যে বেলুনের সাথে ছবি তুলতে গুনতে হয় টাকা!
কোনো এক বিকেলে যদি দেখেন, টিএসসিতে আচমকা কথা বলা বন্ধ প্রেমিক-প্রেমিকার, তবে জানবেন—এই গণ্ডগোলের গোড়ায় থাকতে পারে 'ঝিলমিল' বেলুন!
গ্যাসভর্তি সাদা বেলুন, গায়ে বাহারি রঙের স্টিকার। আর তাতেই এর নাম হয়েছে ঝিলমিল। ফেসবুক আর টিকটকের কল্যাণে এই বেলুন এখন এক নতুন ট্রেন্ড। এমনই উন্মাদনা এই বেলুনের, না কিনে দিলে ফেসবুকে মজা করে সম্পর্কে ইতি টানার হুমকি দিচ্ছেন অনেকে!
সকাল-বিকেল-সন্ধ্যা—ঢাকার বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে বেলুন বিক্রেতাদের চারপাশে সর্বদা ভিড় লেগেই থাকে। তবে এ ভিড় যত না কেনার জন্য, তার চেয়েও বেশি বেলুন হাতে ছবি তোলার আশায়। আর সে চাহিদা এতটাই যে ছবি তোলার জন্যই গুনতে হচ্ছে টাকা!
বাতি বেলুন থেকে গ্যাস বেলুন
স্বামীকে নিয়ে বইমেলায় এসেছেন সেঁজুতি (ছদ্মনাম)। মেলায় ঢোকার আগেই চোখ আটকে গেল ঝিলমিল বেলুনে। বেচারা স্বামীকে পাকড়াও করে নিয়ে গেলেন বেলুন কিনতে। তবে তার আগে বেলুন হাতে তুলে নিলেন একটি ছবি।
বইমেলা শুরু হতেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এ যেন এক সাধারণ দৃশ্য! শুধু নারীরাই নন, বেশিরভাগ বিক্রেতার মতে, ছেলে-বুড়ো সকলের কাছেই সমাদর পাচ্ছে এই ঝিলমিল বেলুন।

মাত্র কয়েকমাস আগে এ বেলুনের যাত্রা শুরু মোহম্মদ সজীবের হাত ধরে। বেলুনের ব্যবসা তার তিন পুরুষের। এর আগে গ্যাস ভরে পাইকারি বিক্রি করতেন সাধারণ বেলুন। হঠাৎ এক নতুন চিন্তা ঘুরিয়ে দেয় ব্যবসার মোড়!
সজীব জানালেন, রাজধানীতে স্টিকারযুক্ত বেলুনে ব্যাটারিচালিত বাতি যুক্ত করে ঝিলমিল বেলুন নামে বিক্রি করতেন কেউ কেউ। তিনি ভাবলেন, এই বেলুনগুলোতেই গ্যাস ভরে বিক্রি করা যায় কিনা!
মাস দুয়েক আগে গ্যাসভর্তি স্টিকারযুক্ত বেলুন নিজের হকারদের মাধ্যমে মার্কেটে আনেন তিনি। শুরুতে বিক্রি হচ্ছিল সামান্যই। তবে ফেসবুক আর টিকটিকই বদলে দিয়েছে সব।
'যখন শুরু করছি, ত্রিশটা মালের বিশটাই চলে নাই। আস্তে আস্তে সবাই ছবি তুলছে, যখন ফেসবুক, টিকটকে দেয়া শুরু করছে, তখনই সবাই চিনছে, বাংলাদেশে নতুন বেলুন আসছে, ঝিলমিল। এরপর থেকে সবাই কেনা শুরু করছে', বললেন সজীব।

ঢাকার প্রায় সব বিনোদন কেন্দ্রেই চলে সজীবের বেলুন। বিক্রেতাগণ পাইকারি দরে কিনে নিয়ে যান। এরপর নিজেরা খুচরা বিক্রি করেন। প্রতিটি বেলুনের মূল্য ৮০ টাকা। তবে একসাথে অনেকগুলো কিনলে কিছুটা কমে পাওয়া যায়।
কেন এত চাহিদা?
বিকেল বেলা ৫৮টি বেলুন নিয়ে বের হয়েছিলেন মোহাম্মদ নয়ন। সন্ধ্যার আগেই ২০টি বিক্রি করে ফেলেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাকিম চত্বরে পাওয়া গেল তাকে। শিক্ষিত এই যুবক জানালেন, আগে চাকরি করতেন, কিন্তু বেতন ঠিকমতো পাচ্ছিলেন না। এরপরই নেমে পড়েন এ ব্যবসায়। আপাতত এ পেশাতেই থাকতে চান কিছুদিন।
নয়ন জানালেন, ট্রেন্ড শুরু হওয়ার পর থেকে ব্যবসা বেশ ভালোই হচ্ছে। পাইকারি আর খুচরা মূল্যের পার্থক্য সামান্য বলে লাভ খুব বেশি করতে পারেন না, তবে এমন চাহিদা থাকলে স্বাচ্ছন্দ্যে চলে যাবে তার।
নয়নের বেলুনগুলো নিয়ে ছবি তুলছিলেন হাবিবা নামে এক তরুণী। তিনি বললেন, 'খুব কালারফুল বেলুনগুলো। বাচ্চাদের কাছে তো বেশি ভালো লাগে। আমি যদিও বাচ্চা না, কিন্তু এত এত রঙিন বেলুন উড়ছে, আমারও ভালো লাগছে!'

নাম প্রকাশ না করে অন্য এক ক্রেতা জানালেন, 'কেন পপুলার হলো জানি না। ফেসবুকে দেখি সবাই ছবি তুলে, দেখতে ভালো লাগে। আমিও দেখে ছবি তুলতে আসলাম!'
বিক্রেতা আল মাহমুদ জানালেন, বেলুনগুলো যখন খোলা আকাশে উড়তে চায়, তখন দেখে লোভ সামলানো কঠিন! আর এই আকর্ষণের ফলেই মানুষ কিনছে আর তারাও টিকে রয়েছেন এ পেশায়।
ঝিলমিল বেলুনের ডিজাইনও অনেক বৈচিত্র্যময়। স্মাইলি, লাভ ইমোজি, এভেঞ্জারস সিরিজের চরিত্র, ফুল-লতা-পাতার নকশা—সবই আছে। প্রজাপতি, ঘাসফড়িং, স্পাইডার ম্যান, ব্যাটম্যান, এমনকি মিকি মাউসের স্টিকারওয়ালা বেলুন পাওয়া যায়।
এসব বাহারি ডিজাইনই এগুলোর জনপ্রিয়তা কারণ, বলছেন ক্রেতারা। আর সামাজিক মাধ্যমে নিজেকে সুন্দর করে উপস্থাপনের ইচ্ছে তো রয়েছেই!
ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী মৌসুমি মৌ বললেন, 'এই বেলুন মেয়েদের ইমোশন!'
দুই ধরনের ঝিলমিল
চাকরি করেন নূর আহমেদ। কিন্তু এটাই তার একমাত্র পেশা নয়। বছর আট হলো সন্ধ্যার পরে বেলুন বিক্রি করতে বের হন তিনি। শুধু তাই নয়, তার অধীনে কাজ করে আর তিন যুবক। নূর আহমেদের দাবি, তার তৈরি ও বিক্রি করা এ বেলুনই আসল ঝিলমিল বেলুন!
'আমি অনেক আগে থেকেই এই মাল বিক্রি করি। শহীদ মিনারে গেলেই আমারে পাবেন। ওই যে গ্যাসের বেলুন, ওইটা ঝিলমিল বেলুন না। অরিজিনাল ঝিলমিল বেলুন আমার এইটা', বললেন নূর।
দুই পেন্সিল ব্যাটারিযুক্ত এই বেলুন ১৫০ টাকা করে বিক্রি করেন তিনি। তার দাবি, একটানা জ্বালালে এই বাতি জ্বলবে পুরো সপ্তাহ।

বইমেলা উপলক্ষ্যে অন্যদের মত তারও বিক্রি বেড়েছে। জানালেন, যত রাত বাড়বে, গ্যাস বেলুনের চাহিদা কমবে, কিন্তু বাড়বে তার বিক্রি!
অন্যদিকে গ্যাস বেলুন বিক্রেতারা বলছেন, বাতিযুক্ত বেলুনের মধ্যে হাইড্রোজেন গ্যাস ভরে বিক্রি করেই বেশি লাভবান হওয়া যায়। এই পণ্যটি 'ভাইরাল' হওয়ায় আপাতত এটি নিয়েই সকলের আগ্রহ।
এক বিক্রেতা বলেন, 'এটা বানানোর খরচ কম। বিক্রিও করি কম দামে। ৬৫ টাকায় কিনে ৮০ টাকা বিক্রি। কতই লাভ করি বলেন?'।
পার্ট-টাইম বেলুনওয়ালা, ফুল-টাইম ফটোগ্রাফার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার স্বোপার্জিত স্বাধীনতার সামনে মন খারাপ করে বসেছিল রুমন, বয়স বারো কি তেরো হবে। জিজ্ঞেস করতেই জানালো, বিকেল গড়িয়ে গেলেও এখনো মাত্র একটি বেলুন বিক্রি করতে পেরেছে!
তার মতো অনেক বিক্রেতাই অভিযোগ করলেন, বেলুন নিয়ে বের হলেই ক্রেতারা ছবি তোলার আবদার করেন, কিন্তু কিনতে চান না। এতে তাদের বিক্রি কমে যায়। অনেকের মতে, ছবি তোলা পর যদি তাদের ক্ষতির কথা চিন্তা করে একটি বেলুনও কিনে নিতেন ক্রেতারা, তাহলে কোনো কষ্ট থাকত না তাদের।

তাই নিজেদের ক্ষতি বাঁচাতে অনেক বিক্রেতাই বাধ্য হয়ে নিয়ম করেছেন—'ছবি তুললে টাকা দিতে হবে'। এর পরেই বেলুন বিক্রেতার বদলে ফটোগ্রাফার হয়ে আয় করছেন তারা!
নয়ন জানালেন, ছবি তোলার পর খুশি হয়ে যে যা বকশিশ দেয়, সেটিই রেখে দেন তিনি। তবে তাদের ক্ষতির কথা যেন সবাই চিন্তা করেন এই অনুরোধ তার।
ব্যবসায় বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে সজীব জানালেন, অল্প লাভেই মাল ছাড়তে হয় তাদের। নইলে বিক্রি আরও কমে যাবে বলে তার ধারণা। তিনি বলেন, 'প্রতিটা বেলুন কেনাই পড়ে ৩৮ থেকে ৪০ টাকা। গ্যাস খরচ, লেবার খরচ দিয়ে আমরা সীমিত লাভে বিক্রি করি ৬৫ টাকায়। এরমধ্যে আবার অনেক মাল ফেটে যায়। একটা বেলুন ফুটলে চারটা বেলুনের লাভ শেষ।'
কতদিন থাকবে চাহিদা?
বিক্রেতা নয়ন থেকে শুরু করে মহাজন সজীব, সকলেই জানেন, নতুন কিছু না আনতে পারলে ঝিলমিল বেলুনের চাহিদা খুব বেশিদিন থাকবে না। এই বাস্তবতা মেনেই ব্যবসা করছেন তারা।
বইমেলা চলছে। সজীবের প্রতিটি দিনই এখন কর্মব্যস্ত। কতদিন থাকবে এ চাহিদা, না জানলেও অনুমান করতে পারেন তিনি। বললেন, সামনে রোজার সময় স্কুলকলেজ বন্ধ থাকবে, মানুষ বেরও হবে কম। পুরো মাসটাই বসে কাটাতে হবে সবাইকে।
সজীব বলেন, 'যদি নতুন কিছু করতে পারি, তাইলে আবার চলতে পারে। ব্যবসা এই মাসটাই থাকবে। তারপর রমজান। বছরে এক-দুইদিন, পহেলা বৈশাখ, ঈদ, এগুলাতে ভালো ব্যবসা৷ অনেক সময় আমার লোকেরা বইসাও থাকে!'।
তরুণ এই ব্যবসায়ীর ভাবনা এখন নতুন কোনো ট্রেন্ড নিয়ে আসার—যাতে তার পূর্বপুরুষের ব্যবসাটি আরও কিছুকাল চালিয়ে যেতে পারেন, আর তার ওপর নির্ভরশীল বিক্রেতারাও জীবিকার পথ খুঁজে পান।