বিচার বিভাগের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের সমঝোতা: কর্ণাটকে বিজেপির পরাজয় কি নেপথ্যে কারণ?

ভারতের বিচার বিভাগের এক অবিশ্বাস্য বিজয় অর্জিত হয়েছে বলেই আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে। ভারতের বর্তমান সরকার দেশটির জন্মলগ্ন থেকে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগের প্রচলিত নিয়মবিধি পাল্টে দিয়ে সংবিধানের যে ৯৯তম সংশোধনের মাধ্যমে বিচারক নিয়োগের নতুন আইন তৈরি করেছিল, তা মেনে নেয়নি ভারতের সুপ্রিম কোর্ট।
সংশোধনীর বিষয়বস্তু ছিল, ভারতীয় হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের প্রতিনিধিত্ব। প্রচলিত নিয়ম অনুসারে, সুপ্রিম কোর্ট কলেজিয়াম (প্রধান বিচারপতিসহ সুপ্রিম কোর্টের অপর তিন জ্যৈষ্ঠ বিচারপতি) সিস্টেমে বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়। দীর্ঘকালের প্রচলিত এই নিয়ম নিয়ে নানান ধরনের আলোচনা-সমালোচনার কারণে নির্বাহী বিভাগ বিচারক নিয়োগের বিষয়ে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব সৃষ্টির জন্য সংবিধানের ৯৯তম সংশোধনী প্রণয়ন করে। কিন্তু ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এই সংশোধনী বাতিল করে দেয়। বাতিল করার পরে অপসারিত আইন মন্ত্রী কিরেন রিজিজু প্রকাশ্যই সুপ্রিম কোর্টের সমালোচনা করতে থাকেন। সুপ্রিম কোর্ট এক পর্যায়ে আইনমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে তীব্র ভর্ৎসনা করেন এবং সুপ্রিম কোর্ট প্রকাশ্যেই বলেন, ভবিষ্যতে যদি এই ধরনের কথাবার্তা বলা হয় তাহলে আমরা আদালত অবমাননার অভিযোগ আনতে বাধ্য হব।
এই ইস্যুতে ভারতের বর্তমান উপরাষ্ট্রপতি পশ্চিমবাংলার সাবেক রাজ্যপাল ধনকর কেও তিরস্কৃত করেছিলেন সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিম কোর্টের সেই তিরস্কারেরও বেশ কিছুকাল পেরিয়ে গেছে, এরপরেও বিষয়টির সমাধান লক্ষ্য করা যাচ্ছিল না; আপিল বিভাগের সুনির্দিষ্ট সংখ্যক বিচারক থাকার কথা ভারতের সুপ্রিম কোর্টে।
হাইকোর্টের মতন সুপ্রিম কোর্টেও বিচারকের যে সংখ্যা ঘাটতি দেখা দিয়েছিল, দীর্ঘকাল মনোনয়ন না হওয়াতে। ইতোমধ্যে এক তথ্যে দেখা যায়, ভারতের ২৪টি হাইকোর্টে যেখানে ১,১০০ ওপরে বিচার ও থাকার কথা সেখানে প্রায় ৩০০ এর অধিক বিচারক ঘাটতি আছে। এমন অবস্থায়, প্রায় প্রকাশ্যেই সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সরকারের অসহযোগিতাকে দায়ী করে প্রকাশ্য বিবৃতি দেওয়া হচ্ছিল। ধারণা করা হচ্ছিল, এই সমস্ত বিবৃতির পরিপ্রেক্ষিতে হয়তো আরো কঠিন কোনো রাস্তায় হাঁটবে ভারতের বর্তমান সরকার। কিন্তু বলা যেতে পারে, অবশেষে সরকার দীর্ঘকালের অনুস্মৃতি পথ বেছে নিলো।
আইন মন্ত্রী ও সহকারি আইন মন্ত্রীর অপসারণের পরেই সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত দুজন বিচারককেই তারা গ্রহণ করলেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হিসেবে। যে দুজনের একজন ভারতের একটি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি অন্য একজন সিনিয়র আইনজীবী। এই নিয়োগ আরেকটি বিষয় স্পষ্ট করেছে যে, ভারতের সুপ্রিম কোর্টে সরাসরি জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদেরকে নিয়োগ দেওয়া যায়। যে দ্রুত গতিতে এই দুজনকে আজ বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলো, তা ইতিহাসের নিয়ম কানুন ভঙ্গ করেই হয়েছে বলা যায়; কারণ এত দ্রুততার সাথে কখনো কোনো উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগ অতীতে ভারতের হাইকোর্ট কিংবা সুপ্রিম কোর্টে হয়নি। এই সমঝোতার আসল রূপটি কী হবে তা, যদিও তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না । তবে বিচার বিভাগের সাথে নির্বাহী বিভাগের সমঝোতাই হচ্ছে উত্তম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা।
কর্ণাটকের পরাজয় কি বিজেপিকে সেই রাস্তায় হাঁটতে শেখালো? না-কি আগামী লোকসভায় বিচারবিভাগ সংশ্লিষ্ট বিতর্কে বিজেপি সংকটের মুখোমুখি হবে, সে উপলব্ধি করেছে দলটির নেতৃবৃন্দ? হয়তো সেখান থেকেই এত দ্রুততার সাথে কলেজিয়াম সিস্টেমকে পুনর্বহাল করা হয়েছে।
ভারতের সুপ্রিম কোর্টের ৯৯তম সংশোধনী বাতিল করার পরে সরকারের পক্ষে রিভিউ পিটিশন দাখিল করার সুযোগ থাকলেও সরকার তা করেননি। অর্থাৎ, সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তকেই তখন মেনে নেওয়া হয়েছিল। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে ১৬তম সংশোধনী বাতিল হওয়ার পরে তার রিভিউ পিটিশন এখনো আমাদের উচ্চ আদালতের নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। আমাদের সংবিধানের ১৬তম সংশোধনী ছিল বিচারপতি অপসারণ সংক্রান্ত আইন। ফলে বিচারপতি অপসারণ সংক্রান্ত বিষয়টি এখনো আমাদের দেশে ঝুলেই আছে।
- বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফল। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।