন্য 'সিধা' (বেগুন, ডাল, তরকারি, শুটকি, তেল, পান ও সুপারি) এনে টুকরিতে দেওয়া হয়। এ মাথা কামানোর পরই পাঁচ পুকুরের পানি দিয়ে দুলাকে গোসল করানো হয়।
এসব আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হতো বিয়ের দিন সকালে বা আগেই। এখন এতে অনেক পরিবর্তন এসেছে।
গ্রামের দিকে বা চট্টগ্রাম শহরের আদি বাসিন্দাদের মধ্যে এ সংস্কৃতি এখনো প্রচলিত থাকতে পারে। তবে শহরাঞ্চলে অনেক কিছুই রূপান্তরিত হয়েছে নতুন ধারায়।
তবে শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে যে ঐতিহ্য এখনও টিকে আছে, তা হলো 'নজরানা' দেওয়া। সেকালে রাজা-বাদশাহের সামনে সম্মানার্থে নজরানা বা দর্শনী দেওয়া হতো, সে রীতি এখন বর-কনের বিয়েতেও দেখা যায়। বউ আনতে যাবার আগে বরের সামনে আত্মীয়-স্বজন ও পাড়াপ্রতিবেশীরা টাকা বা অন্যান্য উপহার দেন, যা একপ্রকার নজরানা হিসেবে গণ্য হয়। আগে এটি পানের বাটায় দেওয়া হতো।
আব্দুল হক চৌধুরীর 'চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতি' বই থেকে জানা যায়, আগে বরযাত্রী (স্থানীয় ভাষায় 'বৈরাত') কনের বাড়িতে পৌঁছালে তাদের অপেক্ষা করতে হতো বাড়ির আঙিনা বা পুকুরপাড়ে। সেখানে শরবত ও মিষ্টিমুখ করিয়ে বসিয়ে রাখা হতো যতক্ষণ না 'বকশিশ' সংক্রান্ত আপস হতো।
এ আপসের বিষয়ে ছোট-বড় সবাই অংশ নিত। সমঝোতা না হওয়া পর্যন্ত বর ও বরযাত্রীদের খোলা জায়গায় অপেক্ষা করতে হতো, এমনকি ধুলোমাটির মধ্যেও বসে থাকতে হতো। বরের বাড়ি থেকেই অপেক্ষারত বরযাত্রীদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হতো। কখনো কখনো সমঝোতা না হলে বিয়েই ভেঙে যেত।

বর্তমানে, এ প্রথা কিছুটা বিবর্তিত হয়ে গেট ধরা, জুতো চুরি, বরের হাত ধোয়ার নামে শ্যালক-শ্যালিকাদের বকশিশ আদায়ের রূপ লাভ করেছে।
তবে চট্টগ্রামের বৌভাত অনুষ্ঠানে একটি ভিন্নতা দেখা যায়। ঢাকার বা অন্যান্য জায়গার মতো এখানে বড় পরিসরে বৌভাত হয় না। যদি বিয়েতে এক হাজার মানুষের আয়োজন হয়, তবে বৌভাতে সে সংখ্যা কমে পাঁচশোর মতো হয়। কতজন অতিথি আমন্ত্রিত হবেন, তা সাধারণত বরপক্ষ নির্ধারণ করে। সোহানার বিয়েতেও এমনটি দেখা গেছে—বরযাত্রীর সংখ্যা চারশোর বেশি হলেও সোহানার পরিবার বৌভাতে মাত্র ১৮০ জন অতিথি নিতে চেয়েছিল, যা শেষমেশ ১৪০ জনে নেমে আসে বরপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। অনেকে বৌভাতকে 'ওয়ালিমা' নামেও অভিহিত করেন।
'জুইয্যা বউকে কুইয্যা খাওয়ানো'
বলা হয়, চট্টগ্রামে বিয়ের পরও মেয়েপক্ষকে প্রায় আরেকটি বিয়ের সমান খরচ বহন করতে হয়। বিয়ের সময় এক হাজার অতিথিকে খাওয়ানোর পর, কন্যা বিদায়ের সময় শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যেতে হয় চাল, সবজি, মসলা এবং আরও অনেক কিছু। সোহানার বিয়েতে মেয়েপক্ষকে চাল, দুধ, পাঁচ কেজি করে সবজি দিতে হয়েছে।
এছাড়া, শ্বশুরবাড়িতে বছরের বিভিন্ন উৎসব ও মৌসুম অনুযায়ী খাবার পাঠানোর রীতি রয়েছে। রোজার সময় ছোলা, ডাল, খেজুরসহ ইফতার সামগ্রী, ঈদুল ফিতরে সেমাই, চিনি, ঘি, নারিকেল—এসব পাঠানো আবশ্যক। কোরবানির ঈদে আস্ত গরু বা ছাগলসহ মশলা, চাল, ময়দা ইত্যাদি পাঠানোর প্রচলন রয়েছে। মহররমের সময় রান্না করা মাংস ও মুরগি পাঠাতে হয়।
হিন্দু পরিবারগুলোর মধ্যে চৈত্র সংক্রান্তি ও পৌষ সংক্রান্তিতে হাতে বানানো মিষ্টি, পিঠা পাঠানোর রীতি প্রচলিত। শীতকালে মৌসুমী ফল ও পিঠাও পাঠানো হয়।
চট্টগ্রামের ভাষায় একে 'জুইয্যা বউকে কুইয্যা খাওয়ানো' বলে এক প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে। মূলত, বিয়ের পর প্রথম কয়েক বছর এসব রীতিনীতি খুব গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা হয়।
তবে এখানেই শেষ নয়। এরপর সন্তান হলে 'সাধ' অনুষ্ঠানের খরচও মেয়ের পরিবারকেই বহন করতে হয়। আবার, যদি বেয়াইনবাড়ির কোনো আত্মীয় মারা যান, তবে পাঠাতে হয় ফলাহারও।
চট্টগ্রামের সদরঘাট অঞ্চলের বাসিন্দা শমী ঘোষের কথাই ধরা যাক। তাদের পারিবারিক পর্দার ব্যবসা রয়েছে। মেধাবী এবং সুন্দরী শমীর বিয়ে হয় চট্টগ্রামের অন্যতম হিন্দু বড় ব্যবসায়ী পরিবারে।
শমীর পরিবার উচ্চমধ্যবিত্ত হলেও বেয়াইবাড়ির তুলনায় তারা কম বিত্তশালী। এ কারণে, শমীর চাচাশ্বশুর মারা যাওয়ার পর ফলাহার পাঠানো নিয়ে তার পরিবারকে কটু কথা শুনতে হয়েছিল। বিত্তবান বেয়াইবাড়ির সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে শমীর পরিবারকে বাধ্য হয়ে সাত রকম ফল মণখানেক করে পাঠাতে হয়েছিল বলে জানান তিনি।
'বেয়াইভাতা'
বিয়ের দশদিনের মধ্যে জামাইকে বন্ধু-বান্ধবসহ আবার খাওয়ানোর রীতি রয়েছে। সোহানার বিয়েতেও তিনদিন পর বর ও তার বন্ধুরা এসেছিলেন প্রায় দশজন। ঐতিহ্য অনুসারে, এদিন বরপক্ষের জন্য ৫৬ রকম ব্যঞ্জন পরিবেশনের কথা রয়েছে। অবশ্য সোহানার পরিবার ২৫টির বেশি পদ রান্না করেছিল। এর পরে আবার বরের আত্মীয়স্বজনদেরও একবার খাওয়াতে হয়।
খাওয়ানোর ভেন্যুও ঠিক করে দেয় বরের পরিবার। এটিকে বলা হয় 'বেয়াইভাতা'। আগে এতে দশ-বারোজন থাকলেও এখন অনেক জায়গায় এ সংখ্যা একশোরও বেশি হয়।
আব্দুল হক চৌধুরীর বইয়ে এ ধরনের আরও কিছু পুরনো রীতি ও পরিভাষার উল্লেখ রয়েছে, যেমন—'নতুন জামাইর আড়াইয়া খাওন', 'দুধপান', 'জামাইর পাঠ পাক্কন', 'নতুন বধূকে পাঁচ তরকারি দিয়ে ভাত খাওয়ানো', 'নতুন জামাইর চোরা বেড়ান', 'নতুন জামাইর সালামী', 'দামান্দী বা দাউন্দী খাওয়ানো', 'হাজতি', 'মানের ভাত' ইত্যাদি। তবে বর্তমানে এসবের অনেককিছুই বদলে গেছে বা রীতিগুলো পরিবর্তিত হয়ে নতুন রূপ ধারণ করেছে।
বরপক্ষেরও আছে কিছু নিয়ম। যেমন, বধূবরণের সময় বধূর পা ধুয়ে দিয়ে তাকে কোলে করে বিছানায় বসিয়ে দেন শ্বশুরবাড়ির লোকজন। মূলত বরের বোন বা ভাবিরাই এটি করে থাকেন।

বধূবরণের পর শুরু হয় বউ দেখার পালা। প্রথমে আত্মীয়স্বজন, পরে পাড়া-প্রতিবেশিরা আসেন একে একে দেখতে। তারা বউকে সোনা দিয়ে বরণ করেন। একে বলে মুখ দেখে দেওয়া। মুখ দেখে সোনা দিয়ে দুধকলা খাওয়ানো হয়।
এরপর নতুন বউকে ভাত খাওয়ানোর সময় পাঁচ রকম তরকারি থাকতে হয়। আবার, যখন ভাত দেওয়া হবে, তখন শাড়ি ও সোনা দিতে হয়। তবে এটি সামর্থ্যের ওপর নির্ভরশীল। সোনা না হলেও কেউ টাকা দেন, জানান শমী ঘোষ।
চট্টগ্রামের ছেলেদের মধ্যে গড়ে উঠেছে 'বিবাহভীতি'
চাঁটগাইয়া বিয়ে বলতেই লোকে এখন বোঝে পয়সা খরচ করে ধুমধাম আয়োজিত অনুষ্ঠান। অথচ চট্টগ্রামের ছিল নিজস্ব কিছু রীতিনীতি, যা সময়ের সঙ্গে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। এখন লোক দেখানোর আয়োজনই বড় হয়ে উঠেছে বলে মনে করেন অনেকে।
মেয়েদের যেমন বলির পাঁঠা হতে হয়, তেমনি ছেলেদের গলাতেও কাবিনের নামে বিশাল অঙ্কের বোঝা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এ গ্যাঁড়াকলে পড়ে চট্টগ্রামের ছেলেদের মধ্যে গড়ে উঠেছে বিবাহভীতি। ফলে দেরিতে বিয়ে করার প্রবণতা বাড়ছে।
গবেষক শামসুল আরেফিন জানান, এত খরচ করে বিয়ে দেওয়ার পর মেয়ের পরিবার নিশ্চয়তা চান, যাতে বিবাহবিচ্ছেদ না ঘটে। মূলত তালাক রুখতেই এত বড় অঙ্কের মোহরানা ধরা হয়।
তবে 'বাংলাদেশ জার্নাল অব ল'-এ প্রকাশিত এক গবেষণা প্রবন্ধে দেখা গেছে, চট্টগ্রামে বিবাহবিচ্ছেদের হার বৃদ্ধি পেয়েছে, যার বেশিরভাগই স্ত্রী কর্তৃক তালাক প্রদান।
ওই গবেষণায় আরও দেখা গেছে, গ্রামের তুলনায় শহরে দেনমোহরের পরিমাণ বেশি। শহরাঞ্চলে স্বামী কর্তৃক তালাক দেওয়ার ক্ষেত্রে গড় দেনমোহর ৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা এবং স্ত্রী কর্তৃক তালাক প্রদানের ক্ষেত্রে গড় দেনমোহর ১১ লাখ ৫৬ হাজার টাকা।
গবেষক শামসুল আরেফিনের মতে, আগে এত বাড়াবাড়ি ছিল না। বর-কনের সামর্থ্যের ওপরই সব আয়োজন করা হতো। বরং চট্টগ্রামের একান্ত রীতিনীতিগুলোর দিকেই গুরুত্ব দেওয়া হতো। কিন্তু এখন সে চিত্র বদলেছে।
একবিংশ শতাব্দীর এ সময়ে এসেও শোনা যায়, অমুক বাড়ির বউ শ্বশুরবাড়ির আবদার মেটাতে না পারায় মারধর বা মানসিক চাপে পড়েছেন। কেউবা তিন মেয়েকে বিয়ে দিতে গিয়ে সবকিছু বিক্রি করে দিয়ে গ্রামে ফিরে গেছেন। এমনকি ভিক্ষা করে জীবন চালানোর ঘটনাও দেখা গেছে।
এ পরিস্থিতি যেমন হতাশ করে, তেমনি আশার আলোও দেখা যায় কিছু তরুণ-তরুণীর মাঝে। তারা 'ট্র্যাডিশন' নামক ভয়ংকর প্রথা থেকে বেরিয়ে ছোট পরিসরে বা সুন্নতি বিয়ের কথা ভাবছেন।
এছাড়া সমাজের যৌতুক প্রথা, দেনমোহরের নামে অতিরিক্ত অর্থ আদায় এবং অনাড়ম্বর আপ্যায়নের বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছে আলহাজ শামসুল হক ফাউন্ডেশন। তারা ভিন্নধর্মী এক বিয়ের আয়োজন করছে, যেখানে খরচের সমস্ত দায়ভার ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষ বহন করছে।
'যৌতুককে ঘৃণা করি, সহজলভ্য মোহরানা আদায় করি'—এ স্লোগানে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি।
সহায়ক তথ্যসূত্র: মোহাম্মদ, নেছার। (২০২০)। চট্টগ্রামের সংস্কৃতির ঐতিহ্যের শিকড়ের সন্ধানে।