Skip to main content
  • মূলপাতা
  • অর্থনীতি
  • বাংলাদেশ
  • আন্তর্জাতিক
  • খেলা
  • বিনোদন
  • ফিচার
  • ইজেল
  • মতামত
  • অফবিট
  • সারাদেশ
  • চাকরি
  • প্রবাস
  • English
The Business Standard বাংলা

‘হাফ উইডো’: গুম দিয়েছে নতুন পরিচয়, সঙ্গে কষ্ট ও কান্না

খবর পেয়ে রীনা দৌড়ে হাসপাতালে যান, গিয়ে দেখেন মাহবুব একটা টুলের ওপর বসে আছেন। ঠিকমতো বসেও থাকতে পারছেন না। শরীর থেকে দরদর করে ঘাম ঝরছে। রীনাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘আমারে বাঁচাও।’...
‘হাফ উইডো’: গুম দিয়েছে নতুন পরিচয়, সঙ্গে কষ্ট ও কান্না

ফিচার

সালেহ শফিক & আসমা সুলতানা প্রভা
19 September, 2024, 03:40 pm
Last modified: 19 September, 2024, 03:41 pm

Related News

  • বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপ একসঙ্গে প্রকাশের আহ্বান এনসিপির
  • সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করলে দেশ বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়তে পারে: জামায়াতের আমির
  • দেশে আবারও বিভাজনের রাজনীতি শুরু হয়েছে: মির্জা ফখরুল
  • নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা নেই এনসিপির, পুনর্গঠন করে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবি; আজ কমিশনের সামনে বিক্ষোভ
  • বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আ.লীগকে নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায় বিএনপি: সালাহউদ্দিন

‘হাফ উইডো’: গুম দিয়েছে নতুন পরিচয়, সঙ্গে কষ্ট ও কান্না

খবর পেয়ে রীনা দৌড়ে হাসপাতালে যান, গিয়ে দেখেন মাহবুব একটা টুলের ওপর বসে আছেন। ঠিকমতো বসেও থাকতে পারছেন না। শরীর থেকে দরদর করে ঘাম ঝরছে। রীনাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘আমারে বাঁচাও।’...
সালেহ শফিক & আসমা সুলতানা প্রভা
19 September, 2024, 03:40 pm
Last modified: 19 September, 2024, 03:41 pm
বাবার ছবি হাতে সাফা। ছবি: আসমা সুলতানা প্রভা/টিবিএস

পারভেজ যখন গুম হন, ফারজানা তখন চার মাসের গর্ভবতী। প্রেমের বিয়ে তাদের। ইসলামপুরে পারভেজের ছিল কাপড়ের ব্যবসা। আড়াই বছরের মেয়ে হৃদিকে নিয়ে তাদের ছিল মায়ার সংসার। ২০০৮ সালে বিয়ের পর থেকে তারা ঘর বেঁধেছিলেন ফারজানার মায়ের বাসা মাতুয়াইলে। বিএনপির রাজনীতি পছন্দ করতেন পারভেজ হোসেন। দিনে-দিনে তার সক্রিয়তাও বেড়েছিল। ফারজানা এ নিয়ে কখনো উচ্চবাচ্য করতেন না। ভাবতেন, রাজনীতি করা তো খারাপ কিছু নয়। সংসারের প্রতি টান ছিল পারভেজের; ফারজানা গর্ভবতী বলে নিয়মিত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতেন, হৃদির সব প্রয়োজন মেটাতেন।

গুমের ঘটনাটা ঘটেছিল ২০১৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর। পারভেজ তার রাজনৈতিক সহকর্মীদের সঙ্গে গিয়েছিলেন শাহবাগ। সেখান থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে সাদা পোশাকধারী লোকেরা পারভেজ ও তার তিন সঙ্গীকে গাড়িতে উঠিয়ে ডিবি অফিসের দিকে নিয়ে যান। মাগরিবের নামাজের পর পারভেজকে ফোনে ধরার চেষ্টা করে বন্ধ পান ফারজানা। কিছুক্ষণ পরে পরিচিত একজনের বরাতে জানতে পারেন, পারভেজ গ্রেপ্তার হয়েছেন। সে রাতে ফারজানা আর বের হননি। কিন্তু সঙ্গের আরও যারা গ্রেপ্তার হয়েছে, তাদের পরিবার রাতেই খোঁজখবর করতে থাকে। তখনো গুম শব্দটা বেশি চেনা ছিল না। পরিবারগুলো ভেবেছিল সামনে নির্বাচন [২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন], তাই ধরপাকড় চলছে। শীঘ্রই মানুষগুলো ছাড়া পাবেন।

বাবাকে সঙ্গে নিয়ে ফারজানা পরদিন ডিবি অফিসে যান। তাতে বেশ একটা লাভ হলো না। একরকম দূর-দূর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয় তাদেরকে। বলা হয়, 'এমন কোনো লোক এখানে নেই, এমন কাউকে চিনিও না।' তারপর ১০ দিন কোর্টে গেছেন, হাজতিদের গাড়ি থামলেই দৌড়ে গিয়ে খোঁজ করতেন, পারভেজ নামে কেউ আছে কি না। অনেক হয়রানির শেষে ১২ দিন পরে একটি জিডি করাতে পারেন, নিখোঁজ জিডি। সেদিনই ফারজানা আঁচ করতে পেরেছিলেন, দুঃখের সাগর সামনে। খোঁজ থাকলে খবর করা যায়, কিন্তু যার খোঁজই নেই তাকে নিয়ে কী করা যায়! পুলিশ, র‍‍্যাব, ডিবি — কেউ স্বীকার করছে না মানুষটা তাদের কাছে আছে। এখন তাহলে ফারজানা কী করবেন? কান্নাই তার সঙ্গী হয়ে গেল। এর মধ্যে গর্ভে থাকা সন্তান পৃথিবীর আলো দেখল। ফারজানা ছেলের নাম রাখলেন আরাফ। মায়ের কান্নায় ভিজে আরাফ বড় হতে থাকল, কিন্তু বাবা (পারভেজ) তো ফেরেন না।

২০১৬ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন ফারজানার বাবা, তিনি চালিয়েছেন। ২০২০ সালে মা জানালেন, তিনি আর পারছেন না। ফারজানা এখন আশ্রয় নিয়েছেন ছোট বোনের সংসারে। বললেন, 'কাউকে বলে বোঝানো যাবে না ছোটবোনের সংসারে থাকা কতটা লজ্জার আর কষ্টের। ছেলে-মেয়েরা কোনো আবদার করে না। ওরা জানে, আবদার মেটানোর সামর্থ্য তাদের মায়ের নেই। আরাফ কিছুদিন আগে রোলার স্কেটিং কেনার কথা বলেছিল, পরে আবার নিজেই চুপ হয়ে গেছে।' শাশুড়ির সঙ্গে কালেভদ্রে ফারজানার যোগাযোগ হয় বৈকি। কিন্তু দেবররা কোনো খবরই নেন না।

'সাফা, তোমার বাবা কোথায়?'

পারভেজের বন্ধু ছিলেন মাহফুজুর রহমান সোহেল। সোহেল বংশাল থানা বিএনপির সহসভাপতি। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে তার মেয়ে সাফার বয়স ছিল তিন মাস মাত্র। নিজেদের ছোট একটি বাড়ি আর বাড়ির নীচতলায় একটা দোকানের ভাড়ায় চলত তাদের সংসার। সুখে-শান্তিতেই দিন কাটছিল তাদের। তবে তা টেকেনি বেশিদিন।

ছবি: আসমা সুলতানা প্রভা/টিবিএস

পারভেজের সঙ্গে আরও যে তিনজন নিখোঁজ হন, তাদের মধ্যে সোহেল একজন। সাফার বড় ভাই তখন ক্লাস সিক্সের ছাত্র। সাদা পোশাকধারীরা ধরে নিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়ার পরই সাফার দাদা ও ছোট চাচা দৌড়ে শাহবাগ যান। কিন্তু সেখানে গিয়ে পেলেন না তাকে। তারপর থেকে কোতোয়ালি থানা, বংশাল থানা, শাহবাগ থানায় শুরু হয় তাদের ছোটাছুটি। কোথাও কোনো উত্তর নেই। কেউ কিছুই জানেন না। দিনের পর দিন যায়, বছরের পর বছর, সোহেল আর ফেরেন না।

এখন সাফার বড় ভাইয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময় হয়েছে। দাদী তাদের মাসখরচ বাবদ কিছু টাকা দেন। অন্যদিকে চাচারা বাজার থেকে যা আনেন, তার কিছু অংশ তাদের দেন। থাকার জন্য একটা রুম বরাদ্দ হয়েছে সাফার মায়ের জন্য। সেখানেই থাকেন তিনজন। এর মধ্যে গত হয়েছেন সাফার দাদা। সাফাকে কেউ যখন জিজ্ঞেস করে, 'তোমার বাবা কোথায়?' সাফা চুপ করে থাকে। হাতে তার বাবা সোহেলের ছবি। বাবা এখন দেখতে কেমন সেটাও সে জানে না হয়তো। বা কখনো যদি দেখা হয়ে যায়, চেনবে কি না কে জানে!

তবে বাবার হাত ধরে স্কুলে যেতে না পারার বুকভরা আক্ষেপ তার। কী যেন বলতে গিয়ে থেমে গেল। খানিক পরে মলিন কণ্ঠে বলেই বসল, 'সবাই তাদের বাবার সঙ্গে স্কুলে যায়, বাবার মোটর সাইকেলে চড়ে। আমি কখনো বাবাকে দেখিনি। বাবা থাকলে আমাকেও স্কুলে নিয়ে যেত। আমরা ঘুরে বেড়াতাম। কত কিছু কিনে দিত বাবা আমাকে।'

মায়ের ডাক-এর সঙ্গে তাদের যোগাযোগ প্রায় ১০ বছর। যখন কোথাও কিছু হচ্ছিল না, কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না, জানা যাচ্ছিল না বেঁচে আছে কি মরে গেছে, তখন মায়ের ডাক তাদের সহায় হয়ে দেখা দিলো। গুম হওয়া মানুষের পরিবারগুলোর প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠলো মায়ের ডাক। সাজেদুল ইসলাম সুমনের মা হাজেরা খাতুন আরও সাতজন নিখোঁজ সন্তানের মাকে নিয়ে প্রথম মায়ের ডাক গড়ে তুলেছিলেন ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর।

তারা 'হাফ উইডো' বা আধা বিধবা

ঢাকার উত্তরা থেকে সুমন ছয়সঙ্গীসহ নিখোঁজ হন ২০১৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর। পরে সুমনদের এলাকা শাহীনবাগ থেকে আরও ২ জনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। নির্বাচনের আগে পর্যন্ত মায়েরা ভাবছিলেন নির্বাচনের পরে পরিস্থিতি শান্ত হলে ছেলেরা ফিরে আসবে। কিন্তু দিন যায়, ছেলেরা আসে না, মায়েদের অপেক্ষা বাড়তে থাকে। সে সময়ে হাজেরা খাতুন মায়ের ডাক নামক প্ল্যাটফর্মটি থেকে একটি সংবাদ সম্মেলন ডাকেন। তখন গণমাধ্যমের ওপর সেন্সরশিপ ছিল, খুব বেশি মিডিয়া খবর ছাপেনি, তবুও গুমের খবর চাউর হয়ে যায়। পরে আগস্ট মাসে মায়ের ডাক আরেকটি সভার ডাক দেয়; সারাদেশ থেকে প্রায় ১০০টি পরিবার এসে হাজির হয় যা ছিল চমকে দেওয়ার মতো ঘটনা।

ছবি: আসমা সুলতানা প্রভা/টিবিএস

মায়ের ডাকের বর্তমান সমন্বয়ক সুমনের বোন সানজিদা ইসলাম তুলি। তিনি বলছিলেন, "আসলে পরিবারগুলোর দাঁড়ানোর কোনো জায়গা ছিল না, কোথাও গিয়ে তারা কথা বলতে পারছিল না। পুলিশ এসে মাঝেমধ্যেই হ্যারাস [হয়রানি] করত। সরকারের উচ্চতর পর্যায় থেকে হাসি-ঠাট্টা করে বলত, 'দ্যাখো গিয়ে নতুন বিয়ে করে কোথাও লুকিয়ে আছে কি না।'"

অথচ মানসিক যন্ত্রণার সঙ্গে দারিদ্র্য মিলে তাদের জীবন হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। তাই মায়ের ডাক যখন গড়ে উঠল, তারা একটা জায়গা পেল নিজেদের কথাগুলো জানানোর। "প্রতিবছর আমরা মানববন্ধনসহ ৫-৬টা বড় বড় আয়োজন করে থাকি। আমরা জানতে চাই, আমাদের স্বজনেরা কোথায় আছে। বেঁচে আছে না মরে গেছে? যাদের স্বামী গুম হয়েছে তাদেরকে এখন ডাকা হচ্ছে 'হাফ উইডো' বলে। এটা একটা মারাত্মক পরিচয় সংকট। এ পরিচয় নিয়ে মানুষগুলো দাঁড়াবে কোথায়, পারবে তাদের প্রাপ্য বুঝে নিতে?" বলেন তুলি।

পড়শিরাও এড়িয়ে চলে

পড়শিরাও এ পরিবারগুলোর সঙ্গ এড়িয়ে চলে। এর কারণ রাষ্ট্র তাদের প্রতিপক্ষ বলে ভাবে। মাসে-মাসে পুলিশ এসে তল্লাশির নামে তাদের ঘরবাড়ি তছনছ করত। বলত, 'দেখে গেলাম ঘরেই কোথাও লুকিয়ে আছে কি-না।' এ কারণে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা নিরাপদ ভাবে না কেউ।

চৌধুরী আলমের বড় ছেলে আবু সাঈদ চৌধুরী। তার বাবার গুমের ঘটনার পরপরই বাদী হয়ে মামলা করেন। সে মামলার সূত্র ধরে নানাভাবে হয়রানির মধ্য দিয়ে যায় পুরো পরিবার। তিনি যেমনটা বলছিলেন, 'যে যেভাবে পেরেছে আমাদের হুমকি ধামকি করেছে। রোজই আমরা কোনো না কোনোভাবে হয়রানির শিকার হয়েছি। কখনো পোশাকধারী, কখনো সাদা পোশাকের মানুষ এসে হুমকি দিয়ে গেছেন। তারা আসলে কে, কোন সংস্থার সেটাও আমরা কখনো বুঝতে পারিনি। শুধু বলত আমরা সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে বলছি। গত ১৫-১৬ বছর ধরেই এমনটা হয়েছে আমাদের সঙ্গে। আরও বলত, মামলা-টামলায় যাবেন না। শান্তিতে আছেন, শান্তিতে থাকেন।'

ফোন কলেও দেওয়া হতো জীবননাশের হুমকি

মাঝেমধ্যেই পুলিশ এসে তল্লাশির নামে পুরো ঘর এলোমেলো করে উল্টো হুমকি দিত। এভাবে প্রায়ই তারা আসত, বলত, 'কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন বলে দিন, নইলে সমস্যা হবে।' পোশাকধারী বা সাদা পোশাকের লোকেদের মুখের ভাষাও ছিল অপ্রীতিকর। এখানেই শেষ নয়! ফোন কলেও জীবননাশের হুমকি দেওয়া হতো বলে অভিযোগ করেছেন অনেক ভুক্তভোগী। বিভিন্ন নম্বর থেকে বিভিন্ন আওয়াজে মামলা করতে নিষেধ করা হতো। সঙ্গে মেরে ফেলার হুমকি তো আছেই।

এদের কেউই নিজেদের পরিচয় খোলাসা করেননি তাদের কাছে। শুধু বলতেন, 'ওপর থেকে নির্দেশ আছে।' এভাবে শঙ্কায়, আতঙ্কে কেটেছে ১৫টি বছর। এখন পট পাল্টেছে, সরকার পাল্টেছে, তবুও মানসিক যন্ত্রণা যেন পিছু ছাড়ে না ভুক্তভোগীদের। এখনো অশ্রুসিক্ত নয়নে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এ দ্বার থেকে ও দ্বারে। আশা বেঁধেছেন, একদিন ঠিক গুমের বিচার পাবেন।

ছবি: আসমা সুলতানা প্রভা/টিবিএস

চৌধুরী আলম ছিলেন ঢাকার ৫৬ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। তার বড় মেয়ে মাহমুদা আক্তার ছিলেন বাবার খুব ন্যাওটা। বিয়ে হওয়ার পরও বাবার বাড়িতেই থাকতেন। বাবার ফিরতে যেদিন বেশি রাত হতো সেদিনও কান খাড়া করে থাকতেন, গাড়ির শব্দ শুনে বা হাক-ডাক শুনে বুঝতেন বাবা ফিরেছেন। ২০১০ সালে আলম সাহেব গুম হন। বিগত শাসনামলের প্রথম গুম হওয়া ব্যক্তি বলে তাকে ধরা হয়। তার নিজের গাড়ি থেকে বের করে নিয়ে গুম করা হয় তাকে। এরপর থেকে গত প্রায় দেড় যুগে এমন কোনো দিন নেই মাহমুদা কান্না করেননি। এমনকি আমাদের সঙ্গে কথা বলার সময়ও তিনি অঝোরে কাঁদছিলেন। তার চোখ থেকে ঝরে পড়া প্রতিটি অশ্রবিন্দু জানান দিচ্ছিল, ঠিক কতটা কষ্ট পুষে রেখেছেন মনে!

মুন্না নামে কেউ কি আছে?

ঢাকা জাতীয় জাদুঘরে মোশফিকুর রহমান জোহানের 'গুম: জান ও জবান' শীর্ষক আলোকচিত্র প্রদর্শনীর শেষদিনের পরের দিন, অর্থাৎ ১১ সেপ্টেম্বর, জড়ো হয়েছিল গুমের শিকার পরিবারগুলো। চৌধুরী আলমের বড় মেয়ে মাহমুদা আক্তার, আরাফের মা, সোহেলের স্ত্রীসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল সেদিন।

নিজামউদ্দিন মুন্নার মা যেমন আরেকজন। ঘুমের ওষুধ না খেয়ে তিনি ঘুমাতে পারেন না। মাঝে মনোরোগ চিকিৎসকও দেখাতে হয়েছে। ছেলে ফিরে আসার অপেক্ষায় থেকে থেকে মুন্নার বাবা পরলোকে গমন করেছেন। কমপক্ষে ২৫টি জেলায় গিয়েছেন মুন্নার বাবা। যখন যেখান থেকে জানা যেত এমন একজনকে দেখা গেছে, মুন্নার বাবা সব কাজ ফেলে ছুটে যেতেন আর ফিরতেন একরাশ হতাশা নিয়ে। বিশের অধিক জেলখানায় তিনি মাইকিং করিয়েছিলেন এ বলে যে, এখানে নিজামউদ্দিন মুন্না নামে কেউ কি আছেন? যদি থেকে থাকেন তবে তার পিতা জেলেগেটে অপেক্ষা করছেন। কিন্তু সে অপেক্ষা কেবল অপেক্ষাই থেকে গেল। কখনো কোনো উত্তর আসেনি।

একবার অল্পের জন্য খুব ভয়ংকর ঘটনা ঘটার হাত থেকে বেঁচে গেছেন। চুয়াডাঙ্গার সীমান্তবর্তী এক জায়গা থেকে খবর এসেছিল, মুন্নাকে দেখা গেছে। নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে নির্দিষ্ট ব্যক্তির ফোন বন্ধ পেলেন। পরে চুয়াডাঙা সদরের এক নেতাকে ফোনে বিষয়টি জানালে তিনি অতিসত্বর শহরে ফিরে আসতে বলেন, সতর্ক করে দেন: 'ওইটা ভয়ংকর জায়গা, সীমান্তের খুব কাছে, আপনাকেও গুম করে ফেলতে পারে।'

মুন্না নিখোঁজ হয়েছিল ২০১৩ সালের ৬ ডিসেম্বর। তারপর থেকে র‍‍্যাব, ডিবি অফিস, থানায় পরিবারটি খোঁজ নিতে থাকে। সন্ধান মেলে না কোথাও। সবারই এক উত্তর, 'মুন্না নামের কেউ নেই।' গুম হওয়ার তিনদিন পর পুলিশ প্রথম জিডি নেয়, নিখোঁজ জিডি। সে থেকে মুন্নার মা গভীর রাতে জায়নামাজে বসে নিরালায় কাঁদেন। তার মনে হয় মুন্না ফিরবে, মা বলে ডাকবে একদিন। মুন্নার ভাই বললেন, 'মেরে ফেললে সেটাও বলুক, কোথায় কবর দিয়েছে দেখতাম। হাড়-গোড় ধরে কান্নাকাটি করতাম। একটা কোনো ফয়সালা হতো। এখন তো কিছুই হচ্ছে না।'

ছবি: আসমা সুলতানা প্রভা/টিবিএস

১১ সেপ্টেম্বর [২০২৪] গুম পরিবারের সদস্যদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা পরিবেশকে কেমন যেন ভারী করে তুলেছিল। উপস্থিত সকলেরই মনে হয়েছে যদি আমার পরিবারে এমনটি ঘটত তাহলে কী হতো!

২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাস। রেহানা বানু মুন্নীর ভাই সেলিম রেজা পিন্টুও গুম হয়েছেন। তারা থাকেন ঢাকার সূত্রাপুরে। কিন্তু পরিস্থিতি প্রতিকূল দেখে ভাইকে মীরপুরের পল্লবীতে আরেক ভাইয়ের বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ১১ ডিসেম্বর মাঝরাত ছিল সেদিন। কনকনে শীতের রাত। পিন্টু ঘুমাচ্ছিলেন। ঘুম থেকে উঠিয়ে তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পরদিন ডিবি অফিসে গিয়েছিলেন মুন্নীরা, পল্লবী থানাতেও গেছেন। তারপর গেছেন মানবাধিকার কমিশনে। কোথাও কোনো উত্তর পাননি।

পিন্টুর বাবা আশা করে থাকতেন, এই বুঝি ছেলে ফিরবে। সিথানে বাড়ির চাবির গোছা নিয়ে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ভাবতেন, এই বুঝি তার ছেলে এসে দরজায় কড়া নাড়বে। ছেলের শোকে এতটাই কাতর ছিলেন, মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন এক পর্যায়ে। বলতেন, 'আমার পিন্টুকে এনে দে, নইলে সবকিছু ভেঙে ফেলব।' মুন্নী বলছিলেন, 'গত ১০-১১ বছর আমাদের ঈদ যে কীভাবে যায়, কোনো স্বাদ পাই না। আমরা অসহায় হয়ে গেছি। কোথাও গিয়ে কোনো উত্তর পাই না, এতগুলো জলজ্যান্ত মানুষ হারিয়ে গেল, কারোর কোনো মাথাব্যথা নেই। বরং যেন আমরাই অপরাধী।'

ইনফরমার দেখে ফেলেছিল

স্বামীর ছবি বুকের কাছে নিয়ে বসেছিলেন পাপিয়া আক্তার রীনা। পরম যত্নে হাতও বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। ছবিটিতে বেগম খালেদা জিয়া, ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং সাদেক হোসেন খোকাও আছেন। তার স্বামীর নাম ছিল আনোয়ার হোসেন মাহবুব। তিনি ঠিক গুম হননি। কিন্তু তাকে মেরে ফেলা হয়, এমনটাই দাবি রীনার। তাই তিনি এসেছেন বিচার চাইতে। তার চোখের সামনেই হত্যা করা হয় স্বামীকে বলে জানান তিনি।

সময়টা ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। এর আগে ২০১২ সালেও একবার মাহবুবকে গ্রেপ্তার করা হয়। তখন চোখ বেঁধে কাঁচপুর ব্রিজে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আর ভয় দেখানো হয়েছিল, পানিতে ফেলে দিয়ে মেরে ফেলা হবে। সে বার বেঁচে ফিরলেও পরে আর পারেননি।

ছবি: আসমা সুলতানা প্রভা/টিবিএস

২০১৫ সালের শেষদিকের কথা। থাকতেন লালবাগে। তার নিজের এই এলাকায় থাকা কঠিন হয়ে উঠেছিল সে সময়। বাধ্য হয়ে ধানমন্ডিতে একটি বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন। স্ত্রী লুকিয়ে লুকিয়ে গিয়ে দেখা করে আসতেন। এজন্য রিকশা বদল করতেন তিনবার। ২০১৬ সালের যেদিন তিনি গ্রেপ্তার হলেন, সেদিন হঠাৎই লালবাগ এসেছিলেন ছয় বছরের মেয়েকে একনজর দেখতে। দুপুরের দিকে এসেছিলেন লুকিয়ে। কিন্তু ভাগ্য সহায় ছিলো না সেদিন। স্থানীয় ইনফরমার দেখে ফেলেছিল। পুলিশ বিকালে তাকে গ্রেপ্তার করে। রিমান্ড দেওয়া হয়। শেষ রিমান্ডের দিন দুপুর ৩টা পর্যন্ত রীনা জেলগেটে স্বামীর সঙ্গেই ছিলেন। পরে মেয়ের কথা ভেবে বাসায় আসেন। রাত আটটায় একজন পুলিশ তাকে ফোন দিয়ে বলে, 'আপনি কি রীনা? আপনার স্বামী ঢাকা মেডিক্যালে আছে।'

খবর পেয়ে রীনা দৌড়ে হাসপাতালে যান, গিয়ে দেখেন মাহবুব একটা টুলের ওপর বসে আছেন। ঠিকমতো বসেও থাকতে পারছেন না। শরীর থেকে দরদর করে ঘাম ঝরছে। রীনাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, 'আমারে বাঁচাও।'

পুলিশের কাছে গিয়ে খুব কান্নাকাটি করেন রীনা। বলেন, 'তাকে ভর্তি করুন, খরচ সব আমি দেব।' রীনা তাদের ২০ হাজার টাকা দেন। মাহবুবকে ভর্তি করানো হয় হাসপাতালে। কিন্তু তাকে বেডে তোলা হয়নি, আর ডান্ডাবেড়ি পরানোই ছিল। ওয়াশরুমে যেতেও পারতেন না ঠিকমতো। ৪ দিন মেঝেতে থাকার পর আবার হাতে পায়ে ধরে রীনা একটি বেড জোগাড় করেন। তবে রীনাকে সবসময় কাছে যেতে দেওয়া হতো না। এরমধ্যে শুরু হয় মাহবুবের রক্তবমি। রীনা প্রতিবার ২০০ টাকা দিলেই কেবল তাকে সেগুলো পরিষ্কার করার সুযোগ দেওয়া হতো।

রীনা জিজ্ঞেস করতেন, 'তোমাকে আমি ভালো অবস্থায় রেখে আসছিলাম, হঠাৎ কী হইল?' মাহবুব বলেছেন, 'রিমান্ডের নাম করে চারজন লোক আসে, চোখ বেঁধে ফেলে, তারপর ইচ্ছামতো পেটায়, বুকের ওপর উঠে লাফায়, এরপর আর কিছু মনে নেই।'

চতুর্থ দিন বিকাল নাগাদ মাহবুব মারা যান রীনার চোখের সামনে।

পুলিশ যাবতীয় ডকুমেন্ট বগলদাবা করে নিয়ে চলে যায়। লাশ পরে হস্তান্তর করে। রীনা তার স্বামীর মৃত্যুর দৃশ্য কোনোদিন ভুলতে পারেননি। মায়ের ডাক যখনই কোনো কর্মসূচি দেয় ছবিটি নিয়ে চলে আসেন। তিনি স্বামী হত্যার বিচার চান।

গুম হওয়া ব্যক্তির যে তালিকা করা হয়েছে, তাতে ৭০০ জনের নাম পাওয়া যায়। তবে সানজিদা ইসলাম তুলি বললেন, 'সংখ্যাটি এরচেয়ে অনেক বেশিই হবে। আজকে যখন অন্তবর্তীকালীন সরকারের এক মাস পার হয়ে গেছে, তখন আমরা আরও ভীত হয়ে উঠেছি। এ এক মাসের মধ্যেও যখন গুম হওয়া মানুষগুলোর কোনো হদিস মিলছে না, তখন শঙ্কা আরও বেশি জেঁকে বসছে।'

তাহলে ২০১০, ২০১৩ বা ২০১৬ সালের স্মৃতিই কি শেষ পর্যন্ত বয়ে বেড়াতে হবে রীনা-তুলি-ফারজানাদের?

Related Topics

টপ নিউজ

গুম / গুমের শিকার / রাজনীতি / নিখোঁজ

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.

MOST VIEWED

  • সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে সচিবালয়ে কর্মচারীদের বিক্ষোভ
  • আগস্টের মধ্যে ই-স্কুটার ও ই-বাইক বাজারে আনছে রাষ্ট্রায়ত্ত অ্যাটলাস বাংলাদেশ
  • বনানীতে ট্রাকচাপায় ২ মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
  • অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঘোষণার পর অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি প্রত্যাহার এনবিআর কর্মকর্তাদের
  • দেশের প্রথম ভ্যাকসিন প্ল্যান্ট গোপালগঞ্জ থেকে মুন্সিগঞ্জে স্থানান্তরের পরিকল্পনা সরকারের

Related News

  • বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপ একসঙ্গে প্রকাশের আহ্বান এনসিপির
  • সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করলে দেশ বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়তে পারে: জামায়াতের আমির
  • দেশে আবারও বিভাজনের রাজনীতি শুরু হয়েছে: মির্জা ফখরুল
  • নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা নেই এনসিপির, পুনর্গঠন করে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবি; আজ কমিশনের সামনে বিক্ষোভ
  • বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আ.লীগকে নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায় বিএনপি: সালাহউদ্দিন

Most Read

1
বাংলাদেশ

সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে সচিবালয়ে কর্মচারীদের বিক্ষোভ

2
বাংলাদেশ

আগস্টের মধ্যে ই-স্কুটার ও ই-বাইক বাজারে আনছে রাষ্ট্রায়ত্ত অ্যাটলাস বাংলাদেশ

3
বাংলাদেশ

বনানীতে ট্রাকচাপায় ২ মোটরসাইকেল আরোহী নিহত

4
অর্থনীতি

অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঘোষণার পর অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি প্রত্যাহার এনবিআর কর্মকর্তাদের

5
বাংলাদেশ

দেশের প্রথম ভ্যাকসিন প্ল্যান্ট গোপালগঞ্জ থেকে মুন্সিগঞ্জে স্থানান্তরের পরিকল্পনা সরকারের

The Business Standard
Top

Contact Us

The Business Standard

Main Office -4/A, Eskaton Garden, Dhaka- 1000

Phone: +8801847 416158 - 59

Send Opinion articles to - oped.tbs@gmail.com

For advertisement- sales@tbsnews.net

Copyright © 2022 THE BUSINESS STANDARD All rights reserved. Technical Partner: RSI Lab