নির্বাচনের পরও প্রচলিত থাকবে আমেরিকার ‘পাগলা রাজা’র গল্প

অদূর ভবিষ্যতেও অপ্রাসঙ্গিক হবেন না মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প; আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হেরে গেলেও না। এমনকি তার মৃত্যুর পর কয়েক শত বছরেও না। তবে এর কারণ তার কোনো অর্জন বা কৃতিত্ত্ব নয়; 'পাগলা রাজা' হিসেবেই তার গল্প অমর কাহিনি হিসেবে প্রচলিত থাকবে একবিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে।
ইতিহাসের পাতা ঘাটলে বিভিন্ন সময়ের এমন আরও অনেক শাসকের বর্ণনা পাওয়া যায়। রোমান সম্রাট ক্যালিগুলা তার ঘোড়া ইনসিটাটাসকে রোমের রাষ্ট্রদূতের মর্যাদা দেন। রাস্তায় ক্যালিগুলার দিকে তাকানোও নিষিদ্ধ ছিল। বলা যায়, নিজেকে দেবতাই মনে করতেন তিনি।
প্রুশিয়ার রাজা ভেবে একটি গাছের সঙ্গে হাত মেলানোর গল্প প্রচলিত আছে ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় জর্জের ব্যাপারে।
এধরনের পাগলাটে রাজাদের দেখা পাওয়া যায় সাহিত্যের পাতায়, টেলিভিশনের পর্দায়ও। জর্জ আর আর মার্টিনের বিখ্যাত উপন্যাস সিরিজ 'আ সঙ অব আইস অ্যান্ড ফায়ার'-এর এমনই এক চরিত্র 'ম্যাড কিং' হিসেবে পরিচিত এরিস টারগারিয়ান। এই উপন্যাস অবলম্বনেই নির্মিত হয়েছে এইচবিও'র বিখ্যাত টিভি সিরিজ 'গেম অব থ্রোনস'।
উইলিয়াম শেকসপিয়রের 'কিং লিয়ার' ট্র্যাজেডির রাজা স্বার্থের জন্য নিজের মেয়েদেরও ব্যবহার করেছিলেন।
ট্রাম্প গাছের সঙ্গে হাত মেলানোর মতো কাজ না করলেও, এসব রাজার অনেক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই রয়েছে তার মধ্যে। সহানুভূতিবিহীন এই প্রেসিডেন্ট সহজেই চাটুকারিতায় প্রভাবিত হন। তার ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে চলে পরিবারের সদস্যরাও। হাস্যকর সব ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচার করে বেড়ান তিনি; টুইটার বার্তায় করেন কুসংস্কার প্রচার।
তিনি এমন এক ক্ষমতাধর দেশের প্রেসিডেন্ট, যে দেশের রাজনীতি প্রভাবিত করে সারা বিশ্বকে। এখানেই তার রাজনৈতিক জীবনের অবসান হলে, বর্তমান মহামারিও তার পেছনে একটি কারণ হিসেবে কাজ করবে। আসলেই এমনটা ঘটলে; তা হবে আধুনিক যুগের বাইবেলে বর্ণিত কাহিনির মতোই চমকপ্রদ।
২১ শতকে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস পরিক্রমা বোঝার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হবে ট্রাম্পের শাসনামল। একারণেই আগামী প্রজন্মের কাছেও প্রাসঙ্গিক থাকবে তিনি।
ট্রাম্পের মতো ব্যক্তির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া রাজনৈতিক পরিবর্তনের 'কারণ' নাকি 'লক্ষণ'- তিনি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই রাজনৈতিক তত্ত্ববিদদের বিতর্কের অন্যতম বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে এটি। ট্রাম্প নিজেই রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের লক্ষণ। মোহাবিষ্ট শ্বেতাঙ্গ ভোটার, অর্থনৈতিক সংকট, কর্তৃপক্ষের প্রতি অবিশ্বাস- এসব কিছু থেকেই লাভবান হয়েছেন তিনি। এসবই সত্যি, তবে এই আলোচনা থেকে প্রায়শই বাদ পড়ে যায়- ট্রাম্পের এসকল আচরণ যুক্তরাষ্ট্রের ওপর কীরূপ প্রভাব ফেলেছে, সেই আলোচনা।
২০১৬ সালের নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের আরেক প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী টেড ক্রুজও যদি নির্বাচিত হতেন, সন্দেহাতীতভাবে তিনিও জনতোষণবাদী রাজনীতিই করতেন।
ক্রুজের জাতীয়তাবাদী নীতি আন্তর্জাতিকভাবে উদার রাজনীতির পথের কাঁটা হয়ে উঠত। তার নির্বাচনী প্রচারণায় বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে 'সবার আগে আমেরিকা'- এমনটাও ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে, এমনকি ক্রুজ নির্বাচিত হলেও ট্রাম্প শাসনামলের মতো পরিস্থিতির তৈরি হতো না।
বৈশ্বিক মহামারির সময় চিকিৎসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া, প্রাণঘাতী রোগের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিকভাবে অপ্রমাণিত ওষুধের প্রচারণা- এসব কাজ ক্রুজও করতেন না। পেন্টাগনের নির্দেশনা টুইটার বার্তায় দেওয়া বা উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জঙ উনের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের মতো কাজও করতেন না হয়তো। ক্রুজও সম্ভবত নোবেলজয়ী নাদিয়া মুরাদের (যার মা ও ছয় ভাইকে হত্যাকে করেছে আইএস) প্রতি সহানুভূতিশীল হতেন।
ক্রুজের ব্যাপারে এই অনুমিত ধারণাও ইতিহাসে ট্রাম্পের অবস্থান বুঝতে সহায়ক। দমন-নিপীড়ন, ধনীদের কর মওকুফ, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অনিচ্ছুক- এসব কিছু দেখেই বলা যায়, ট্রাম্প রাজনীতির বড়সর পরিবর্তনের লক্ষন; কারণ নন। এমনকি ক্রুজসহ ট্রাম্পের অনেক অনুসারীই ক্ষেত্রবিশেষে ট্রাম্পের চেয়ে বেশি কট্টরপন্থী হতে পারেন।
- সূত্র: দ্য অ্যাটলান্টিক