না চিনেও তারকাদের ‘বন্ধু’ ভাবার প্রবণতা; যেভাবে কেমব্রিজ ডিকশনারির বর্ষসেরা শব্দ ‘প্যারাসোশ্যাল’
গত ২৬ আগস্ট, ঘড়িতে ঠিক সন্ধ্যা সাতটায় ইনস্টাগ্রামে একটি পোস্টে নিজেদের বাগদানের খবর জানান পপ তারকা টেইলর সুইফট ও অ্যাথলেট ট্র্যাভিস কেলসি। সুইফটের অন্য সব পোস্টের মতো এটিতেও কমেন্ট সেকশন বন্ধ ছিল। তার যৌক্তিক কারণও অবশ্য আছে। পোস্টটি করার কয়েক মিনিট, ঘণ্টা এবং দিনজুড়ে সংবাদমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলল সুইফট-কেলসি বন্দনা। সুইফটের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সেলেনা গোমেজ, প্যাট্রিক মাহেমস থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প—সবাই জানালেন অভিনন্দন।
তবে আসল ঝড় উঠল ভক্তদের মনে। হাজারো ভক্ত এমনভাবে প্রতিক্রিয়া দেখালেন, যেন এটি তাদের নিজেদেরই বোনের বিয়ে! এক ভক্ত লিখলেন, 'আমার প্রিয় বন্ধুর জন্য আমি খুব খুশি!' অথচ সুইফটের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত কোনো পরিচয়ই নেই। আরেকজন লিখলেন, 'খবরটা শুনে আমি অফিসে চিৎকার করে উঠেছি, সহকর্মীরা ভয় পেয়ে দেখতে এসেছেন আমার কী হলো!' আবার অতি আবেগে কারও কান্না বা অসুস্থ হয়ে পড়ার খবরও মিলল মন্তব্যের ঘরে।
অপরিচিত কোনো তারকার প্রতি ভক্তদের এই যে তীব্র আবেগ, বা একপাক্ষিক এই গভীর সম্পর্ক—একে ইংরেজিতে বলা হয় 'প্যারাসোশ্যাল'। আর এই শব্দটিকে ২০২৫ সালের 'ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার' বা বছরের সেরা শব্দ হিসেবে বেছে নিয়েছে ক্যামব্রিজ ডিকশনারি।
অভিধানটির সংজ্ঞা অনুযায়ী, যখন কেউ এমন কোনো বিখ্যাত ব্যক্তির সঙ্গে নিজের গভীর আত্মিক যোগাযোগ অনুভব করেন—যাকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে চেনেনই না, তখন তাকে 'প্যারাসোশ্যাল' সম্পর্ক বলা হয়। ক্যামব্রিজ ডিকশনারির প্রধান সম্পাদক কলিন ম্যাকিনটোশ বলেন, '২০২৫ সালের সময়ের চালচিত্র বোঝাতে এই শব্দটিই সবচেয়ে যুতসই।'
তিনি আরও জানান, সুইফট ও কেলসির বাগদানের পর ক্যামব্রিজ ডিকশনারি এবং গুগলে এই শব্দের অর্থ খোঁজার ধুম পড়ে গিয়েছিল। ম্যাকিনটোশ বলেন, 'ভাষাগত দিক থেকে এটি বেশ মজার। কারণ, শব্দটি আগে কেবল বইপুস্তক বা গবেষণায় একাডেমিক টার্ম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু এখন সাধারণ মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অহরহ শব্দটি ব্যবহার করছেন।'
'প্যারাসোশ্যাল' শব্দটি কিন্তু নতুন নয়। ১৯৫৬ সালে, যখন টেলিভিশনের যুগ সবে শুরু হয়েছে, তখন সমাজবিজ্ঞানী ডোনাল্ড হর্টন ও রিচার্ড ওল প্রথম এই তাত্ত্বিক শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। বসার ঘরে টিভিতে দেখা অভিনেতাদের সঙ্গে দর্শকদের যে একপাক্ষিক সখ্য গড়ে উঠছিল, তা বোঝাতেই তারা এই শব্দের অবতারণা করেন।
প্রায় ৭০ বছর পর এখন পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন হয়েছে। তারকারা এখন আর শুধু টিভি পর্দায় বন্দী নন, সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে তারা ভক্তদের হাতের মুঠোয়। তারকারা নিজেরাই নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনের খুঁটিনাটি শেয়ার করেন। দিনে ২৪ ঘণ্টাই এখন জানা যায় প্রিয় তারকা কখন কী করছেন—তা সে জন্মদিনের পার্টি হোক, বাগদান হোক কিংবা সন্তানের জন্ম।
বিষয়টি নিয়ে 'ফ্যানডম ইজ আগলি: নেটওয়ার্কড হ্যারাসমেন্ট ইন পার্টিসিপেটরি কালচার' (২০২৫) বইয়ের লেখক অধ্যাপক মেল স্ট্যানফিল বলেন, 'মানুষ মনে করে তারা তারকাদের খুব ভালো করে চেনে। এটা পুরোপুরি অযৌক্তিক নয়। তবে সমস্যাটা হয় তখন, যখন তারা আবেগের সীমাটা বুঝতে পারে না।'
অধ্যাপক স্ট্যানফিল এই একপাক্ষিক বা প্যারাসোশ্যাল সম্পর্কের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হিসেবে 'কে-পপ' (কোরিয়ান পপ) তারকাদের কথা উল্লেখ করেন। তার মতে, এই তারকারা সচেতনভাবেই ভক্তদের সঙ্গে এমন সম্পর্ক গড়ে তুলতে উৎসাহিত করেন। তাদের সাফল্যের মূলমন্ত্রই হলো নিজেদের ঘিরে এমন একটি জগত তৈরি করা, যেখানে ভক্তরা আটকে থাকবে।
স্ট্যানফিল বলেন, 'তারা ভক্তদের অনেক তথ্য দিয়ে নিজেদের সঙ্গে যুক্ত রাখার চেষ্টা করেন। এমনকি কোন হোটেলে থাকছেন, সেই রুম নম্বরও শেয়ার করেন। ফলে মানুষ এখন আর শুধু বিটিএস ব্যান্ডের ভক্ত নয়, তারা দলটির একেকজন গায়কেরও ব্যক্তিগত ভক্ত। তাদের সম্পর্কে খুঁটিনাটি জানা এবং বাস্তবে তাঁদের দেখা পাওয়াটা এখন এই বাণিজ্যেরই অংশ।'
ভক্তদের মানসিকতার এই পরিবর্তনকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন স্ট্যানফিল। তিনি বলেন, 'আগে আপনি কোনো ব্যান্ডের গান, সিনেমা বা চরিত্রের ভক্ত হতেন। অর্থাৎ নিজের পছন্দের কাজটিকে ভালোবাসতেন। কিন্তু এখন আপনার পছন্দের মাধ্যম (অ্যালবাম বা সিনেমা) এবং এর নির্মাতার (ব্যক্তি) মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ফলে জন্ম নিচ্ছে ব্যক্তিপূজা বা ফ্যানাটিজম, যার ভালো-মন্দ—দুটি দিকই আছে।'
'প্যারাসোশ্যাল' সম্পর্কের ভালো দিকটা হলো, এই সম্পর্কগুলো পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, মায়া আর আনন্দের অনুভূতি দেয়। বার্সেলোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও মনোবিজ্ঞানী হোসে র্যামন উবিয়েতোর মতে, 'বর্তমান যুগে মানুষ যত বেশি সংযুক্ত (হাইপার-কানেকটেড) হচ্ছে, ঠিক ততটাই বাড়ছে বিচ্ছিন্নতা। এই সময়ে একাকিত্ব কাটাতে এমন সম্পর্ক একটা আশ্রয় হিসেবে কাজ করতে পারে।'
তারকাদের জন্য বিষয়টি লাভজনক। ভক্তদের এই ভালোবাসার ওপর ভর করেই তাদের স্পন্সরশিপ বা বড় বড় চুক্তি মেলে, পকেট ভারী হয়। বিনিময়ে ভক্তরা পায় একধরনের সঙ্গ, তা সেটা কাল্পনিকই হোক না কেন।
সমস্যা শুরু হয় তখন, যখন এই আবেগ মাত্রা ছাড়িয়ে অন্ধ ভালোলাগা বা বিষাদের জন্ম দেয়। মনোবিজ্ঞানী উবিয়েতোর মতে, 'যারা মানসিকভাবে দুর্বল, নিঃসঙ্গ কিংবা আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগছেন, তাদের ক্ষেত্রে এটি বিচ্ছিন্নতা আর আবেগীয় নির্ভরতা তৈরি করতে পারে।' শুধু মানুষ নয়, এখনকার এআই বা চ্যাটবটগুলোর সঙ্গেও মানুষের এমন আসক্তি তৈরি হতে দেখা যাচ্ছে।
এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে পাতা হয় প্রতারণার ফাঁদও। যেমন—কিছুদিন আগেই 'ভুয়া ব্র্যাড পিট' সেজে অনলাইনে হাজার হাজার ডলার হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। নারীরা ভেবেছিলেন, তারা আসলেই বিখ্যাত এই অভিনেতার সঙ্গে প্রেম করছেন, কিন্তু আদতে তারা প্রতারকদের খপ্পরে পড়েছিলেন।
ভক্তের এমন অন্ধ আবেগ তারকার জন্যও বিপদের কারণ হতে পারে। অতি সম্প্রতি, গত ১৩ নভেম্বর সিঙ্গাপুরে 'উইকেড: ফর গুড' সিনেমার প্রিমিয়ারে ঘটে যাওয়া ঘটনাটিই ধরা যাক। সেখানে জনসন ওয়েন নামের এক ভক্ত হঠাৎ করেই পপ তারকা আরিয়ানা গ্রান্দের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ওই ভক্ত আগে থেকেই লিখেছিলেন যে তিনি তার 'সেরা বন্ধু আরিয়ানা'র সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন। শান্তি ভঙ্গের দায়ে ওয়েনকে ৯ দিনের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
স্পেনের 'ম্যাপফ্রে ফাউন্ডেশন' এবং 'ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব লা রিওজা' (ইউএনআইআর) ২০২৩ সালে একটি জরিপ চালিয়েছিল। জরিপের ফলাফলের দিকে তাকালে এই 'প্যারাসোশ্যাল' বা একপাক্ষিক সম্পর্কের গভীরতা কিছুটা আঁচ করা যায়। এতে দেখা গেছে, স্পেনের ১১ থেকে ১৭ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদের ৬২ দশমিক ৪ শতাংশ অন্তত একজন 'ইনফ্লুয়েন্সার'কে অনুসরণ করে, যাকে তারা অনুপ্রেরণার উৎস বলে মনে করে। এমনকি ২৬ শতাংশ কিশোর-কিশোরী ওই ইনফ্লুয়েন্সারকে নিজের 'বন্ধু' বলেও ভাবে।
মনোবিজ্ঞানী উবিয়েতো এই মানসিক অবস্থার ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, 'সংযোগ আর সম্পর্কের মধ্যে পার্থক্য বোঝাটা খুব জরুরি। প্যারাসোশ্যাল হলো একধরনের সংযোগ, যা একপাক্ষিক। ধরুন, আপনি ভাবছেন এই ইন্টারনেট তারকা আপনার বন্ধু; কিন্তু তার কোনো ধারণাই নেই আপনি কে।'
'প্যারাসোশ্যাল' বিষয়টি আরও পরিষ্কার করতে ক্যামব্রিজ ডিকশনারি ব্রিটিশ গায়িকা লিলি অ্যালেনের উদাহরণ টেনেছে। অভিনেতা ডেভিড হারবারের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর নিজের নতুন অ্যালবামে সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে খোলাখুলি কথা বলেছেন লিলি। এরপরই তার প্রতি সহমর্মিতা জানাতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন ভক্তরা। লিলির ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটি জানতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন তারা, যেন গায়িকার দুঃসময়ে পাশে দাঁড়ানোই তাঁদের দায়িত্ব। ডিকশনারির সম্পাদকের দেওয়া এ ধরনের আরেকটি বড় উদাহরণ অবশ্যই টেইলর সুইফট।
ভক্তদের এই মানসিকতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অধ্যাপক স্ট্যানফিল বলেন, 'ঐতিহ্যগতভাবে ভক্ত বলতে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিটলস ব্যান্ডের সেই দৃশ্য—কনসার্টে কিশোরী মেয়েদের চিৎকার-চেঁচামেচি, তাই না? কিন্তু ভক্তরা আসলে সাধারণ মানুষ, যারা কোনো অডিও-ভিজ্যুয়াল কনটেন্ট বা শিল্পকর্মটিকে খুব ভালোবাসে। আর এই ভালোবাসা থেকেই তারা সমমনা অন্য মানুষদের নিয়ে একটি দল বা কমিউনিটি গড়ে তোলে।'
'প্যারাসোশ্যাল' সম্পর্ক কি শুধুই কনসার্টে চিৎকার করা কিশোর-কিশোরীদের আবেগের বিষয়? একদমই না। ফুটবল মাঠে প্রিয় খেলোয়াড় সহজ সুযোগ মিস করলে বা দল হারলে যখন গ্যালারিতে বা টিভির সামনে বসা প্রাপ্তবয়স্ক ভক্তের চোখ ভিজে যায়—সেটাও কিন্তু এই একপাক্ষিক সম্পর্কেরই বহিঃপ্রকাশ। একবার শব্দটির অর্থ বুঝে গেলে দেখবেন, আপনার চারপাশেই এর উদাহরণ ছড়িয়ে আছে।
এই জগত থেকে বের হওয়াটাও বেশ কঠিন। কারণ, এখন তারকারা তাদের জনপ্রিয়তা ধরে রাখার কৌশল হিসেবেই ভক্তদের নিজেদের জীবনের অংশ করে নেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই। নিত্যনতুন সব এআই এমনভাবে সামনে আসছে, যেন মনে হয় রক্তমাংসের মানুষের চেয়ে ওরাই আমাদের আবেগ বেশি ভালো বোঝে।
মনোবিজ্ঞানী উবিয়েতো সতর্ক করে বলেন, 'সমস্যাটা তখনই হয়, যখন আমরা মনে করি এই কাল্পনিক সম্পর্ক আমাদের মনের শূন্যতা পূরণ করবে। অথচ এই শূন্যতা পূরণ করার কথা ছিল বাস্তব কোনো সম্পর্কের।'
তারকার প্রতি ভালোলাগা বা মুগ্ধতা থাকাটা ক্ষতিকর বা দোষের কিছু নয়, এটা খুবই স্বাভাবিক মানবিক প্রবৃত্তি। কিন্তু বিপদ বাড়ে তখনই, যখন আমরা এর বাইরে আর কিছু দেখতে পাই না; যখন আমরা আশপাশের সব ভুলে যাই। সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হয়, যখন আমরা ভাবতে শুরু করি যে আমাদের বাস্তবে কোনো ভালো বন্ধুর প্রয়োজন নেই। অথচ দিন শেষে এই বাস্তব বন্ধুই হয়তো আপনাকে সতর্ক করতে পারে যে, আপনার এই কাল্পনিক সম্পর্কটা একটু বেশিই বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।
