দুই মাসের জন্য পৃথিবীর সঙ্গী হবে একটি নতুন চাঁদ; কী এই ‘মিনি-মুন’?

চলতি মাসেই পৃথিবী থেকে দেখা যাবে আরেকটি 'চাঁদ', তা-ও শুধু মাত্র দুই মাসের জন্য। তবে এটি আসলে চাঁদ নয়, বরং একটি গ্রহাণু।
জ্যোতির্বিদরা এই গ্রহাণুর আনুষ্ঠানিক নাম দিয়েছেন '২০২৪ পিটি৫'। গ্রহাণুটি খালি চোখে দেখা যাবে না, দেখতে হবে টেলিস্কোপের সাহায্যে।
মাত্র ১০ মিটার (৩৩ ফুট) ব্যাসের এই 'মিনি-মুন' পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে ডিসেম্বরের শেষ পর্যন্ত প্রায় দুই মাস ধরে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরবে। এ ধরনের গ্রহাণুর কক্ষপথে থাকার সময়কাল নির্ভর করে তাদের গতিবেগ এবং পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসার পথের ওপর।
মিনি-মুন আসলে কী?
মিনি-মুনের দেখা পাওয়াটা একটা বিরল ঘটনা। সাধারণত, প্রতি ১০ থেকে ২০ বছরে একবার গ্রহাণুগুলো পৃথিবীর কক্ষপথে প্রবেশ করে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরে বেশ কয়েকবার এদের দেখা মিলেছে। এগুলো পৃথিবী থেকে প্রায় ১০ হাজার কি.মি (৬,২০০ মাইল) উচ্চতায় থাকতে পারে।
মিনি-মুন গড়ে কয়েক মাস থেকে দুই বছর পর্যন্ত পৃথিবীর কক্ষপথে থাকে, পরে সেগুলো পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আবার মহাকাশে চলে যায়। এ গ্রহাণুগুলো সাধারণত ধাতব পদার্থ, কার্বন, মাটি এবং সিলিকেটের মিশ্রণে গঠিত।
২০১৮ সালে সুইজারল্যান্ডের ফ্রন্টিয়ার্স ইন অ্যাস্ট্রোনোমি অ্যান্ড স্পেস সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, বেশিরভাগ মিনি-মুন পৃথিবীর দিকে আসে মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহের মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত গ্রহাণুর স্তর থেকে।
পৃথিবীর স্থায়ী চাঁদের বিপরীতে, মিনি-চাঁদের কক্ষপথ স্থিতিশীল নয়। বরং, পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের কারণে এগুলো গ্রহাণুগুলোকে ক্রমাগত সামনে ও পিছনে টানতে থাকে, ফলে এগুলো একটি 'হর্সশু' (ঘোড়ার নালের আকৃতি) কক্ষপথে চলাচল করে।
এই কক্ষপথের অস্থিতিশীলতা গ্রহাণুগুলোকে ধীরে ধীরে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ থেকে দূরে সরতে সাহায্য করে। একবার যখন মিনি-মুনটি পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের প্রভাব মুক্ত হয়, তখন এটি আবার মহাকাশে ফিরে যায়।
২০০৬ সালের পর থেকে পৃথিবীর কক্ষপথে বেশ কয়েকটি মিনি-মুনের দেখা মিলেছে।
২০০৬ সালে ২০০৬ আরএইচ১২০ ছিল পৃথিবী থেকে চিহ্নিত করা প্রথম মিনি-মুন, যার ব্যাস প্রায় ২ থেকে ৪ মিটার। এটি প্রায় এক বছর ধরে পৃথিবীর কক্ষপথে ছিল এবং এটি একমাত্র মিনি-মুন, যার ছবি ধারণ করা সম্ভব হয়েছে। এর ছবি তোলার জন্য ব্যবহার হয়েছিল সাউদার্ন আফ্রিকান লার্জ টেলিস্কোপ (সল্ট)।

আর এই মিনি-মুনটিকে খুঁজে বের করেছিল ক্যাটালিনা স্কাই সার্ভে (সিএসএস) নামের একটি টেলিস্কোপ; যেটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনার টাক্সনে অবস্থিত। ১৯৯৮ সালে নাসা পৃথিবীর নিকটে আসা মহাজাগতিক বস্তুর সন্ধানের জন্য এই টেলিস্কোপটি বসায়।
২০২২ এনএক্স১ মিনি-মুনটির আকার প্রায় ৫ থেকে ১৫ মিটার। এটি প্রথম ১৯৮১ সালে দেখা যায় এবং সর্বশেষ ২০২২ সালে আবার চিহ্নিত হয়। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৫১ সালে এটিকে ফের পৃথিবীর 'হর্সশু' কক্ষপথে দেখা যাবে।
সর্বশেষ মিনি-মুন সম্পর্কে যা জানা গেল
বর্তমানে পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে যে গ্রহাণুটি, তার নাম ২০২৪ পিটি৫। এটি প্রথম দেখা গেছে ৭ আগস্ট। হাওয়াইয়ের মাউই দ্বীপের হালেআকালা অবজারভেটরিতে অবস্থিত নাসা'র অ্যাস্টেরয়েড টেরেস্ট্রিয়াল-ইম্প্যাক্ট লাস্ট অ্যালার্ট সিস্টেম (অ্যাটলাস) এটি শনাক্ত করে। মহাকাশ পর্যবেক্ষণ এবং পৃথিবীর নিকটবর্তী বস্তুগুলোকে শনাক্ত ও ট্র্যাক করার জন্য এই সিস্টেমটি ব্যবহার করা হয়।
মাদ্রিদের কমপ্লুটেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং গবেষণার সহ-লেখক রাউল দে লা ফুয়েন্তে মার্কোস বলেছেন, "যখনই পৃথিবীর মতো কক্ষপথের কোনো মহাজাগতিক বস্তু আবিষ্কার হয়, তখন এটির মহাকাশের আবর্জনা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।"
তবে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করেছেন যে ২০২৪ পিটি৫ কোনো আবর্জনা নয়, বরং একটি গ্রহাণু। এটি ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ২৫ নভেম্বরের মধ্যে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরবে এবং এরপর পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ থেকে মুক্ত হয়ে মহাকাশে চলে যাবে।
আর কী কী ধরনের 'মুন' আছে?
পৃথিবীর কক্ষপথ ঘুরতে থাকা আমাদের স্থায়ী চাঁদ বাদেও আরও কয়েক ধরনের চাঁদ (মুন) রয়েছে।
ঘোস্ট মুন
কর্ডাইলেভস্কি ক্লাউড নামে পরিচিত এই ঘোস্ট মুন হলো ধূলিকণার মিশ্রন, যা সাধারণত পৃথিবী-চাঁদ সিস্টেমের ল্যাগ্রাঞ্জিয়ান পয়েন্টগুলোতে পাওয়া যায়।
এই ল্যাগ্রাঞ্জিয়ান পয়েন্ট হলো মাধ্যাকর্ষণের 'সুইট স্পট', যেখানে পৃথিবী এবং চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি একসঙ্গে কাজ করে, ফলে ঘোস্ট মুনগুলো স্থিতিশীল অবস্থানে থাকতে পারে। এই ধুলোর মেঘগুলোর আকার ১ লাখ কি.মি পর্যন্ত হতে পারে।
১৯৬০ সালে পোলিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী কোর্ডাইলেভস্কি প্রথম এগুলো আবিষ্কার করেন। ২০১৮ সালে রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি দ্বারা এগুলোর অস্তিত্ব নিশ্চিত করা হয়।

কোয়াসি-মুন
কোয়াসি-মুন হলো এমন একটি মহাজাগতিক বস্তু, যা পৃথিবীর চারপাশে সূর্যের কক্ষপথে আবর্তিত হয়, তবে এটি নিজে পৃথিবীর কক্ষপথে ঘোরে না। বরং, কোয়াসি-মুন একটি পথ অনুসরণ করে যা সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর কক্ষপথের খুব কাছাকাছি থাকে, কিন্তু একেবারে মিলে যায় না।
২০১৬ সালে হাওয়াইতে অবস্থিত প্যান-স্টারস১ টেলিস্কোপের মাধ্যমে এইচও৩ নামক একটি কোয়াসি-মুন আবিষ্কার করা হয়। প্যান-স্টারস (প্যানোরামিক সার্ভে টেলিস্কোপ এবং র্যাপিড রেসপন্স সিস্টেম) পৃথিবীর নিকটে আসে বস্তু যেমন- গ্রহাণু বা ধূমকেতু শনাক্ত করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে।
২০১৬ এইচও৩-এর ব্যাস ১০০ থেকে ৩০০ মিটার এবং বিজ্ঞানীদের মতে, এটি শতাব্দীর পর শতাব্দী সূর্যের চারপাশে ঘুরতে থাকবে। এর আগে এটি কত সময় ধরে সূর্যের চারপাশে ঘুরছে তা অবশ্য জানা যায়নি।

অন্য মহাজাগতিক বস্তু, যেমন গ্রহ, চাঁদ এবং গ্রহাণু, কোয়াসি-মুন দ্বারা আবৃত হতে পারে। ভেনাস, বৃহস্পতি, শনি, নেপচুন এবং প্লুটোরও কোয়াসি-মুন রয়েছে, যেগুলো অবশেষে তাদের কক্ষপথ পরিবর্তন করে বেরিয়ে যাবে।
এমনকি গ্রহাণু সিরেস, যা বর্তমানে ধনুর্বিদ্যা নক্ষত্রমণ্ডলে রয়েছে এবং প্রায় ৯৪০ কি.মি (প্রায় ৫৮৪ মাইল) ব্যাসের একটি ডোয়ার্ফ প্ল্যানেট হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ, তারও একটি কোয়াসি-মুন আছে।
২০০২ সালের ১১ নভেম্বরে অ্যারিজোনার লোওয়েল অবজারভেটরিতে জ্যোতির্বিজ্ঞানী ব্রায়ান এ স্কিফ প্রথম কোয়াসি-মুন 'জুজুভে' আবিষ্কার করেন। এই গ্রহাণুর অনুমানিত ব্যাস প্রায় ২৩৬ মিটার (প্রায় ৭৭৫ ফুট)।
সৌভাগ্যবশত, এখন পর্যন্ত কোনো কোয়াসি-মুনের কক্ষপথ ত্যাগ করে পৃথিবীর কাছে আসার তথ্য নেই।
আমরা কি এই গ্রহাণুগুলো অধ্যয়ন করতে পারব?
হ্যাঁ। গ্রহাণু অধ্যয়নের জন্য চীনের টিয়ানওয়েন-২ মিশন ২০২৫ সালে চালু হওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এই মিশনের লক্ষ্য কোয়াসি-মুন গ্রহাণু ৪৬৯২১৯ কামোʻআলেওয়া থেকে নমুনা সংগ্রহ করা, যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৪০ থেকে ১০০ মিটার।
তবে, গ্রহাণুর নমুনা সংগ্রহের জন্য টিয়ানওয়েন-২ মিশনই একমাত্র প্রকল্প নয়।
২০০৯ সালের ৯ মে জাপানের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (জাক্সা) গ্রহাণু থেকে নমুনা সংগ্রহের প্রথম সফল মিশন পরিচালনা করে। মিশনটির নাম ছিল 'হায়াবুসা'।

২০০৫ সালের ১২ সেপ্টেম্বরে এই মিশনের একটি মহাকাশযান ৫৩৫-মিটার গ্রহাণু ২৫১৪৩ ইটোকাওয়ায় অবতরণ করে এবং ১৯ নভেম্বর ও ২৫ নভেম্বর সফলভাবে নমুনা সংগ্রহ করে। পরে এটি ২০১০ সালের ১৩ জুন পৃথিবীতে ফিরে আসে।
জাপান আরও কয়েকটি গ্রহাণু সংগ্রহের মিশন পরিচালনা করছে। ২০১৪ সালের ৩ ডিসেম্বর ৯০০-মিটার গ্রহাণু ১৬২১৭৩ রিউগু থেকে নমুনা সংগ্রহের উদ্দেশ্যে হায়াবুসা-২ মিশন শুরু হয়। ২০১৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এবং ১১ জুলাই-এ সফলভাবে গ্রহাণুটি থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। যানটি ২০২০ সালের ৬ ডিসেম্বর পৃথিবীতে ফিরে আসে।

পৃথিবীর নিকটবর্তী গ্রহাণু, ১০১৯৫৫ বেন্নু (৪৯২ মিটার) থেকে নমুনা সংগ্রহের উদ্দেশ্যে নাসা ২০১৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ওসিরিস-রেক্স নামের মিশন চালু করে। ২০১৮ সালের ৩ ডিসেম্বর ওসিরিস-রেক্স বেন্নুতে পৌঁছায় এবং ২০২০ সালের ২০ অক্টোবরে গ্রহাণুটি থেকে নমুনা সংগ্রহ করে। নমুনাগুলো নিয়ে ২০২৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর মহাকাশযানটি সফলভাবে পৃথিবীতে ফিরে আসে।
ওসিরিস-রেক্স পরবর্তী মিশন হিসেবে নাসা ওসিরিস-এপেক্স-এর নাম ঘোষণা করেছে। ২০২৯ সালে পৃথিবীর কাছাকাছি আসা অ্যাপোফিস গ্রহাণুকে অধ্যয়ন করবে এটি।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন