নেপালকে হারিয়ে সাফে বাংলাদেশের মেয়েদের ইতিহাস

টুর্নামেন্টে দাপুটে শুরুর পর স্বপ্নের পথচলার শুরু। এরপর বাংলাদেশের সামনে যে প্রতিপক্ষই পড়েছে, স্রেফ উড়ে গেছে। মেয়েদের এবারের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠা বাংলাদেশ ফাইনালেও শাসন কায়েম করে খেললো। নেপালের বিপক্ষে আগের রেকর্ড ভুলে অসাধারণ ফুটবলে স্বপ্নের ফাইনাল জিতে নিলো বাংলাদেশ। সাবিনা, কৃষ্ণাদের মাথায় উঠলো এশিয়ার শেষ্ঠত্বের মুকুট।
সোমবার দশরথ রঙ্গশালা স্টেডিয়ামে দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের আসরের ফাইনালে স্বাগতিক নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়েছে বাংলাদেশ। দারুণ জয়ে প্রথমবারের মতো সাফের চ্যাম্পিয়ন হলো বাংলাদেশ। ২০০৩ সালে সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ পুরুষ ফুটবল দল। ১৯ বছর পর এসে সেই সাফল্যের মালা গাঁথলেন বাংলার লড়াকু মেয়েরা। আসরে একটি ম্যাচও না হেরে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হলো বাংলাদেশ।
দারুণ, অসাধারণ, দুর্বার কিংবা অপ্রতিরোধ্য; এবারের আসরের বাংলাদেশ দলকে উপমায় গাঁথতে গেলে এই শব্দগুলোও যেন কম হয়ে যায়। প্রতিটা ম্যাচেই প্রতিপক্ষের জালে গোলবন্যা বইয়ে দেন সাবিনা, স্বপ্না কৃষ্ণারা; কিন্তু নিজেদের জাল রাখেন সুরক্ষিত। কেবল ফাইনালে এসে একটি গোল হজম করতে হলো বাংলাদেশকে। টুর্নামেন্টের পাঁচ ম্যাচে বাংলাদেশ গোল দিয়েছে ২৩টি, গোল হজম করেছে মাত্র একটি।
গোলাম রব্বানী ছোটনের তত্ত্বাবধানে থাকা দলটি আসর শুরু করে দুপটে এক জয়ে। নিজেদের প্রথম ম্যাচে মালদ্বীপকে ৩-০ গোলে হারায় বাংলাদেশ। দ্বিতীয় ম্যাচে পাকিস্তানকে ৬-০ গোলে হারিয়ে সেমি-ফাইনাল অনেকটাই নিশ্চিত করে ফেলে তারা। গ্রুপ পর্বের তৃতীয় ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে মেলে অধরা জয়, ৩-০ গোলে জিতে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে সেমিতে পা রাখেন সাবিনারা।
ফাইনালে ওঠার লড়াইটি হেসেখেলে জেতে বাংলাদেশ। ভুটানকে ৮-০ গোলে হারিয়ে শিরোপার আরও কাছে পৌঁছে যায় তারা। নেপালের বিপক্ষে আগের রেকর্ড ভালো না থাকায় কিছুটা শঙ্কা ছিল। কিন্তু দুর্দান্ত ছন্দে থাকা বাংলাদেশের সামনে বাধা হতে পারলো না স্বাগতিকরা। একবার ফাইনাল ও তিনবার সেমি-ফাইনাল খেলার পর অবশেষে শিরোপার উল্লাসে মাতলো বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল।
বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে আক্ষেপ-হতাশার শেষ নেই। সেখানে নারী ফুটবল যেন স্বস্তির এক পশলা বৃষ্টি। গত কয়েক বছর ধরেই ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলে আসছে নারী দল। কিন্তু স্বপ্নযাত্রা একটা পর্যায়ে গিয়ে থেমে যাচ্ছিল। ২০১৬ সাফ ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে হার মানা বাংলাদেশ তিনবার শেষ চার থেকে বিদায় নেয়। এবার নিজেদের গল্পটা আর আক্ষেপের হতে দিলো সাবিনা খাতুনের দল।
ইতিহাস গড়ার ম্যাচে নেপালের বিপক্ষে পুরোটা সময় শাসন করে খেলেছে বাংলাদেশ। বৃষ্টিভেজা মাঠেও দারুণ ফুটবলের পসরা সাজিয়েছেন শামসুন্নাহার জুনিয়র, কৃষ্ণা রানী সরকাররা। শিরোপার লড়াইয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেন সিরাত জাহান স্বপ্নার বদলি হিসেবে নামা শামসুন্নাহার। এরপর জোড়া গোল করে স্বপ্নের শিরোপা মুঠোয় তোলা নিশ্চিত করেন কৃষ্ণা।
নেপালের ১৫ হাজার দর্শক ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন দশরথ রঙ্গশালা স্টেডিয়ামের গ্যালারি ছিল কাণায় কাণায় পূর্ণ। স্বাভাবিকভাবেই গ্যালারির প্রায় পুরোটা ছিল নেপালের দর্শকদের দখলে। বিপক্ষ দলের মাঠ, এতো দর্শক উন্মাদনার মাঝেও খেই হারায়নি বাংলাদেশের মেয়েরা। শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক ফুটবলে নেপালের রক্ষণভাগে হানা দিতে থাকে বাংলাদেশ। গোলের দেখা পেতে বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি।
দশম মিনিটে চোট পেয়ে মাঠ ছাড়েন স্বপ্না। তার বদলি হিসেবে নামা শামসুন্নাহার চার মিনিট পরই দলকে গোলের আনন্দে ভাসান। সানজিদা খাতুনের শট নেপালের এক ডিফেন্ডারের পায়ে লাগে। বল পেয়ে যান মনিকা, একজনকে কাটিয়ে বাইলাইনের একটু উপর থেকে বক্সে ক্রস বাড়ান তিনি। দুরন্ত এক ফ্লিকে বল জালে জড়ান শামসুন্নাহার।
ছন্দময় ফুটবল খেলতে থাকা বাংলাদেশ প্রথমার্ধের শেষ দিকে ব্যবধান দ্বিগুণ করে। ৪১তম মিনিটে নেপালের এক খেলোয়াড়ের ভুলে বল পান অধিনায়ক সাবিনা। তিনি পাস বাড়ান কৃষ্ণার উদ্দেশ্যে। প্রথম ছোঁয়ায় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে একটু এগিয়ে বাঁ পায়ের দারুণ শটে গোল আদায় করে নেন এই ফরোয়ার্ড।
২-০ গোলে এগিয়ে থেকে বিরতিতে যায় বাংলাদেশ। বিরতির পর ক্রমেই গুছিয়ে নিয়ে আক্রমণ সাজাতে শুরু করে নেপাল। ৭০তম মিনিটে গোলের দেখাও পেয়ে যায় স্বাগতিকরা। বাংলাদেশের ডি-বক্সের মধ্যে ফাঁকায় বল পেয়ে জোরালো কোণাকুণি শটে গোল করেন নেপালের বাসনেত। বাংলাদেশের গোলরক্ষক রুপনা ঝাঁপিয়ে পড়েও বলের নাগাল পাননি।
কিছুক্ষণ পর অবশ্য আবারও ব্যবধান বাড়িয়ে নেয় বাংলাদেশ। ৭৭তম মিনিটে পাল্টা আক্রমণে নেপালের জাল খুঁজে নেয় বাংলাদেশ। সতীর্থের থ্রু পাস ধরে ঠাণ্ডা মাথায় নেপাল গোলরক্ষককে ফাঁকি দিয়া দলের তৃতীয় ও নিজের দ্বিতীয় গোলটি করেন কৃষ্ণা। এরপর অনেক চেষ্টা করেও ব্যবধান কমাতে পারেনি স্বাগতিক শিবির। রেফারির শেষ বাঁশি বাজতেই উল্লাসে মাতেন বাংলাদেশের মেয়েরা।
প্রথমবারের মতো সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মিশনে নেপালের বিপক্ষেও নিজেদের রেকর্ড পাল্টে নিলো বাংলাদেশ। এই দলটির বিপক্ষে আগের কয়েক সাক্ষাতে সুবিধা করতে পারেনি বাংলাদেশ। ৮ ম্যাচ খেলে ৬টিতেই হারে বাংলাদেশ, ড্র হয় ২টি ম্যাচ। শিরোপা নিজেদের করে নেওয়ার যাত্রায় নেপালের বিপক্ষে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ জেতারও স্বাদ নিলো বাংলাদেশ।