গুলি না চালিয়েও খুনের দায়ে ১৯ বছর জেল খেটেছেন; হঠাৎ গানম্যানের চিঠিতে বদলে গেল সব
রাইকারস আইল্যান্ড কারাগারে বন্দী এমেল ম্যাকডাওয়েল। হঠাৎ এক কারারক্ষী তার নাম ধরে ডাকলেন। লোহার গরাদের ফাঁক গলে তার সেলের ভেতর এসে পড়ল একটি খাম। খামের ওপর প্রেরকের ঠিকানা দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না এমেল।
নিউইয়র্ক সিটির যে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এমেল কারাগারে, সেই ঘটনায় যিনি গুলি চালিয়েছিলেন বলে এমেল বিশ্বাস করেন, চিঠিটি পাঠিয়েছেন সেই ব্যক্তিই। এমেল মনে করেন, গ্রেপ্তার হওয়া উচিত ছিল ওই ব্যক্তির, তার (এমেল) নয়।
খাম ছিঁড়ে চিঠিটি বের করলেন তিনি। পড়ার পর কথাগুলো যেন তাকে সজোরে আঘাত করল।
চিঠিতে লেখা ছিল, 'এমেল, তুমি জানো, আমি আর তুমি দীর্ঘদিনের বন্ধু। যে ঘটনাটি ঘটেছে...তাতে আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হওয়া উচিত নয়।'
চিঠিতে আরও লেখা ছিল, 'এমেল, এক মুহূর্তের জন্যও ভেবো না যে আমি বাইরে আছি বলে কষ্টে নেই...আমার মনে হয় না, এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আর কোনো অধিকার আমার আছে। কারণ, আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধুটি এমন এক অপরাধের জন্য কারাগারে বন্দী, যা সে করেনি।'
চিঠিতে উল্লেখ করা ওই 'ঘটনা' ঘটেছিল তিন মাস আগে, ব্রুকলিনে এক হাউজ পার্টিতে। এমেল জানান, সেখানে বাগ্বিতণ্ডার একপর্যায়ে তার সেই বন্ধু গুলি চালিয়েছিলেন। এতে ১৯ বছর বয়সী এক তরুণ নিহত হন।
চলতি মাসে এমেল বলেন, 'আমি এখানে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হয়ে বসে আছি, কারাগারের জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। কারাগারে এই আমার প্রথম জন্মদিন কাটল। প্রথম বড়দিন কাটল। কাটল প্রথম নববর্ষও। এর মধ্যে এই চিঠি পাওয়া...পুরোনো অনেক ক্ষত যেন আবার নতুন করে জেগে উঠল।'
সাদা কাগজে হাতে লেখা ওই চিঠিতে তারিখ দেওয়া ছিল ১৯৯১ সালের জানুয়ারি। এমেলের বিশ্বাস ছিল, এই চিঠিই তাকে নির্দোষ প্রমাণ করবে। তিনি চিঠিটি তার আদালত নিযুক্ত আইনজীবীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। ভরসা রেখেছিলেন, ন্যায়বিচার তিনি পাবেনই।
কিন্তু তা হয়নি—দীর্ঘদিনেও না। সাক্ষীদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য এবং ওই চিঠিতে এমেলের সম্পৃক্ততা না থাকার ইঙ্গিত মিললেও জুরি বোর্ড তাকে হত্যা ও অস্ত্র রাখার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে। তাকে ২২ বছর থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
তবে চিঠিটি এমেল নিজের কাছেই রেখে দিয়েছিলেন। কারাগারে নিজের বিছানার পাশে থাকা একটি বাদামি বাইবেলের ভেতর সেটি যত্ন করে রেখেছিলেন। তার বিশ্বাস ছিল, এই চিঠিই তার মুক্তির চাবিকাঠি।
কারাগারের ভেতর থেকেই নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য বিরামহীন লড়াই শুরু করেন ম্যাকডাওয়েল। তিনি আইনজীবী, অধিকারকর্মী ও সাংবাদিকদের ফোন করে ওই চিঠির কথা জানাতেন। কারাগারে প্যারালিগ্যাল কোর্স করেন, কলেজের ক্রেডিট অর্জন করেন এবং অন্য বন্দীদের আইনি নথিপত্র তৈরিতে সহায়তা করেন। তিনি নিজেই আপিল করেছিলেন।
বছর গড়িয়ে যায়, তার আশাও ক্ষীণ হতে থাকে। চিঠির জীর্ণ দশা আর ভাঁজগুলো যেন তার দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে ওঠে।
এরপর ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে কৌঁসুলিরা তাকে একটি প্রস্তাব দেন। হত্যার দায় স্বীকার করলেই তিনি মুক্তি পাবেন। কারাগারে যে সময় তিনি কাটিয়েছেন, তা সাজা হিসেবে গণ্য হবে।
১৯ বছর ২ মাস জেলে কাটানোর পর বড়দিনে পরিবারের কাছে ফেরার এটা একটা সুযোগ ছিল তার। তাই তিনি সেই প্রস্তাব মেনে নেন এবং জেল থেকে ছাড়া পান। কিন্তু আইনের চোখে তিনি তখনো অপরাধী। তিনি বলেন, দোষমুক্ত না হয়ে এই স্বাধীনতা আসলে ন্যায়বিচার ছিল না।
অবশেষে ১৩ বছরের বেশি সময় পর সেই কাঙ্ক্ষিত দিন আসে। ২০২৩ সালের মার্চে ব্রুকলিন ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি অফিস তার দণ্ড বাতিল করে। তারা জানায়, ম্যাকডাওয়েলের বন্ধু ওই গুলিবর্ষণের কথা স্বীকার করেছেন।
ভুল রায়ের কারণে নিউইর্য়ক সিটি ও বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন ম্যাকডাওয়েল। গত বছর সেই মামলায় সমঝোতা হিসেবে ৯০ লাখ ডলার পান তিনি।
এখন তিনি অঙ্গরাজ্যের বিরুদ্ধেও অভিযোগ দায়ের করেছেন। সেখানে তিনি কারাগারে নামমাত্র পারিশ্রমিকে বাধ্যতামূলক শ্রম ও মজুরি বঞ্চনার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। তার আইনজীবী একে আধুনিক দাসপ্রথার সঙ্গে তুলনা করেছেন।
প্রায় ৩৫ বছর পরও ম্যাকডাওয়েলের সেই লড়াই শেষ হয়নি, যা ওই চিঠি তার সেলে পৌঁছানোর আগেই শুরু হয়েছিল।
তিনি বলেন, 'যতবার আমি চিঠিটির দিকে তাকাতাম, কাঁদতাম, আবেগপ্রবণ হয়ে পড়তাম। এখন আর ওটা পড়ি না, কারণ এটা পুরোনো ক্ষত জাগিয়ে তোলে।'
ব্রুকলিনের সেই পার্টিই বদলে দেয় জীবনের গতিপথ
ম্যাকডাওয়েলের বয়স যখন ১০ বছর, তখন তার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। ব্রুকলিনে মা ও ছোট ভাইয়ের সঙ্গেই বড় হচ্ছিলেন তিনি।
১৯৯০ সালে তিনি ছিলেন হাইস্কুলের একজন কৃতী শিক্ষার্থী। গ্র্যাজুয়েশনের পরই সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। তার লক্ষ্য ছিল পরে বিমানবাহিনীতে গিয়ে পাইলট হওয়া।
অক্টোবরের যে রাতে তিনি ওই হাউজ পার্টিতে যান, মা তাকে ঘরেই থাকতে বলেছিলেন। কিন্তু ১৭ বছর বয়সী ম্যাকডাওয়েল প্রেমিকার সঙ্গে সময় কাটাতে চেয়েছিলেন, তাই মায়ের কথা না শুনেই তিনি বেরিয়ে পড়েন।
ম্যাকডাওয়েল বলেন, পার্টিতে তার এক বন্ধুর সঙ্গে অন্যদের হাতাহাতি বেধে যায়। তার আরেক বন্ধু—যিনি পরে তাকে জেলখানায় ওই চিঠি পাঠিয়েছিলেন—বন্দুক বের করে গুলি ছোড়েন। ম্যাকডাওয়েল তদন্তকারীদের জানিয়েছিলেন, ঘটনার সময় তিনি তার প্রেমিকার হাত ধরে সেখান থেকে পালিয়ে যান।
ওই গুলিবর্ষণের ঘটনায় জোনাথন পাওয়েল নামের ১৯ বছর বয়সী এক তরুণ নিহত হন। এতে তছনছ হয়ে যায় দুটি পরিবারের জীবন। মধ্যরাতের পর পার্টি থেকে বেরিয়ে ম্যাকডাওয়েল রাতে থাকার জন্য অন্য এক বন্ধুর বাসায় যান। পরদিন সকালে মা তাকে অবিলম্বে বাসায় ফিরতে বলেন।
ম্যাকডাওয়েল বলেন, 'আমি প্রায় আট ব্লক হেঁটে সোজা বাসায় যাই। পৌঁছানোর পর মা বললেন, গোয়েন্দারা তোমাকে খুঁজতে এসেছিল। আমি বললাম, কেন? মা বললেন, ওই যে ছেলেটা গুলিবিদ্ধ হলো, সে ব্যাপারে।' মা তাকে থানায় গিয়ে খোঁজ নিতে বলেন, পুলিশ কী চায়।
ম্যাকডাওয়েল বলেন, 'মা আমার সঙ্গে যাননি। কারণ আমরা দুজনেই জানতাম, ওই ঘটনার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। এমনকি মারামারিতেও আমি ছিলাম না।'
থানায় যাওয়ার পর ম্যাকডাওয়েলকে সোজা হোমিসাইড (হত্যাকাণ্ড তদন্ত) বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গোয়েন্দারা তাকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করেন। তিনি আর বাড়ি ফিরতে পারেননি।
২৪ ঘণ্টার মধ্যেই পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে। ব্রুকলিন ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি অফিস পরে এক বিবৃতিতে জানায়, সাক্ষীদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য সত্ত্বেও গোয়েন্দারা ম্যাকডাওয়েলের ওই বন্ধুর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ খতিয়ে দেখেননি।
ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নির অফিস জানিয়েছে, ওই ঘটনায় দুজন সাক্ষী ম্যাকডাওয়েলকে হামলাকারী হিসেবে শনাক্ত করলেও অন্য কয়েকজন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে কাজটি আসলে তার বন্ধুর। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত বন্দুকটি কখনোই উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
চিঠিতে ম্যাকডাওয়েলের ওই বন্ধু লিখেছিলেন, ওই রাতের ঘটনা তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। তিনি লেখেন, 'এক মুহূর্তের জন্যও ভেবো না যে আমি বাইরে খুব আনন্দে দিন কাটাচ্ছি। বন্ধু, আমি অনুতপ্ত। আমি দুঃস্বপ্ন দেখি, ঠিকমতো খেতে পারি না, ঘুমাতে পারি না। মাঝে মাঝে মনে হয় মরে যাই।
..পুনশ্চ: আমাদের এই চিঠিপত্র গোপন রাখার চেষ্টা করো।'
ম্যাকডাওয়েল বলেন, গ্রেপ্তারের দিনই তিনি তদন্তকারীদের জানিয়েছিলেন যে তার বন্ধুই এ কাজ করেছেন। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য তখন দোষটা তাঁর ঘাড়ে চাপানোই ছিল সহজ কাজ।
ওই হাউজ পার্টির ঘটনাটি এমন একসময়ে ঘটেছিল, যখন যুক্তরাষ্ট্রে ক্র্যাক কোকেনের মহামারি চলছিল। এর আগের বছরই নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কে এক নারীকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে পাঁচ কৃষ্ণাঙ্গ ও লাতিন কিশোরকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল—যে ঘটনা পুরো দেশকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। (বহু বছর পর আসল অপরাধী স্বীকারোক্তি দেওয়ার পর এবং জেল খাটার পর ওই পাঁচজন নির্দোষ প্রমাণিত হন)।
ম্যাকডাওয়েল বলেন, 'তৎকালীন রাজনৈতিক পরিবেশটাই এমন ছিল যে নিউইয়র্ক সিটির এই ভয়াবহ অপরাধ, বিশেষ করে কিশোর অপরাধ দমনে কিছু একটা করতেই হবে। তাই পুলিশ পরিসংখ্যান বাড়ানোর দিকেই নজর দিচ্ছিল। আর আমি ছিলাম তাদের জন্য উপযুক্ত শিকার: ১৭ বছর বয়স, কৃষ্ণাঙ্গ, নামটাও একটু আলাদা, ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলাম এবং আমি 'সিঙ্গেল মাদারের' সন্তান।'
ম্যাকডাওয়েলের বর্তমান আইনজীবী অস্কার মিশেলেন বলেন, চিঠিতে ওই বন্ধু সরাসরি দোষ স্বীকার না করলেও তদন্ত শুরু করার মতো যথেষ্ট তথ্য সেখানে ছিল।
মিশেলেন বলেন, 'এমেল বুঝতে পেরেছিল তার বন্ধু কী বোঝাতে চেয়েছে। সে তার তৎকালীন আইনজীবীকেও বলেছিল যে তার বন্ধু কাজটি করেছে। ফলে সবার কাছেই ওই বন্ধুর নাম জানা ছিল। তাকে তলব করা বা চাপ দেওয়ার মতো পদক্ষেপ নেওয়া যেত। কিন্তু বাস্তবে কেউ কিছুই করেনি।'
ম্যাকডাওয়েলের তৎকালীন আইনজীবী বিচার চলাকালে ওই চিঠি প্রমাণ হিসেবে আদালতে উপস্থাপন করেননি কিংবা কৌঁসুলিদেরও দেখাননি।
ব্রুকলিন ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নির অফিস পরে নিশ্চিত হয় যে ম্যাকডাওয়েলের বন্ধু যে গুলি চালিয়েছিলেন, সে–সংক্রান্ত প্রমাণগুলো তদন্তকারীরা খতিয়ে দেখেননি। এক বিবৃতিতে অফিসটি জানায়, 'তদন্তকারীদের একরৈখিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং আগে থেকেই সব ঠিক ধরে নেওয়ার কারণেই সম্ভবত তারা একজনকে সন্দেহভাজন হিসেবে ধরে নিয়েছিল এবং এর বিপরীত প্রমাণগুলো উপেক্ষা করেছিল।'
চিঠিটি আগলে রেখেছিলেন তিনি
দুই বছরের বেশি সময় কারাগারে থাকার পর জুরি ট্রায়ালে দোষী সাব্যস্ত হন ম্যাকডাওয়েল। তিনি বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে ১৯ বছর বয়সে এমন এক খুনের দায়ে তাঁকে জেলে যেতে হচ্ছে, যা তিনি করেননি।
ম্যাকডাওয়েল বলেন, 'তরুণ হিসেবে আমার বিশ্বাস ছিল, বিচারব্যবস্থায় সত্য উদ্ঘাটনের কোনো না কোনো পথ নিশ্চয়ই আছে। তাই ১৯৯২ সালে যখন বিচারের মুখোমুখি হলাম...আমি স্বপ্নেও ভাবিনি যে আমি দোষী সাব্যস্ত হব।'
রায়ের পর নিজের অনুভূতির কথা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, 'আমি যেন অসাড় হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, সব শেষ। আমার জীবনটাই শেষ হয়ে গেল। আমি আর কখনোই মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে পারব না।'
রাইকারস আইল্যান্ড কারাগারে কিছুদিন থাকার পর ম্যাকডাওয়েলকে পাঠানো হয় আপস্টেট নিউইয়র্কের এলমিরা কারেকশনাল ফ্যাসিলিটিতে। সেখানে তাঁর পরিচয় হয় কয়েদি নম্বর ৯২এ৫৩৫১।
কারাজীবনে তাকে বেশ কয়েকটি কারাগারে স্থানান্তরিত হতে হয়েছে। কিন্তু যখনই তাকে এক কারাগার থেকে আরেক কারাগারে নেওয়া হয়েছে, তিনি তার বাইবেলটি সঙ্গে রেখেছেন। কারণ, তার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদটি (চিঠি) ওটার ভেতরেই ছিল। মাঝেমধ্যে রাতে তিনি বাইবেলের পাতার ভাঁজে আঙুল বুলিয়ে নিশ্চিত হতেন, চিঠিটি ঠিক জায়গায় আছে কি না।
ম্যাকডাওয়েল বলেন, 'আমি যেখানেই যেতাম, বাইবেলটি সঙ্গেই রাখতাম। ওই চিঠিটি ছিল আমার আশার প্রতীক যে সত্য একদিন না একদিন প্রকাশ পাবেই।'
এটি তাঁকে বেঁচে থাকার একটা লক্ষ্যও এনে দিয়েছিল।
কমস্টকের গ্রেট মেডো কারেকশনাল ফ্যাসিলিটিতে থাকার সময় কাছের স্কিডমোর কলেজের অধ্যাপকেরা বন্দীদের ক্লাস নিতে আসতেন। ম্যাকডাওয়েল সেখানে কলেজ ডিগ্রির জন্য ক্রেডিট অর্জন শুরু করেন এবং ডাকযোগে একটি প্যারালিগ্যাল সার্টিফিকেশন কোর্সে ভর্তি হন।
আইন শেখা এবং নিজের দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে লড়ার আইনি খুঁটিনাটি রপ্ত করার জন্য পড়াশোনা শুরু করেন ম্যাকডাওয়েল। এ সময় তার বন্ধুরা টিউশন ফি দিয়ে তাকে সহায়তা করেন। তার এই প্রশিক্ষণ এতটাই কাজে দিয়েছিল যে পরে অন্য এক কারাগারে বন্দীদের আইনি গবেষণার ওপর ক্লাস নিতেন ম্যাকডাওয়েল। নিজের মামলা নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি অন্য বন্দীদের মামলার আইনি নথিপত্র তৈরি ও দণ্ড চ্যালেঞ্জ করতেও সহায়তা করতেন তিনি।
১৯৯৫ সালে ম্যাকডাওয়েলের দণ্ড চ্যালেঞ্জ করে করা একটি আবেদন খারিজ করে দেন রাজ্যের আপিল আদালত। কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্র ছিলেন না তিনি। পরে বেশ কয়েকজন আইনজীবীর কাছে নিজের মামলার ফাইল পাঠান। তাঁদেরই একজন ছিলেন মিশেলেন।
মিশেলেন বলেন, 'ফাইলটি এত গুছানো ছিল...একজন বন্দী নিজে এটি লিখেছেন জেনে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম।'
তিনি আরও বলেন, 'আমার মনে হয়েছিল, তিনি সঠিক তথ্যগুলোই তুলে ধরেছেন। তাই আমরা আরও কিছু তদন্ত করি এবং মামলাটি লড়ার সিদ্ধান্ত নিই।'
আইনজীবী মিশেলেন জানান, চুক্তির অংশ হিসেবে ম্যাকডাওয়েল স্বীকার করেন যে তিনি অপরাধে অংশ নিয়েছেন, কিন্তু ভুক্তভোগীকে তিনি গুলি করেননি।
ম্যাকডাওয়েল বলেন, তিনি প্রথমে ভেবেছিলেন প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করবেন এবং নিজেকে সম্পূর্ণ নির্দোষ প্রমাণের জন্য লড়বেন। কিন্তু বিচারব্যবস্থা যেহেতু একবার তাকে ঠকিয়েছে, তাই এর ওপর তিনি আর ভরসা পাননি।
তাই তিনি স্বাধীনতাই বেছে নিয়েছিলেন।
প্রায় ৩৩ বছর পর আসল খুনির স্বীকারোক্তি
জেল থেকে বেরিয়ে ম্যাকডাওয়েল তার মামলার লড়াই চালিয়ে যান। তিনি মায়ের কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ব্যবহার করতে শেখেন এবং কারাগারের বাইরে আগে যা তার নাগালের বাইরে ছিল, ডিজিটাল জগতে প্রবেশ করেন।
দীর্ঘ আইনি প্রস্তুতির পর তিনি এবং তার আইনজীবী ব্রুকলিন ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নির অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং কৌঁসুলিদের মামলাটি পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানান।
২০২৩ সালের মার্চ মাসে, ভিন্ন প্রধান কৌঁসুলির দায়িত্বে থাকাকালে, তাদের এই প্রচেষ্টা অবশেষে সফল হয়। ২০১৭ সালে নির্বাচিত হওয়া ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি এরিক গঞ্জালেজ ঘোষণা করেন যে তার অফিসের কনভিকশন রিভিউ ইউনিট (রায় পুনর্বিবেচনা শাখা) তদন্ত করে নিশ্চিত করেছে যে ম্যাকডাওয়েল নির্দোষ এবং তার দণ্ডাদেশ বাতিলের আবেদন করা হয়েছে।
ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নির অফিস জানায়, ম্যাকডাওয়েলের বন্ধু কনভিকশন রিভিউ ইউনিটের তদন্তকারীদের কাছে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন যে তিনি আত্মরক্ষার্থে গুলি চালিয়েছিলেন।
২০২৩ সালে এক বিবৃতিতে গঞ্জালেজ বলেন, '১৯৯০ সালে এমেল ম্যাকডাওয়েলকে ভুলভাবে হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করার মাধ্যমে আমাদের বিচারব্যবস্থা তার সঙ্গে অন্যায় করেছে। বছরের পর বছর পর মুক্তি পাওয়ার শর্ত ছিল এমন এক অপরাধ স্বীকার করা, যা তিনি করেননি। ...আজ আমরা তার হারানো সম্মান পুনরুদ্ধারের আবেদন জানাচ্ছি। কৌঁসুলিদের দায়িত্ব প্রতিটি মামলায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।'
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র সিএনএনকে নিশ্চিত করেছে, জেলা অ্যাটর্নি অফিস যে বন্ধুর স্বীকারোক্তির কথা জানিয়েছে, ১৯৯১ সালে ম্যাকডাওয়েলকে চিঠিটি তিনিই লিখেছিলেন।
কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তদন্তে উঠে এসেছে যে ওই রাতে পার্টিতে ম্যাকডাওয়েলের বন্ধু আত্মরক্ষার্থেই গুলি চালিয়েছিলেন। তাই তার বিরুদ্ধে নতুন করে অভিযোগ গঠনের কোনো পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষের নেই।
তবে ম্যাকডাওয়েলের লড়াই এখনো শেষ হয়নি।
রাজ্যের বিরুদ্ধে করা দেওয়ানি মামলায় তিনি ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন। তার যুক্তি, প্রায় দুই দশক ধরে কারাগারে তাকে নামমাত্র মূল্যে কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছে। এ ছাড়া জেলে না থাকলে তিনি যে আয় করতে পারতেন, তা থেকেও তিনি বঞ্চিত হয়েছেন। নিউইয়র্ক ও অন্যান্য অঙ্গরাজ্যেও এমন আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার নজির রয়েছে।
ম্যাকডাওয়েল বলেন, 'বিনা দোষে সাজা খেটে বছরের পর বছর আমি আপনাদের নামমাত্র মূল্যে শ্রম দিয়েছি। আপনারা আমাকে শ্রম দিতে বাধ্য করেছেন। এর সুফল আপনারা ভোগ করতে পারেন না। এর জন্য আমাকে ক্ষতিপূরণ দিতেই হবে।'
আইনজীবী মিশেলেন বলেন, ভুল রায়ের কারণে নিউইর্য়ক সিটির সঙ্গে সমঝোতা করে ম্যাকডাওয়েল লাখ লাখ ডলার পেলেও কারাগারে বাধ্যতামূলক শ্রমের জন্য অঙ্গরাজ্য সরকারের কাছে তাঁর ক্ষতিপূরণ পাওনা রয়েছে।
তিনি বলেন, 'যারা হাইস্কুলের কৃতী শিক্ষার্থী ছিলেন না এবং ১৯ বছর ধরে যাঁদের জীবন তছনছ হয়ে যায়নি, তাঁদের পক্ষে অন্যের জীবন ও অভিজ্ঞতার অবমূল্যায়ন করা সহজ।'
নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় এই মামলার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
মুক্তি মিললেও কাটেনি সব বাধা
প্রথম যখন জেলে যান, তখন ম্যাকডাওয়েলের বয়স ছিল ১৭ বছর। যখন ছাড়া পান, তখন তিনি তিরিশের কোঠার শেষ দিকে। এখন তার বয়স ৫৩ বছর।
তিনি বলেন, কারাগারে থাকার সময় তিনি যা হারিয়েছেন, কোনো অর্থ দিয়েই তা পূরণ করা সম্ভব নয়।কারাগারে থাকার সময় তার বাবা মারা যান। বাবার সঙ্গে শেষ দেখা বা কথা বলার সুযোগটুকুও তিনি পাননি।
মাঝেমধ্যে তিনি ভাবেন, যদি বিনা দোষে সাজা খাটতে না হতো, তবে তাঁর জীবনটা আজ কেমন হতো। ম্যাকডাওয়েল বলেন, 'বেশির ভাগ তরুণ যেসব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায়—স্কুল, কাজ, প্রেম—আমি সেসব পাইনি। এত সব বাধার মুখেও এখন আমি যা অর্জন করেছি, বাধা না থাকলে জীবনে আমি কী অর্জন করতে পারতাম? আমি আজ কোথায় থাকতাম?'
তিনি বলেন, নির্দোষ প্রমাণিত হওয়াটা অবশ্যই স্বস্তির, কিন্তু গুরুতর অপরাধের দণ্ডের কলঙ্ক কখনোই পুরোপুরি মুছে যায় না। সিএনএন ম্যাকডাওয়েলের অপরাধের তথ্যের ওপর দেশজুড়ে একটি 'ব্যাকগ্রাউন্ড সার্চ' চালিয়েছিল। ফলাফলে তার দণ্ডের বিষয়টি দেখালেও তিনি যে নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন, তার কোনো উল্লেখ নেই।
সিএনএন নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যেও একই ধরনের অনুসন্ধান চালিয়েছে। সেখানে ম্যাকডাওয়েলের নামে কোনো ফলাফল দেখা যায়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র জানিয়েছে, এর অর্থ হলো তার মামলার ফাইলটি 'সিল' বা গোপন করা হয়েছে।
তবে ম্যাকডাওয়েল বলেন, দণ্ডাদেশ ও কারাভোগের কারণে মানুষ এখনো তাকে বিচার করে। তাই তাকে প্রতিনিয়ত নিজেকে প্রমাণ করতে হয়।
তিনি জানান, নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার পরও তাদের বাড়তি বাধার মুখে পড়তে হয়। সন্তান দত্তক নেওয়া, মদের দোকানের মতো নির্দিষ্ট কিছু ব্যবসা শুরু করা কিংবা আইন পেশা বা আবাসন ব্যবসার (রিয়েল এস্টেট) লাইসেন্সের জন্য আবেদন করার সময় তাদের বিস্তারিত নথিপত্র ও হলফনামা জমা দিতে হয়।
ম্যাকডাওয়েল বলেন, 'মানুষ মনে করে, নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার পর আমরা অন্য নাগরিকদের মতোই স্বাভাবিক জীবন যাপন করি। এটা ভুল ধারণা। বিশেষ করে নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যে, যেখানে নথিপত্র শুধু গোপন (সিল) করা হয়, একেবারে মুছে ফেলা হয় না। আসলে কখনোই পুরোপুরি ন্যায়বিচার পাওয়া যায় না।'
ম্যাকডাওয়েলের এখন আবাসন ব্যবসার লাইসেন্স আছে। পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন আইনি প্রতিষ্ঠানের (ল ফার্ম) সঙ্গে চুক্তিতে কাজ করেন। আইনি নথিপত্র বা মোশন তৈরিতে তিনি তাদের সহায়তা করেন।
তিনি জানান, তার লক্ষ্য ল স্কুলে ভর্তি হওয়া এবং আইনজীবী হওয়া। আইনজীবী হয়ে তিনি ভুল রায়ের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মামলাসহ বিস্তৃত পরিসরে আইনি কাজ করতে চান।
তিনি বলেন, 'জীবনে এত দূর এসেছি কোনো গণ্ডিতে আটকে থাকার জন্য নয়।'
এখন আর তিনি সেই চিঠির দিকে তাকান না। এটি অনেক বেদনাদায়ক স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। ফেলে আসা দিনের স্মৃতি হিসেবে তিনি চিঠিটি তার আইনজীবীর কাছে গচ্ছিত রেখেছেন।
এর বদলে তিনি সামনের দিকে তাকাতে চান। তিনি বিশ্বাস করেন, ভবিষ্যৎটা এখন তার নিজের হাতেই লেখা হবে।
