মেট্রোরেল প্রকল্পে এডিস মশা ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ পর্যায়ে

মিরপুর ১১ নম্বরের বাসিন্দা রিনা আলমের বাসার সামনেই চলছে মেট্রোরেলের কাজ। তীব্র গরমের মধ্যেও তাদের বাসার জানালা বন্ধ রাখতে হয়, কারণ মশা। এডিস মশার কামড় থেকে বাঁচতে মশারি ব্যবহার, বাসার টব সব সময় পরিস্কার রাখাসহ সব ধরণের সতর্কতা অবলম্বন করলেও শেষ রক্ষা হয়নি। ঈদের আগের দিন থেকে ডেঙ্গুতে ভুগছেন রিনা আলম। এর আগের বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলো তার মেয়ে রিয়া।
রিনা আলমের মতই ডেঙ্গুতে ভুগছেন বা এডিস মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ মেট্রোরেল প্রকল্পের আশেপাশের বাসিন্দারা। মেট্রোরেল প্রকল্পে এডিস মশার উপস্থিতি ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে বলে উঠে এসেছে সরকারের জরিপেও।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার এক জরিপে দেখা গেছে, মেট্রোরেল প্রকল্পে এডিস মশার উপস্থিতি ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ। যা ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমণের সহায়ক।
মশা পরিমাপের সূচক ‘ব্রুটো ইনডেক্স’ নামে পরিচিত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা ৩১ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট রাজধানীর ১৪টি স্থানে মশা জরিপ করেছিল। এর মধ্যে ১২টি স্থানেই ‘ব্রুটো ইনডেক্স’ ২০ এর বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার কীটতত্ববিদ খলিলুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, “একটি এলাকায় ২০ শতাংশের বেশি পাত্রে ব্রুটো ইনডেক্স পাওয়া গেলে পরিস্থিতি ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়। মেট্রোরেল প্রকল্পে ৪০ থেকে ৬০ শতাংশের মত লার্ভার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।”
উত্তরা থেকে পল্লবী, আগারগাঁও, ফার্মগেট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের কাজ চলছে। রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা মিরপুর-১২তে মেট্রোরেল প্রকল্প এলাকায় মশা জরিপ করেছে। প্রকল্প এলাকাকে তারা এডিস মশার ঝুঁকিপূর্ণের তালিকায় রেখেছে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, মেট্রোরেলের মত বড় উন্নয়ন প্রকল্পগুলো এডিস মশার অন্যতম উৎপত্তিস্থল। স্থানীয়রাও জানিয়েছেন, মেট্রোরেলের জমে থাকা পানিতে সিটি করপোরেশন কিংবা মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ কেউ ওষুধ ছিটায় না।
২৫ বছর ধরে মিরপুরের পল্লবী এলাকায় থাকেন ফাহিমা করিম পুষ্পিতা। তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, “আমাদের এলাকায় আগে মশার উপদ্রব কম থাকলেও এখন তা বেড়েছে। মেট্রোরেলের গর্তে সব সময় পানি জমে থাকে। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে গলিতে মশার ওষুধ ছিটাতে দেখা গেলেও মেট্রোরেলের জমে থাকা পানি পরিস্কার বা সেখানে ওষুধ ছিটাতে দেখা যায়নি।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, “যেখানেই পানি জমবে সেখানেই এডিস মশা জন্মাবে। মেট্রোরেলে যে পানি জমে সেটি ঠেকানো কঠিন। যে গর্তগুলোতে পানি জমে সেগুলো বন্ধ করা যাবে না, কারণ নির্মাণকাজ চলছে। সে কারণে গর্তগুলোতে কীটনাশক ও ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে এডিস মশার উৎপত্তি বন্ধ করতে হবে। এটি যদি অব্যাহত রাখে তাহলে আগামী বছর পরিস্থিতি খারাপ হবে না।”
সম্প্রতি ঢাকায় এসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ কীটতত্ত্ব বিএন নাগপাল বলেছেন, এডিস মশা স্বচ্ছ পানিতে জন্মায়। নির্মাণ প্রকল্প এডিস মশার লার্ভার বড় উৎস। নির্মাণ প্রকল্পে এডিসের প্রজননস্থল ধ্বংস করলে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ৪০% কমানো সম্ভব। নির্মাণ প্রকল্পগুলোতে যেনো পানি না জমে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো সচেতন না হলে সিটি করপোরেশনের উচিৎ তাদের শাস্তির আওতায় আনা।
মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকারি প্রতিষ্ঠান ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। মশার লার্ভার ঝুঁকিপূর্ণ তালিকা সম্পর্কে জানতে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন সিদ্দিকের সঙ্গে যোগাযোগ করেও পাওয়া যায়নি।
রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা বছরে তিনবার মশা জরিপ করে। বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে, বর্ষার সময় ও মৌসুম শেষে। এ বছর মার্চে প্রথম জরিপ করে তারা বলেছিল, বর্ষার সময় মশা বাড়বে, সঙ্গে ডেঙ্গুর ঝুঁকিও বাড়বে। এর পরের নিয়মিত জরিপ করে ১৭-২৭ জুলাই। তাতে দেখা যায়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে মশা প্রায় ১৪ গুণ বেড়ে গেছে। এই সময়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। তখনই রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা এই অতিরিক্ত জরিপের সিদ্ধান্ত নেয়।
জরিপে দেখা গেছে, কালশী ইসিবি চত্বর ও ভাষানটেক বস্তির ২০ শতাংশের কম পাত্রে লার্ভা পাওয়া গেছে। এই দুটি এলাকাকে কম ঝুঁকিপূর্ণ বলছে রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা।