‘তুমি ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছিলে?’ বিদেশ ভ্রমণে যে অনাহূত প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন আমেরিকানরা
ডাবলিনের কোনো কফিশপ, ক্যারিবিয়ান দ্বীপের ট্যাক্সি, কিংবা সুদূর উত্তর নরওয়ের ছোট্ট বিমানবন্দর—জায়গাটা যা-ই হোক না কেন, প্রশ্নটা আজকাল একটাই।
ফ্লোরিডা-ভিত্তিক কন্টেন্ট ক্রিয়েটর লরেন গে-র জন্য এই বছরটা ছিল এমনই অভিজ্ঞতায় ভরা। যেখানেই গেছেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্পর্কে তার মতামত জানতে চাওয়া হয়েছে। প্রায়শই, কারো সাথে পরিচয় হওয়ার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তাল রাজনীতি নিয়ে শুরু হয়েছে একের পর এক প্রশ্ন আর মন্তব্য।
'কথা বলার ভঙ্গি শুনেই যখন তারা ধরে ফেলে আমি একজন আমেরিকান, ব্যস, আর রক্ষে নেই! সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে যায় রাজনৈতিক আলোচনা। তারা প্রেসিডেন্টকে নিয়ে কথা বলতে চায়,' বলেন ৪৪ বছর বয়সী লরেন, যিনি ইনস্টাগ্রামে 'আউটডোরসিডিভা' নামে পরিচিত।
সেপ্টেম্বরের এক ঘটনা। আয়ারল্যান্ডে একটি রাইডশেয়ারে উঠতেই চালক জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি কি রাজনীতি নিয়ে কিছু কথা বলতে পারেন?
'আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, 'সেটা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে'।' লরেন বলেন, তিনি সবসময়ই এই বিষয়ে কথা বলতে দ্বিধা বোধ করেন, কারণ একজন অপরিচিত ব্যক্তি কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবেন, তা আগে থেকে বোঝা মুশকিল।
'চালক অবাক হয়ে জানতে চাইলেন, 'আপনারা এটা দ্বিতীয়বার হতে দিলেন কী করে?'' ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন লরেন। 'তিনি বললেন, তিনি বিশ্বাসই করতে পারছেন না এটা আবার ঘটেছে—আইরিশরা মুখের ওপর কথা বলতে ছাড়ে না!'
দেশে-বিদেশে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু
আজকাল আমেরিকান ভ্রমণকারীরা অপরিচিতদের কাছ থেকে রাজনীতি নিয়ে এমন অনেক কড়া কথা শুনছেন।
শুধু সরাসরি প্রশ্নই নয়, অনেক সময়ই বিষয়টা যেন হাওয়ায় ভাসতে থাকে। আপনি কোথা থেকে এসেছেন বলার পর হয়তো নেমে আসে এক অদ্ভুত, অর্থপূর্ণ নীরবতা, যেন অপর প্রান্তের মানুষটি আপনার মুখ থেকে কিছু শোনার অপেক্ষায়। অথবা আপনি আমেরিকান বলার সাথে সাথেই তারা হয়তো বলে বসেন, 'আপনাদের দেশে তো এখন অনেক কিছু ঘটছে...'—যা আসলে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা শুরু করারই এক খোলা আমন্ত্রণ।
এই পরিস্থিতি এড়াতে ট্যুর অপারেটর ডোনি বেলাউ তার ট্যুরগুলোতে রাজনীতি নিয়ে কথা বলার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। তার সংস্থা 'গার্লস গাইড টু দ্য ওয়ার্ল্ড' বছরে প্রায় ৮০টি আন্তর্জাতিক ট্যুর আয়োজন করে। ভ্রমণের আগেই অংশগ্রহণকারীদের স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হয় এই 'নো-পলিটিক্স' নীতির কথা।
বেলাউ ব্যাখ্যা করেন, 'আমরা আমাদের ট্রিপ লিডারদের কঠোরভাবে নির্দেশ দিই, যাতে রাজনৈতিক প্রসঙ্গ ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই তারা তা থামিয়ে দেন। কারণ আমরা চাই না, গ্রুপের কেউ নিজেকে বিচ্ছিন্ন বা অস্বস্তিতে ফেলুক।'
তবে গ্রুপের বাইরের মানুষদের তো আর এই নিয়মের কথা জানা থাকে না। এমনই এক ঘটনা ঘটল অ্যাঞ্জি রোচের সাথে। জুরিখের একটি হোটেলে নিউজিল্যান্ডের এক পরিবারের সাথে নাস্তার টেবিলে গল্প করছিলেন তিনি।
'খুবই সুন্দর একটা আলোচনা চলছিল। তারা চমৎকার মানুষ,' বলেন টেনেসির অবসরপ্রাপ্ত দন্তচিকিৎসক রোচ।
'হঠাৎ করেই ভদ্রলোক যেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলেন, 'তা আপনাদের ট্রাম্পের কী খবর?'' স্মরণ করেন রোচ, যিনি নিজে একজন ট্রাম্প সমর্থক।
রোচ এবং তার বন্ধু একটু হেসে উত্তর দেন, ''কী, আপনি ট্রাম্পকে পছন্দ করেন না?'' তিনি বলেন, 'অনেক সময়ই এই ধরনের আলোচনায় জড়াতে ইচ্ছা করে না, কারণ মানুষজন শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে অভদ্র হয়ে ওঠে।'
তবে পরে জানা যায়, লোকটি নিউজিল্যান্ডের একজন খামারি এবং সাম্প্রতিক মার্কিন শুল্ক কীভাবে তার ব্যবসাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, তা নিয়েই তিনি কথা বলছিলেন। রোচ বলেন, এরপর তাদের মধ্যে 'খুবই শালীন' একটি আলোচনা হয়েছিল।
প্রশ্ন এড়ানোর কৌশল
বিলাসবহুল ট্র্যাভেল এজেন্সি 'এমবার্ক বিয়ন্ড'-এর উপদেষ্টা জোশ গেলার জানান, তার আমেরিকান ক্লায়েন্টদের ইউরোপ ভ্রমণের বুকিং বেড়েই চলেছে। তবে অনেকেই ভ্রমণের আগে জানতে চান, বিদেশে তাদের কেমন চোখে দেখা হবে।
'আমি তাদের ফিরে আসার পর জিজ্ঞাসা করি, 'অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?' তারা বলে, 'দারুণ! আমেরিকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি আমরা কীভাবে সামাল দিচ্ছি, তা নিয়ে মানুষের আগ্রহ',' তিনি বলেন।
তবে গেলারের সাথে আজকাল সবচেয়ে বেশি যোগাযোগ করছেন বিশ্বের বিভিন্ন হোটেলের ম্যানেজাররা। তারা নিশ্চিত করতে চান, আমেরিকান অতিথিরা যেন তাদের হোটেলে সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং স্বাগত বোধ করেন।
লাস ভেগাসের ৩০ বছর বয়সী নিকোল হার্নান্দেজ বলেন, ট্রাম্পকে নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি মাঝে মাঝে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন।
'আমার অভিজ্ঞতা এতটাই তিক্ত যে, আমি দুই হাতে গুনে বলতে পারব, কতবার আমার সাথে এমন হয়েছে যে কেউ দেখা হতেই জিজ্ঞাসা করেছে, 'আপনার নাম কী? কোথা থেকে এসেছেন? আপনি কি ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন?''
হার্নান্দেজ বলেন, এই ধরনের প্রশ্ন শুরুতেই তার কাছে অভদ্রতা মনে হয়েছে। 'পরিচয় দেওয়ার সময় 'আমি আমেরিকা থেকে এসেছি'—এই কথাটা বলার সময় আমার দম বন্ধ হয়ে আসত। কারণ আমি জানতাম না, এরপর কী প্রশ্ন উড়ে আসবে, বা তারা কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে,' তিনি বলেন।
'একটি উত্তর প্রস্তুত রাখুন'
আজকাল মার্কিন ভ্রমণকারীদের জন্য তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কথা বলতে বলাটা যেন ভ্রমণেরই একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
হার্নান্দেজ বলেন, 'মূল কথা হলো, প্রস্তুত থাকুন। আপনাকে প্রশ্ন করা হবেই। আর আপনি যদি এ নিয়ে কথা বলতে না চান, তবে একটি তৈরি উত্তর হাতের কাছে রাখুন।'
শিষ্টাচার বিশেষজ্ঞ ড্যানিয়েল কোভাচেভিচ বলেন, এই পরিস্থিতিতে অস্বস্তি তৈরি না করেই সুন্দরভাবে বিষয় পরিবর্তন করা সম্ভব। আপনি বলতে পারেন, 'আজকাল রাজনীতি নিয়ে কথা বলাটা বেশ উত্তেজনার। চলুন, অন্য কোনো হালকা বিষয় নিয়ে কথা বলি।'
লরেন গে পুরো বিষয়টিকে এক লাইনে তুলে ধরেন: 'সারা বিশ্ব আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে, আর তারা আমাদের বিচার করছে।'
