ইউক্রেন আরও বিপজ্জনক সময়ে প্রবেশ করছে, ন্যাটো বা আমেরিকা কি হস্তক্ষেপ করবে?
ইউক্রেন এখন প্রকৃত অর্থেই বিপদজ্জনক সময়ে প্রবেশ করছে। তাদের সেনাবাহিনীর জনবল ও সরঞ্জাম দ্রুত নিঃশেষ হয়ে আসছে; আরও গুরুতর বিষয় হলো—সেনাবাহিনীর কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ এখন রাশিয়ান বাহিনীর অবরোধে আটকা পড়েছে—পোকরোভস্ক, জাপোরিঝঝিয়াসহ আরও কয়েকটি অঞ্চলে। একই সময়ে রাশিয়া অব্যাহতভাবে ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোতে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। কোনো এক পর্যায়ে দেশটির স্বাভাবিক সেবা কার্যক্রম পুরোপুরি ভেঙে পড়বে—এটাও এখন স্পষ্ট।
পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো—যাদের মূল্যায়ন অনেক সময়ই তাদের রাজনৈতিক কর্তাদের প্রত্যাশার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করে সাজানো হয়—এখন বাস্তবতা বুঝতে শুরু করেছে: ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে ভবিষ্যতের অক্ষর লেখা হয়ে গেছে। ইউক্রেনের সেনাবাহিনী কতদিন পর্যন্ত সমন্বিত সংগঠন হিসেবে টিকে থাকতে পারবে তা অনিশ্চিত। দেশজুড়ে ব্যাপক পলায়ন, উচ্চ হতাহতের সংখ্যা সাধারণ মানুষের কাছেই এখন ওপেন সিক্রেট—যারা যেভাবেই হোক এই যুদ্ধের মূল্য দিচ্ছে।
এদিকে ইউক্রেন তাদের অতি-সক্রিয় গোপন সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করে ইউরোপজুড়ে এমন সব উসকানি তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে, যার মাধ্যমে যুদ্ধকে বৃহত্তর পরিসরে ছড়িয়ে দিয়ে নিজেদের সরকারকে রক্ষা করা যাবে—এমনটাই পশ্চিমা বিশ্লেষকদের ধারণা।
দুটি সাম্প্রতিক ঘটনা যেন এই পরিস্থিতির উন্মত্ততাকেই ফুটিয়ে তোলে।
প্রথমটি হলো ওয়ারশ–লুবলিন রেললাইনে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা—যে রুট দিয়ে বিপুল পরিমাণ পশ্চিমা সামরিক সহায়তা ইউক্রেনে পাঠানো হয়ে থাকে। পোল্যান্ড প্রথমে রাশিয়াকে অভিযুক্ত করে বলেছিল এটি ছিল "অভূতপূর্ব নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড।" কিন্তু পরে পোলিশ প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড টাস্ক পুরো ঘটনার বর্ণনা বদলে দেন। ঘটনাস্থলে নাটকীয় সফরের পর রাশিয়াকে দোষারোপ করলেও টাস্ক পরে জানান—নাশকতাটি ঘটিয়েছে ইউক্রেনীয়রা। তবে তার দাবি, তারা নাকি রুশ গোয়েন্দাদের সহায়তায় এটি করেছে। টাস্ক এ সহযোগিতার প্রমাণ দিতে পারবেন কি না—সেটি এখনো দেখার বিষয়।
দ্বিতীয় ঘটনাটি আরও বিস্ময়কর। রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা- এফএসবি দাবি করছে, তারা ইউক্রেনের একটি হত্যাচেষ্টা পরিকল্পনা নস্যাৎ করেছে। এর লক্ষ্য ছিলেন রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের বর্তমান সচিব ও চেয়ারম্যান এবং ২০১২ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী থাকা সের্গেই শোইগু। রুশ পত্রিকা মস্কভস্কি কোমসোমোলেতস এসব তথ্য প্রকাশ করেছে।
এছাড়াও হাঙ্গেরির বৃহত্তম তেল শোধনাগার স্যাজহালোমবাত্তার বিরুদ্ধে একটি হামলার চেষ্টা—যেখানে রুশ তেল 'দ্রুজবা' পাইপলাইন দিয়ে পৌঁছায়—তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। পাইপলাইনটি আগেও ইউক্রেনের টার্গেটে ছিল। পাশাপাশি ইউরোপের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা, অস্ত্র কারখানা ও ঘাঁটির কাছে অচেনা ড্রোন উড়তে দেখা যাওয়ার ঘটনা বারবার ঘটছে। প্রমাণ ছাড়াই ইউরোপীয় দেশগুলো এগুলো রাশিয়ার বলে ধরে নিলেও পোল্যান্ডের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা ইঙ্গিত দিচ্ছে—এসবও ইউক্রেনের উসকানি হতে পারে।
এর পেছনের যুক্তি খুব সরল: যুদ্ধে ইউক্রেনের টিকে থাকার সম্ভাবনা এখন অত্যন্ত ক্ষীণ। তাই দেশটি মরিয়া হয়ে চাইছে—ন্যাটো যাতে সামরিক হস্তক্ষেপে বাধ্য হয় এবং ইউক্রেনকে সামরিক বিপর্যয় থেকে টেনে তোলে।
কিন্তু ন্যাটোর যে তেমন প্রস্তুতি নেই, তা বহুদিন ধরেই স্পষ্ট। ন্যাটোর মজুদে যথেষ্ট অস্ত্র নেই, ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে মোতায়েনযোগ্য সেনাদল সীমিত, ড্রোন বা আধুনিক যুদ্ধসামগ্রীও পর্যাপ্ত নয়—যা একটি বড় অভিযানে অপরিহার্য। এদিকে ইউক্রেনের বাহিনী প্রায় নিঃশেষ, আর রাশিয়ার প্রায় সাত লাখ সৈন্য দীর্ঘ ফ্রন্টজুড়ে মোতায়েন রয়েছে—এ অবস্থায় ন্যাটোর কয়েকটি ব্রিগেড দিয়ে কীভাবে যুদ্ধ করা সম্ভব? ন্যাটোর আধুনিক যুদ্ধবিমান থাকলেও রাশিয়ার বহুস্তরীয় বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এগুলোর সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।
এর ওপর আছে যুদ্ধের নতুন বাস্তবতা—ড্রোন, গ্লাইড বোমা ও নির্ভুল ক্ষেপণাস্ত্র যেখানে লড়াইয়ের প্রথম সারি নির্ধারণ করছে। ন্যাটোর সেনারা এই ধরনের যুদ্ধ পরিবেশে প্রশিক্ষিত নয়। গুঞ্জন আছে—ফ্রান্স নাকি তাদের বিমান বাহিনীর পাইলটদের ইউক্রেনে পাঠাবে, তবে তারা ফরাসি ইউনিফর্ম পরবে না। রাশিয়ারা কোরিয়া যুদ্ধে ও পরবর্তীতে মিশরে ১৯৭০ সালে এমন কৌশল ব্যবহার করেছিল। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁর মধ্যে ১০০–রও বেশি রাফাল যুদ্ধবিমান কেনার একটি লেটার অব ইন্টেন্ট সই হলেও, এর খরচ বহন করবে কে—তা স্পষ্ট নয়।
মূল প্রশ্নটি যুক্তরাষ্ট্রকে ঘিরে: ইউক্রেন বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে, যুক্তরাষ্ট্র কি হস্তক্ষেপ করবে? বিশেষত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কি মার্কিন সেনা ইউক্রেনে পাঠাবেন?
যদি পাঠান—তা সরাসরি ইউরোপ ও এর বাইরেও বড় যুদ্ধ ডেকে আনবে। কিন্তু তাতেও কি ফল মিলবে? মার্কিন সেনাবাহিনীও তাদের ন্যাটো মিত্র অন্যান্য সেনাবাহিনীর মতোই সংকটে। ইউক্রেনে মোতায়েন করলে তাদের সরবরাহ লাইন রাশিয়ার আঘাতের মুখে পড়বে—যা যেকোনো অভিযানের সাফল্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি। ইউরোপে পাঠানো ব্রিটিশ এক্সপিডিশনারি ফোর্স প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দুইবারই জার্মানদের কাছে বিপর্যস্ত হয়েছিল—এই ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা নতুন করে স্মরণ করাই যথেষ্ট।
সবচেয়ে বড় বিপদ হলো—ইউক্রেনের সংকট যে পরিণত হয়ে উঠতে পারে আরও বৃহত্তর, আরও বিধ্বংসী সংঘাতে—যেখানে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি মুখোমুখি হবে। দুই দেশই পারমাণবিক শক্তিধর পরাশক্তি, এবং অভূতপূর্ব ধ্বংসক্ষমতার অধিকারী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ নিহত হয়েছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই সংখ্যা বেড়ে পৌঁছেছিল ৭ থেকে ৮.৫ কোটির মধ্যে।
আর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে সম্পূর্ণ মানবসভ্যতাই বিপন্ন হবে।
এই বাস্তবতায়, সমাধানের একমাত্র পথ—আলোচনা—বাস্তবে কোথাও নেই। পুতিনের সঙ্গে আলাস্কা বৈঠকের পর ট্রাম্প দেখেছেন, জেলেনস্কি ও ইউরোপীয় নেতারা কোনো আঞ্চলিক সমঝোতা মেনে নিতে নারাজ। ফলে ট্রাম্প যেসব প্রতিশ্রুতি পুতিনকে দিয়েছিলেন, সেগুলো মুহূর্তেই অকার্যকর হয়ে গেছে।
ন্যাটো দেশগুলো ট্রাম্পের ওপর চাপ বাড়াবে—ইউক্রেনকে "রক্ষা" করতে। ট্রাম্প যদি এতে কোনোভাবে এতে সাড়া দেন—তা হবে একটি ভয়াবহ ভুল।
লেখক: স্টিফেন ব্রায়েন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ডেপুটি আন্ডার সেক্রেটারি অব ডিফেন্স। এই বিশ্লেষণমূলক নিবন্ধটি তার সাবস্ট্যাক নিউজলেটার 'ওয়েপন অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজি'–এ প্রথম প্রকাশিত হয়। যা অনুমতি সাপেক্ষে এশিয়া টাইমস পুনঃপ্রকাশ করেছে। টিবিএসের পাঠকদের জন্য মূল নিবন্ধটি থেকে পরিমার্জনা-সহকারে অনূদিত।
