পাকিস্তানে চীনের সোলার প্যানেলের বিপ্লব! বিয়েতেও এখন যৌতুক সোলার প্যানেল!
গত বছর গ্রীষ্মে যখন তাপমাত্রা রেকর্ড ভেঙে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে পৌঁছায়, তখন আর সহ্য করতে পারেননি পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের লাহোরের অবসরপ্রাপ্ত রেলওয়ে কর্মী মোহাম্মদ মুনির। আয়ের এক-চতুর্থাংশ বিদ্যুৎ বিলে চলে যাওয়ার পরও নিয়মিত লোডশেডিংয়ের কারণে তার পরিবারকে ফ্যানের বাতাস ছাড়াই থাকতে হতো। মোটেও ধনী নন মুনির; স্থানীয় এক কারখানায় পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে কাজ করে পাওয়া সামান্য আয়, অবসর ভাতা এবং নিজের বাড়িটিই তার সম্বল। শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেই পরিস্থিতির হাল ধরেন এবং চীন থেকে আমদানি করা সোলার প্যানেল বাড়ির ছাদে স্থাপন করেন।
মুনিরের মতো অসংখ্য পাকিস্তানি এখন একই পথে হাঁটছেন। চীনের সবুজ প্রযুক্তি বিশ্বের অনেক দেশের দৃশ্যপট, বাজার এবং ভূ-রাজনীতি বদলে দিচ্ছে—যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হয়ে উঠেছে পাকিস্তান। চলতি বছর দেশটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সোলার প্যানেল আমদানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে।
পাকিস্তান এখন 'গ্লোবাল সাউথ' বা উন্নয়নশীল বিশ্বের সবুজ জ্বালানি রূপান্তরের এক পরীক্ষাগার। একই সঙ্গে এটি চীনের জন্যও একটি পরীক্ষা যে, তারা কেবল এই রূপান্তরের সরঞ্জাম জোগানদাতা হিসেবেই থাকবে, নাকি এতে নেতৃত্ব দেবে।
পাকিস্তানের যেকোনো প্রান্তে ভ্রমণ করলেই এখন চোখে পড়ে সোলার প্যানেল। পাকা বাংলো বাড়ি থেকে শুরু করে মসজিদ, খামার কিংবা রাস্তার পাশের দোকান—সবখানেই সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ট্রলির ওপর সোলার প্যানেল বসিয়ে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে বিদ্যুৎ নেওয়ার দৃশ্যও দেখা যায়। এমনকি বিয়ের যৌতুকেও এখন সোলার প্যানেল অন্তর্ভুক্ত করার প্রবণতা বাড়ছে।
বাণিজ্য পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে পাকিস্তান চীন থেকে বার্ষিক সোলার প্যানেল আমদানি প্রায় পাঁচ গুণ বাড়িয়ে ১৬ গিগাওয়াটে উন্নীত করেছে। ২০২৫ সালের প্রথম নয় মাসেই আমদানি করা হয়েছে আরও ১৬ গিগাওয়াট সমমানের প্যানেল। ধারণা করা হচ্ছে, এ বছর শেষে সোলার আমদানির মোট পরিমাণ পাকিস্তানের জাতীয় বিদ্যুৎ ব্যবস্থার মোট উৎপাদন ক্ষমতার সমান হবে। অথচ কিছুদিন আগেই চীনের বৈশ্বিক 'বেল্ট অ্যান্ড রোড' অবকাঠামো উদ্যোগের আওতায় বিপুল ঋণে চারটি নতুন ঝকঝকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র যুক্ত হয়েছে দেশটির জাতীয় গ্রিডে।
জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়
২০২২ সালের পর থেকে পাকিস্তানের বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় ধসে পড়েছে। জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ ব্যবহারের হার প্রায় ১২ শতাংশ কমে গেছে। সোলার ব্যবহারকারীরা এখন চীনের তৈরি ব্যাটারিও ব্যবহার করছেন, যাতে সূর্যাস্তের পরও বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। ফলে গ্রিডের ওপর নির্ভরতা আরও কমার সম্ভাবনা প্রবল।
এদিকে বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর অবকাঠামোগত খরচ কমেনি। বরং গ্রাহকদের প্রত্যাশিত চাহিদা মেটাতে চীন থেকে নেওয়া ঋণের বোঝা তাদের ঘাড়ে চেপে বসেছে। অথচ সেই চাহিদা এখন পূরণ করছে ছাদের সোলার প্যানেল।
রাজস্ব কমতে থাকায় অবশিষ্ট গ্রাহকদের বিল বাড়ছে, আর বিল বাড়লে আরও মানুষ সোলারে ঝুঁকছেন। ফলে তৈরি হচ্ছে বিদ্যুৎ খাতের এক চক্রাকার সংকট- 'ইউটিলিটি ডেথ স্পাইরাল' বা বিদ্যুৎ পরিষেবার মৃত্যুকূপ। তার ওপর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে এখন উদ্বৃত্ত সক্ষমতা থাকায় পরিস্থিতি 'কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা'র মতো হয়েছে।
সরকারের পদক্ষেপ ও চীনের ভূমিকা
এই উদ্বেগের কারণে পাকিস্তান সরকার গত জুনে আমদানিকৃত সোলার প্যানেলের ওপর ১০ শতাংশ বিক্রয় কর আরোপ করেছিল, কিন্তু তাতে বিশেষ লাভ হয়নি। প্যানেলের চাহিদা তুঙ্গে এবং বিদ্যমান প্যানেল থেকে বাড়তি সুবিধা পেতে চীনা ব্যাটারির আমদানিও বেড়েছে।
পাকিস্তানের জ্বালানিমন্ত্রী আওয়াইজ লেঘারি 'দি ইকোনমিস্ট'কে বলেন, 'ব্যাটারি স্টোরেজ সস্তা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ সেদিকেই ঝুঁকবে: এটা সময়ের ব্যাপার।'
তিনি জানান, কয়লাভিত্তিক প্রকল্পগুলোর চুক্তি পুনর্গঠন নিয়ে চীনের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন। এছাড়া পাকিস্তানের গ্রিড আধুনিকায়ন এবং বিদ্যুৎ বাজার শক্তিশালী করতে চীন ও অন্যান্য দেশের কাছে বিশেষজ্ঞ সহায়তা চাইছে ইসলামাবাদ। তাছাড়া দেশটি এখন চীনা কোম্পানিকে স্থানীয় পর্যায়ে সোলার প্যানেল, ব্যাটারি ও অন্যান্য সবুজ প্রযুক্তির কারখানা স্থাপনে উৎসাহ দিচ্ছে। এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করা হলে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় 'যথাযথ কর্তৃপক্ষের' সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলে।
ফিনল্যান্ডভিত্তিক গবেষণা সংস্থা 'সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার'-এর লরি মিলিভিরতা বলেন, 'পাকিস্তান মূলত একটি টেস্ট কেস (পরীক্ষামূলক উদাহরণ)। এটি প্রমাণ করে যে, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দীর্ঘ অনুমতি প্রক্রিয়া ছাড়া ভোক্তারা এবং বাণিজ্যিক ব্যবহারকারীরা যখন প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ পান, তখন পরিবর্তন অনেক দ্রুত ঘটে।'
জ্বালানিমন্ত্রী লেঘারির প্রস্তাবে চীন কীভাবে সাড়া দেয়, তা শুধু পাকিস্তানের জন্য নয়, পুরো গ্লোবাল সাউথের জ্বালানি রূপান্তরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সস্তা সোলারের সুবিধা কাজে লাগাতে চীন দেশগুলোকে যত বেশি সহায়তা করবে এবং সরকার ও রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্ষতি কমাতে যত এগিয়ে আসবে, ভবিষ্যতে তাদের রপ্তানি বাজার তত ভালো হবে এবং এর মাধ্যমে তারা প্রচুর 'সফট পাওয়ার' অর্জন করবে।
সিল্ক রোড থেকে সিলিকন রোড
বিদ্যুৎ উৎপাদনে সোলার ও বায়ুশক্তির ব্যবহার বাড়ানোর দৌড়ে গ্লোবাল সাউথ বা উন্নয়নশীল দেশগুলো এখন গ্লোবাল নর্থ বা উন্নত দেশগুলোর চেয়ে এগিয়ে। ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য শক্তি যোগ করার ক্ষেত্রেও তারা উন্নত বিশ্বকে পেছনে ফেলতে পারে। এরই প্রমাণ—প্রথমবারের মতো গ্লোবাল সাউথে চীনের সোলার রপ্তানি ৩২% বেড়ে ১২৬ গিগাওয়াটে পৌঁছেছে, যা গ্লোবাল নর্থে রপ্তানি হওয়া ১১৬ গিগাওয়াটের চেয়ে বেশি (২০২৩ সালের তুলনায় ৬% কমেছে)। ধনী দেশগুলোর বাণিজ্য বাধা এর একটি কারণ হলেও, সোলার বিদ্যুৎ এখন নতুন করে সক্ষমতা বাড়াতে চাইলে সবচেয়ে সস্তা সমাধান—এটিও দক্ষিণে চাহিদা বাড়ার বড় কারণ।
আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা (আইইএ) বলছে, ২০২৪-২০৩০ সালের মধ্যে এশিয়া, লাতিন আমেরিকা ও সাব-সাহারান আফ্রিকায় সবুজ শক্তির সক্ষমতা দ্বিগুণেরও বেশি বাড়বে। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় এই বৃদ্ধি হবে তিনগুণ। শুধু ভারতেই এই সময়ে ৩৫০ গিগাওয়াট নবায়নযোগ্য শক্তি যুক্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এভাবে দ্রুত পরিবর্তন আসায় পাকিস্তানের মতো অনেক দেশ বাধা তৈরি করার পথেও হাঁটছে। চীন থেকে বিপুল পরিমাণ সোলার প্যানেল আসার পর গ্রিডের স্থিতিশীলতায় সমস্যা দেখা দেওয়ায় দক্ষিণ আফ্রিকা গত বছর ১০% শুল্ক বসিয়েছে। সোলার মডিউলের অন্যতম বৃহৎ আমদানিকারক ব্রাজিল শুল্ক বাড়িয়ে ২৫% করেছে। নাইজেরিয়া তো আমদানিকৃত সোলার মডিউল পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার কথাও ভাবছে।
চীন এর জবাবে দেশের বাইরে সোলার ও গ্রিন-টেক উৎপাদন বাড়ানোর দিকে ঝুঁকছে। জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা অনুযায়ী, ২০২২ সাল থেকে চীনা গ্রিন-টেক কোম্পানিগুলো বিদেশে ২০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। এর অর্ধেকই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়—উন্নত দেশগুলোর শুল্ক এড়ানো এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাড়তি শুল্ক মোকাবিলা করাই এসব বিনিয়োগের প্রধান কারণ। এতে শুধু সোলার নয়, ব্যাটারি, বৈদ্যুতিক যান এবং সবুজ হাইড্রোজেনও রয়েছে।
তবে সম্প্রতি বিনিয়োগের এই ধারা কিছুটা কমেছে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে—চীনের দেশীয় বাজারে সোলারের অতিরিক্ত সরবরাহ এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও কিছু দেশের নতুন শুল্ক আরোপের ঝুঁকি।
বিশ্বব্যাপী সবুজ জ্বালানির রূপান্তর ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে চীন সরকারের উদ্যোগও ততটা শক্তিশালী নয়। ২০২১ সালে শি জিনপিং ঘোষণা করেছিলেন—বেল্ট অ্যান্ড রোডের আওতায় চীন নতুন কয়লা প্রকল্পে আর সমর্থন দেবে না। কিন্তু বাস্তবে চীন কয়লা পুরোপুরি ছাড়েনি এবং বিভিন্ন দেশে জীবাশ্ম জ্বালানি প্রকল্প চালু রেখেছে। তারপরও গবেষকদের হিসেবে—২০২৪ সালে বেল্ট অ্যান্ড রোডের নবায়নযোগ্য শক্তি বিনিয়োগ, ঋণ এবং নির্মাণ চুক্তি মিলিয়ে ১১.৮ বিলিয়ন ডলার হয়েছে—২০২৩ সালের তুলনায় ৬০% বেশি।
আগামী দশকে চীন উন্নয়নশীল বিশ্বের বিদ্যুৎ অবকাঠামোর প্রযুক্তিগত মান ঠিক করে দিতে চায়। এতে সেই সব দেশের সিস্টেম চীনা প্রযুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে উঠবে, ভবিষ্যতে উৎস বদলাতে বেশি খরচ পড়বে—ফলে চীনের প্রভাবও বাড়বে। জলবায়ু আলোচনাতেও চীন আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারবে, যেখানে দরিদ্র দেশগুলো সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত।
এ সব সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগাতে হলে চীনকে আরও প্রযুক্তি হস্তান্তর করতে হবে, যাতে স্বাগতিক দেশগুলো নিজেরাই সবুজ জ্বালানির শিল্প গড়ে তুলতে পারে। পাশাপাশি গ্রিন ফাইন্যান্স, গ্রিড আধুনিকায়ন এবং জ্বালানি নীতি প্রণয়নে সাহায্য বাড়াতে হবে।
পাকিস্তানের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ লরি মিলিভিরতা মনে করেন—চীনের উচিত পাকিস্তানের গ্রিড শক্তিশালী করতে সহায়তা করা এবং ব্যাটারি স্টোরেজে আরও বিনিয়োগ করা।
পাকিস্তান সোলার অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান ওয়াকাস মুসা বলেন, চীন তাদের দেশে বা অন্য বাজারে যেভাবে সোলার ছড়িয়ে দিয়েছে, সেই অভিজ্ঞতা শেয়ার করা দরকার। তার ভাষায়, 'বর্তমানে আমাদের অনেক সাফল্যের গল্প আছে, কিন্তু সেগুলো একে অপরের থেকে অনেক দূরে এবং কেউ সেগুলোকে এক করছে না।'
তিনি চান চীন বড় আকারের ব্যাটারি প্রকল্পের জন্য নতুন অর্থায়ন মডেল খুঁজুক এবং পাকিস্তানে ব্যাটারি উৎপাদনে বিনিয়োগ করুক।
তবে চীনের গোপনীয় নীতি সংস্কৃতি এবং নিজেদের জ্বালানি রূপান্তরের জটিলতার কারণে তারা কতটা কার্যকর দিকনির্দেশনা দেবে—এ নিয়ে সংশয় আছে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতাও চীনকে আরও সতর্ক করে রেখেছে। তবুও, বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পগুলো প্রত্যাশিত ফল না দেওয়ায় পাকিস্তানের সোলার বিপ্লবকে সফল একটি উদাহরণ বানানোর আগ্রহ এখন চীনের বেশি।
পাকিস্তানের অলাভজনক সংস্থা রিনিউয়েবলস ফার্স্ট-এর মোহাম্মদ মোস্তফা আমজাদ বলেন, 'সময়ের মধ্যে গ্রিড আধুনিকায়ন করতে পারলে এটি দুর্দান্ত সাফল্যের গল্প হবে। আর যদি না পারে, তবে এটি হবে কী করা উচিত নয়—তার নমুনা।'
