‘রেজ বেইট’, ‘৬-৭’, ‘এআই স্লপ’: বর্ষসেরা শব্দগুলোই যেভাবে বলে দিচ্ছে, ইন্টারনেটের কী বেহাল দশা!
অক্সফোর্ড ডিকশনারির এবারের বর্ষসেরা শব্দ 'রেজ বেইট' (Rage bait)। ম্যাককুয়ারি বেছে নিয়েছে 'এআই স্লপ' (AI slop)। কেমব্রিজ ডিকশনারির পছন্দ 'প্যারা-সোশ্যাল' (Parasocial)। আর ডিকশনারি ডটকমের সেরা শব্দ '৬-৭' (6-7)।
ব্যাপারটিতে নিশ্চয়ই কোনো একটা গোলমাল আছে, তাই না? এতটাই গোলমেলে যে আমাদের ব্যবহৃত শব্দগুলোতেও এর কুৎসিত ছাপ স্পষ্ট। সোজা কথায়, ইন্টারনেটের জগৎটা যেন ভেঙেচুরে গেছে, 'নষ্ট' হয়ে গেছে। আর আমরা সারাক্ষণ শুধু সেই জগৎ নিয়েই কথা বলে যাচ্ছি।
আমাদের বর্তমান দুর্দশা বর্ণনা করার জন্য অভিধানে এখন কেবল এই শব্দগুলোই বাড়ছে। শব্দগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায়, বিরক্তি থেকে শুরু করে পুরোপুরি অর্থহীনতা পর্যন্ত এর ব্যাপ্তি কতদূর।
যেমন 'রেজ বেইট' হলো এমন সব কনটেন্ট, যা তৈরিই করা হয় মানুষকে রাগিয়ে দেওয়ার জন্য। 'প্যারা-সোশ্যাল' দিয়ে বোঝানো হয় মুঠোফোনে দেখা সেলিব্রিটি বা অন্য মানুষের সঙ্গে আমাদের একপাক্ষিক বা কাল্পনিক সম্পর্ককে। জেনারেটিভ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার তৈরি নিম্নমানের ও বিভ্রান্তিকর কনটেন্টকে বলা হচ্ছে 'এআই স্লপ'। আর '৬-৭' তো পুরোপুরি অর্থহীন একটি বিষয়।
সব সময় কিন্তু পরিস্থিতি এমন ছিল না। ২০১০-এর দশকে যখন 'বর্ষসেরা শব্দ' বাছার চল ছিল, তখন সেগুলোর সঙ্গে ইন্টারনেটের খুব একটা যোগসূত্র থাকত না। এরপর এল করোনার যুগ; মহামারি যেমন আমাদের জীবনকে আক্রান্ত করল, তেমনি আক্রান্ত করল আমাদের শব্দভান্ডারকেও। কিন্তু এখন? এখন আমাদের সবচেয়ে নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ শব্দগুলো শুধু এটাই জানান দিচ্ছে যে ইন্টারনেট দুনিয়া নিয়ে আমরা কতটা বিরক্ত ও অসুখী।
উদাহরণ হিসেবে গত বছরের কথাই ধরা যাক। অক্সফোর্ডের গতবারের বর্ষসেরা শব্দ ছিল 'ব্রেন রট' (Brain rot), আর ২০২২ সালে ছিল 'গবলিন মোড' (Goblin mode)। অথচ ২০১০-এর দশকের শব্দগুলো ছিল বাস্তব পৃথিবীর সত্যিকারের ঘটনা নিয়ে। যেমন ২০১৯ সালে ছিল 'ক্লাইমেট ইমার্জেন্সি' (Climate emergency) বা ২০১৭ সালে 'ইয়ুথকুয়েক' (Youthquake)। এগুলোর উৎপত্তি হয়তো অনলাইনে, কিন্তু এর প্রভাব বা বিকাশ ছিল রক্ত-মাংসের বাস্তব দুনিয়াতে।
২০২০-এর দশকের শব্দগুলোতে জীবনের সেই স্পন্দন বা সারবত্তা নেই। এর বদলে শব্দগুলো হয় কম্পিউটার থেকে দূরে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করে, অথবা কম্পিউটারের সামনে থাকার ফলে আমাদের বিরক্তি বা অস্বস্তির কথা বলে।
মানুষ ইন্টারনেট নিয়ে সব সময়ই অভিযোগ করে আসছে, আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সেই অভিযোগের গতি ও তীব্রতা—দুটোই বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সোশ্যাল মিডিয়া যেন এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যার এর একমাত্র কাজই হলো আমাদের মন খারাপ করিয়ে দেওয়া।
অ্যালগরিদম কীভাবে মতবিরোধ উসকে দেয় কিংবা নিউজফিড কীভাবে আমাদের দ্রুত ডোপামিন পাওয়ার লোভে ফেলে—তা নিয়ে অনেক কাঠখোট্টা বিশ্লেষণ দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু এসব বিশ্লেষণের গভীরে লুকিয়ে আছে একটি রূঢ় সত্য: অনলাইনে থাকাটা এখন আর আগের মতো আনন্দের কিছু নয়।
ইন্টারনেটের এই জৌলুস হারানোর সময়েই অস্ট্রেলিয়া ১৬ বছরের কম বয়সীদের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া নিষিদ্ধ করার বহুল আলোচিত উদ্যোগটি কার্যকর করতে যাচ্ছে। এ নিয়ে সমালোচনাও কম হচ্ছে না। কেউ বলছেন এটি ঠিকঠাক কাজ করবে না, কেউ বলছেন কাজ করলেও কোনো কিছু নিষিদ্ধ করা সমস্যার সঠিক সমাধান নয়। কিন্তু একটা সমস্যা যে আছে এবং তা সমাধান করা জরুরি—এ কথা অস্বীকার করার লোক খুব কম।
আজকের ইন্টারনেটের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে প্রায়ই 'আসক্তি' বলা হয়। কথাটি সত্য হলেও পুরোপুরি সঠিক নয়। আগে ইন্টারনেটকে এমন এক আসক্তি ভাবা হতো, যার মধ্যে পুষ্টি বা উপকারের উপাদানও ছিল; অনেকটা খাবারের মতো। এমনকি আজকের দিনে আমরা স্ক্রিন টাইমের যেসব নির্দেশনা বা পরামর্শ দেখি, সেগুলোর ভিত্তিও অনেকটা পুষ্টিবিজ্ঞানের আদলে তৈরি। কিন্তু আজ ইন্টারনেট নিয়ে আমাদের কথাবার্তার ধরন বদলে গেছে। এটি এখন একধরনের 'শূন্য আসক্তি' বা আনন্দহীন নির্ভরতা। ক্যাসিনোর স্লট মেশিনে আসক্ত হওয়ার মতো, যেখানে জ্যাকপট জেতার কোনো সুযোগ নেই, আছে শুধু নেশা।
মজার ব্যাপার হলো, এই চকচকে অনলাইন জগৎ থেকে পালিয়ে বাস্তব জীবনে ফেরার আকুতিও প্রকাশ করা হচ্ছে সেই অনলাইনের মাধ্যমেই। এক্স (সাবেক টুইটার) এখন এমন সব পোস্টে সয়লাব, যেখানে মানুষ জানতে চাইছে কীভাবে 'লাইফ ম্যাক্সিং' করা যায় বা ইন্টারনেটের বাইরে জীবনটা উপভোগ করা যায়। অফিসে যাওয়ার পথে আমার ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠা এমনই একটি পোস্টের শুরুটা ছিল—'ফোনটা হাত থেকে রাখুন'। অথচ সেই পরামর্শটাও আমি পড়ছিলাম ফোনের স্ক্রিনেই!
'রেজ বেইট'-এর মতো নতুন শব্দগুলোর সঙ্গে ইন্টারনেটের সম্পর্কটা আসলে ঠিক এমনই। শব্দগুলো আমাদের দুর্দশারই বর্ণনা দেয়। তবে মুশকিল হলো, এগুলো আমাদের সেই দুর্দশা থেকে মুক্তি দেয় না; বরং আমাদের ঘিরে থাকা দুঃখবোধকে আরও স্পষ্টভাবে চিনতে সাহায্য করে মাত্র।
শব্দ অনেক সময় মানচিত্রের মতো কাজ করে, যা আমাদের কোনো ধারণার সীমানা বুঝতে সাহায্য করে। কিন্তু এই নতুন শব্দগুলো আমাদের সংকট থেকে বের হওয়ার পথ দেখাচ্ছে না; বরং আমাদের অসুখী মনের 'উচ্চ রেজল্যুশনের' একটি মানচিত্র তুলে ধরছে শুধু।
'রেজ বেইট' শব্দটি নিজেই এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হতে পারে। ধরুন, আপনি কাউকে বললেন যে এমন একটা নেতিবাচক শব্দকে আমরা অভিধানের চূড়ায় স্থান দিয়েছি—এটা ভেবে আপনি বিরক্ত। তখন তিনি হয়তো বলবেন, শব্দটি তো তার কাজ ঠিকঠাকভাবেই করছে (আপনাকে বিরক্ত করা)!
