তালেবানের কাছ থেকে বাগরাম বিমানঘাঁটি কেন 'ফেরত' চায় যুক্তরাষ্ট্র?

আফগানিস্তানের বাগরাম বিমানঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে ফিরিয়ে আনার আশা প্রকাশ করেছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তালেবান-শাসিত আফগানিস্তানে আমেরিকার নতুন করে উপস্থিতির ইঙ্গিতও দেন তিনি।
যুক্তরাজ্য সফর শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে কথা বলার সময় ট্রাম্প বাগরাম প্রসঙ্গে বলেন, 'আমরা এটি ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছি।'
জো বাইডেন প্রশাসনের আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারকে 'পুরোপুরি বিপর্যয়' আখ্যা দিয়ে ট্রাম্প বাগরাম বিমানঘাঁটি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেন। ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতা দখলের সময় দ্রুতই বিমানঘাঁটিটি তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ট্রাম্প বলেন, 'আমরা বিনা পয়সায় এটি তাদের হাতে তুলে দিয়েছিলাম।' আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া নিয়ে বাইডেন প্রশাসনের সমালোচনা করে আসছেন তিনি। স্পষ্ট করে জানান, 'আমরা ওই ঘাঁটিটি ফেরত চাই।'
আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল থেকে প্রায় এক ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত বাগরাম বিমানঘাঁটি বছরের পর বছর ধরে তালেবান ও আল-কায়েদার বিরুদ্ধে যুদ্ধের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ২০১২ সালের দিকে এর সর্বোচ্চ ব্যবহারের সময় এই সুবিশাল ঘাঁটিতে ১ লাখেরও বেশি মার্কিন সেনা আসা-যাওয়া করেছে।
এদিকে, বৃহস্পতিবার (যুক্তরাষ্ট্রের সময়) গভীর রাতে আফগান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা জাকির জালালি বাগরামকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার ধারণাকে সরাসরি নাকচ করে দেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) জালালি লিখেছেন, 'আফগানিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা উচিত এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও অভিন্ন স্বার্থের ভিত্তিতে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক থাকতে পারে।' তিনি আরও বলেন, 'আফগানরা ইতিহাসে কোনো সামরিক উপস্থিতি মেনে নেয়নি, এবং দোহা আলোচনা ও চুক্তির সময় এই সম্ভাবনা সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। তবে, আরও যোগাযোগের জন্য দ্বার উন্মুক্ত রয়েছে।'
বাগরাম বিমানঘাঁটি পুনরুদ্ধারে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগ্রহের পেছনে একটি মূল কারণও স্পষ্ট করেছেন তিনি নিজেই: প্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তি চীনের নৈকট্য।
বৃহস্পতিবারের মন্তব্যে ট্রাম্প বলেন, 'চীন যেখানে তার পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে, সেখান থেকে এটি মাত্র এক ঘণ্টার দূরত্বে।' এই মন্তব্যটি আসে চলমান বাণিজ্য আলোচনার মধ্যে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে তার কথা বলার একদিন আগে। পরে এয়ার ফোর্স ওয়ানে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় ট্রাম্প বাগরামকে 'বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ঘাঁটি' হিসেবে উল্লেখ করেন, বিশেষ করে এর রানওয়ের শক্তি ও দৈর্ঘ্যের কারণে। তিনি যোগ করেন, 'সেখানে যেকোনো কিছু অবতরণ করানো যেত।'
ট্রাম্প আবারও জোর দিয়ে বলেন যে ঘাঁটিটি 'চীন যেখানে তাদের ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে, সেখান থেকে এক ঘণ্টার দূরত্বে।'
তবে ট্রাম্পের এই মন্তব্যের প্রেক্ষিতে শুক্রবার চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিন জিয়ান বলেন, চীন 'আফগানিস্তানের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং ভৌগোলিক অখণ্ডতাকে সম্মান করে।' লিন আরও বলেন, 'আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ সে দেশের জনগণকেই ঠিক করতে হবে। এই অঞ্চলে উত্তেজনা সৃষ্টি করা এবং সংঘাতের জন্ম দেওয়া জনপ্রিয় হবে না।'
শিকাগো-ভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা বুলেটিন অব দ্য অ্যাটমিক সায়েন্টিস্টস-এর তথ্য অনুযায়ী, চীন দ্রুত তার পারমাণবিক অস্ত্রের মজুদ বাড়িয়েছে এবং বর্তমানে তাদের কাছে প্রায় ৬০০টি ওয়ারহেড রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
নিঃসন্দেহে, বাগরাম পুনরুদ্ধার করলে চীনের ওপর কেবল বৃহত্তর নজরদারিই পাওয়া যাবে না, ঘাঁটিটিতে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদবিরোধী প্রচেষ্টাতেও সহায়ক হতে পারে—যা ট্রাম্পের কাছে আকর্ষণীয় হতে পারে।
বাগরামের ভবিষ্যৎ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তালেবানের সঙ্গে কতটা আলোচনা করেছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসিস-এর লং ওয়ার জার্নাল-এর সম্পাদক বিল রোজো বৃহস্পতিবার অনলাইনে প্রকাশিত মন্তব্যে সতর্ক করে বলেছেন, 'তালেবান বিষয়টি বিবেচনা করলেও, চীন অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রকে আফগানিস্তান থেকে দূরে রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা করবে এবং তাদের কাছে এর জন্য যথেষ্ট সুবিধা ও প্রলোভন রয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'ট্রাম্প প্রশাসনের খুব সতর্ক থাকা উচিত, যাতে তালেবানকে কোনো ছাড় দিয়ে শেষ পর্যন্ত বাগরামে প্রবেশের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে না হয়।'
তালেবান তাদের বৈশ্বিক অবস্থান পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে। আফগানিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে গত মার্চে ডেল্টা এয়ারলাইন্সের মেকানিক আমেরিকান জর্জ গ্লেজম্যানকে মুক্তি দিয়েছিল এই গোষ্ঠী। স্কাই নিউজের (এনবিসি নিউজের সহযোগী) খবর অনুযায়ী, শুক্রবার তালেবান ৭৬ বছর বয়সী ব্রিটিশ নারী বারবারি রেনল্ডস এবং তার ৮০ বছর বয়সী স্বামী পিটার রেনল্ডসকেও মুক্তি দিয়েছে, যাদেরকে ফেব্রুয়ারিতে আফগান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আটক করেছিল।
ট্রাম্পের এই মন্তব্য এমন সময়ে এলো যখন পেন্টাগন আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার নিয়ে পর্যালোচনা চালাচ্ছে। ওই প্রত্যাহারের সময় ইসলামিক স্টেট সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বোমা হামলায় কাবুলের বিমানবন্দরে ১৩ জন মার্কিন সেনা সদস্য এবং ১৭০ জন আফগান নিহত হয়েছিলেন।
ট্রাম্প, যিনি তার প্রথম মেয়াদেই আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন, তিনি বাইডেন প্রশাসনের এই প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া পরিচালনার কড়া সমালোচক। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অধীনে হোয়াইট হাউস বিশৃঙ্খল প্রত্যাহারের জন্য মূলত ট্রাম্প প্রশাসনকেই দায়ী করেছে। ২০২৩ সালে প্রকাশিত জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাইডেনের অপারেশন পরিচালনার বিকল্পগুলো 'তার পূর্বসূরির তৈরি করা পরিস্থিতি দ্বারা মারাত্মকভাবে সীমাবদ্ধ ছিল।'