১৯৯২ সালের পর প্রতিরক্ষাখাতের ঠিকাদারদের ব্যবসার রেকর্ড বাড়বাড়ন্ত চলতি দশকে
বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ-সংঘাত বাড়ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সামরিক ব্যয়। ২০২৪ সালে বৈশ্বিক প্রতিরক্ষা ব্যয় ৯% বেড়ে রেকর্ড ২ লাখ ৭০ হাজার কোটি ডলারে পৌঁছেছে বলে জানিয়েছে স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিপ্রি)-র সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন। ১৯৯২ সালের পর যা সবচেয়ে বড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধি সামরিক ব্যয়ে।
গত তিন বছর ধরে বিশ্বের সামরিক ব্যয় দ্রুত বাড়ছে, যার মূল কারণ রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসন এবং গাজায় ইসরায়েল-হামাসের যুদ্ধসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের একাধিক সংঘাত।
ব্যয়ের এই উল্লম্ফনের ফলে বৈশ্বিক প্রতিরক্ষা শিল্পে রাজস্ব আয়েও রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে।
সিপ্রি জানায়, বিশ্বের শীর্ষ ১০০ প্রতিরক্ষা কোম্পানি ২০২৪ সালে ৬৭৯ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে। সিপ্রি ২০০২ সাল থেকে এসব কোম্পানির হিসাব অনুসরণ শুরু করার পর থেকে এটাই সর্বোচ্চ আয়ের রেকর্ড। এর মধ্যে শীর্ষ পাঁচটি কোম্পানিই শুধু আয় করেছে ২১৪ বিলিয়ন ডলার, যা শীর্ষ ১০০ প্রতিরক্ষা কোম্পানির মোট রাজস্বের এক–তৃতীয়াংশ।
বিশ্ব অস্ত্রসজ্জায় ধাবিত—ইউরোপে গতি সর্বাধিক
ইউরোপের প্রতিরক্ষা ব্যয় ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালে ১৭ শতাংশ বেড়েছে— যা অন্যান্য সব অঞ্চলের তুলনায় বেশি। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের আগে টানা তিন বছর ইউরোপে এ ব্যয় বৃদ্ধির গড় হার ছিল মাত্র ৫ শতাংশ।
ইউক্রেন যুদ্ধ অব্যাহত থাকায় ইউরোপের ব্যয় বিশেষভাবে বেড়েছে। রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দেশগুলোর বৃদ্ধিই ছিল সবচেয়ে তীব্র—পোল্যান্ডে ৩১ শতাংশ, আর রোমানিয়ায় ৪৩ শতাংশ। ফ্রান্স, জার্মানি এবং যুক্তরাজ্যের মতো বড় অর্থনীতিগুলোও সামরিকায়নে ব্যয় বাড়িয়েছে।
ইউক্রেন ২০২৪ সালে সামরিক খাতে খরচ করেছে ৬৭ বিলিয়ন ডলার, যা দেশটির মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ৩৪ শতাংশ।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিও বৈশ্বিক প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রেখেছে—এ অঞ্চলে সামরিকখাতে ব্যয় বেড়েছে ১৫ শতাংশ, যেখানে গাজায় যুদ্ধ শুরুর আগের তিন বছরে গড়ে তা মাত্র ০.৪ শতাংশ হারে বেড়েছিল।
তবুও যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা বাজেট ইউরোপের ব্যয়কেও ছাপিয়ে গেছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা চীনের ব্যয় হচ্ছে ৩১৮ বিলিয়ন ডলার।
প্রতিরক্ষা ঠিকাদারদের কাছে অর্থের স্রোত
সামরিক বাজেট বাড়ার ফলে বিশ্বব্যাপী অস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিপুল আয় করলেও, এ আয়ের বণ্টন সব অঞ্চলে সমান হয়নি।
মার্কিন ও ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলো সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে। ইউরোপের ব্যয় বৃদ্ধির ফলে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানিগুলোর রাজস্বও বেড়েছে।
চীন যেখানে একমাত্র ব্যতিক্রম—সেখানে ২০২৪ সালে প্রতিরক্ষাখাতে রাজস্ব কমেছে, কারণ দুর্নীতি অভিযোগে এখাতে বড় বড় ক্রয়াদেশ বিলম্বিত বা বাতিল হয়েছে।
প্রতিরক্ষা খাতের রেকর্ড মুনাফা বিনিয়োগকারীরাও লক্ষ্য করেছে। প্রতিরক্ষাখাতের বাজার সূচকগুলো পুঁজিবাজারের অন্যান্য সাধারণ সূচকের চেয়ে বেশি গতি দেখিয়েছে।
এমএসসিআই এসি ওয়ার্ল্ড অ্যারোস্পেস এন্ড ডিফেন্স ইনডেক্স— সাধারণ এমএসসিআই এসি ওয়ার্ল্ড ইনডেক্স এর চেয়ে দ্বিগুণ হারে বেড়েছে। ইউরোপের স্টোক্স অ্যারোস্পেস এন্ড ডিফেন্স এবং যুক্তরাষ্ট্রের এসএন্ডপি অ্যারোস্পেস এন্ড ডিফেন্স সূচকও তাদের সমগোত্রীয় সূচকের চেয়ে এগিয়ে ছিল।
আমেরিকান কোম্পানিগুলো শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে, তবে প্রতিযোগিতা বাড়ছে
২০১৫ সালে শীর্ষ ১০০ প্রতিরক্ষা কোম্পানির মোট রাজস্ব ছিল ৫৩৮ বিলিয়ন ডলার; এর ৫৩ শতাংশ আয় করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো।
২০২৪ সালে শীর্ষ ১০০ কোম্পানির রাজস্ব বেড়ে দাঁড়ায় ৬৭৯ বিলিয়ন ডলার—২০১৫ সালের তুলনায় যা ২৬ শতাংশ বেশি। এ সময়ে চীনকে বাদে— ইউরোপ,এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের কোম্পানিগুলি বিশ্ববাজারে অংশীদারত্ব বাড়িয়েছে, যদিও যুক্তরাষ্ট্র এখনও সবচেয়ে বড় খেলোয়াড়।
বিশ্বের শীর্ষ ছয় প্রতিরক্ষা কোম্পানির মধ্যে পাঁচটি যুক্তরাষ্ট্রের—লকহিড মার্টিন, নর্থরপ গ্রুমান, আরটিএক্স, বোয়িং ও জেনারেল ডায়নামিক্স। বাকি একটি হলো যুক্তরাজ্যের— বিএই সিস্টেমস।
শীর্ষ পাঁচ মার্কিন কোম্পানি ২০২৪ সালে বিশ্বের মোট প্রতিরক্ষা রাজস্বের ৩১ শতাংশ অর্জন করেছে।
২০২০–২০২৪ সময়ে তারা একত্রে ৭৭০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের মার্কিন সরকারের প্রতিরক্ষা চুক্তি পেয়েছে—যা পেন্টাগনের মোট ২.৪ ট্রিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা কার্যাদেশ বা চুক্তির এক–তৃতীয়াংশ।
