কোয়ান্টাম কম্পিউটিং কি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চেয়েও বড় কিছু হবে?
প্রযুক্তি সাংবাদিকদের মধ্যে একটি পুরোনো প্রবাদ আছে—কোয়ান্টাম নিয়ে আপনি হয় সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন, নয়তো এমনভাবে বলতে পারেন যাতে মানুষ বোঝে; কিন্তু দুটোই একসঙ্গে করা সম্ভব নয়।
কারণ, কোয়ান্টাম মেকানিকস—পদার্থবিজ্ঞানের এক জটিল ও আংশিক তাত্ত্বিক শাখা—যা বোঝা সত্যিই কঠিন। এখানে অতি ক্ষুদ্র কণা বা পার্টিকেল এমনভাবে আচরণ করে যা আমাদের সাধারণ জ্ঞানের সম্পূর্ণ বিপরীত।
এই অদ্ভুত আচরণ থেকেই বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছেন নতুন এক অতি-শক্তিশালী প্রযুক্তি জগতের সম্ভাবনা।
এই অতি জটিলতাই সম্ভবত কারণ যে, কোয়ান্টাম এখনো প্রযুক্তি জগতে তেমন আলোচনায় আসেনি—যেখানে বর্তমানে এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাই সংবাদ শিরোনামের বিচারে জনপ্রিয়তম 'রকস্টার'।
অথচ সাম্প্রতিক সময়ে মাইক্রোসফট, গুগলের মতো প্রযুক্তি জায়ান্টদের কাছ থেকে কোয়ান্টাম নিয়ে একের পর এক বড় ঘোষণা এসেছে।
সাধারণভাবে বললে, আমরা কোয়ান্টাম প্রযুক্তিকে মূলত হার্ডওয়্যার (যেমন সেন্সর বা কম্পিউটার) হিসেবে দেখি, আর এআই বেশি সফটওয়্যার নির্ভর—যা অবশ্যই হার্ডওয়্যার ছাড়া চলতে পারে না।
এই দুইকে একত্র করলে হয়তো আমরা এমন এক অতিপ্রবল প্রযুক্তির যুগে প্রবেশ করব, যা মানবজাতির ইতিহাসে আগে কখনো দেখা যায়নি—যদিও এই পূর্বাভাসে "হয়তো" শব্দটি বেশ ভার বহন করছে, বলে মন্তব্য করেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান- ফরেস্টারের ভাইস প্রেসিডেন্ট ব্রায়ান হপকিন্স।
তিনি বলেন, "সম্ভাবনা আছে, কিন্তু এখনো নিশ্চিত কিছু নয়। প্রাথমিক পরীক্ষাগুলো আশাব্যঞ্জক, কিন্তু এগুলোও দেখাচ্ছে—এআই-তে কোয়ান্টাম প্রভাব কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে হলে আরও শক্তিশালী কোয়ান্টাম কম্পিউটার ও উদ্ভাবনী গবেষণা প্রয়োজন।"
মূল্যমানের বিচারে, দুটোই অত্যন্ত লাভজনক খাত। বাজার পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ম্যাককিন্সের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে কোয়ান্টাম খাতের বাজারমূল্য দাঁড়াতে পারে প্রায় ৯৭ বিলিয়ন ডলার।
তবে উভয় খাতই এখন অতিরিক্ত প্রচারণা ও সম্ভাব্য 'বুদবুদের' ছায়ায় রয়েছে। এখানে বুদবুদ বা বাবল বলতে বোঝানো হচ্ছে বাজারে অতিমূল্যায়নের দিকটিকে। কারণ যখন কোনো পণ্য/ সেবার প্রকৃত মূল্যটি বিনিয়োগকারীদের কাছে স্পষ্ট হয়, তখন বুদবুদের মতোই বাড়তি মূল্য উবে যায়।
অবশ্য এআই-এর সম্ভাব্য বাজারমূল্য ট্রিলিয়ন ডলারে পরিমাপ করা হচ্ছে। হপকিন্স রসিকতা করে বলেন, "একসময় ভাবতাম কোয়ান্টামই বিশ্বের সবচেয়ে অতিমূল্যায়িত প্রযুক্তি—যতক্ষণ না এআই উন্মাদনা দেখা দিল।"
গত অক্টোবরেই বিশ্লেষকেরা সতর্ক করেছেন, কিছু প্রধান কোয়ান্টাম কোম্পানির শেয়ার ৬২% পর্যন্ত পতনের ঝুঁকিতে রয়েছে। একইসঙ্গে, এআই নিয়েও "বাবল" ফেটে যাওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে।
ত্রুটি—দুটিরই শত্রু
যেমন আমরা এখন "জেনারেটিভ এআই"-এর ভুল বা 'হ্যালুসিনেশন'সম্পর্কে পরিচিত, তেমনি কোয়ান্টামও ভিন্ন ধরনের ত্রুটিতে ভোগে।
এই ত্রুটি ঘটে কারণ কোয়ান্টাম কণাগুলোর অবস্থা অত্যন্ত নাজুক—আলো, শব্দ বা তাপমাত্রার সামান্য পরিবর্তনেই ব্যাহত হয়।
এজন্য তারা সঠিকভাবে কাজ করবে এ ধরনের স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় রাখা অত্যন্ত কঠিন। ইলন মাস্ক এমনকি রসিকতা করে বলেছেন, "চাঁদের অন্ধকার খাঁদই হচ্ছে কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের জন্য আদর্শ জায়গা।"
কোয়ান্টাম কম্পিউটারগুলো দেখতে ঐতিহ্যবাহী কম্পিউটারের মতো নয়—এদের কোনো নির্দিষ্ট নকশা নেই, তবে এখনকার সংস্করণগুলো বেশ বড় আকারের।
এসব যন্ত্র কেবল গবেষণাগারে রাখা হয়, এবং সাধারণত দেখতে এক ধরনের জেলিফিশ-এর মতো। এগুলোর জন্য চরম শীতল তাপমাত্রা ও লেজারের সাহায্য প্রয়োজন হয়—এটি এখনও বাসাবাড়িতে ব্যবহারযোগ্য নয়, বরং ল্যাবরেটরি পর্যায়ের প্রযুক্তির পর্যায়ে আছে।
তবে গবেষকেরা সম্প্রতি কৃত্রিম হীরা ব্যবহার করে 'কিউবিট' তৈরি করে দেখিয়েছেন, যা প্রায় কক্ষ তাপমাত্রায়ও (রুম টেম্পারেচার) কার্যকর হতে পারে।
এগুলো কিছুটা ব্যয়বহুলও বটে — গবেষকরা দেখেছেন, কৃত্রিম হীরা ব্যবহার করে যদি কিউবিট তৈরি করা যায়, যা কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মৌলিক নির্মাণ উপাদান, তাহলে এসব যন্ত্র ঘরের কাছাকাছি তাপমাত্রাতেই কাজ করতে সক্ষম হয়।
বিলাসবহুল গয়নার ব্র্যান্ড ডি বিয়ার্স ২০২০ সালে ঘোষণা দিয়েছিল, তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এলিমেন্ট সিক্স বিশ্বের প্রথম "জেনারেল পারপাস কোয়ান্টাম গ্রেড ডায়মন্ড" তৈরি করেছে। প্রতিষ্ঠানটি পরে অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিসেসের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ শুরু করে ভবিষ্যতের কোয়ান্টাম নেটওয়ার্কের জন্য উপযুক্ত কৃত্রিম হীরা তৈরিতে।
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রায় ২০০টির মতো কোয়ান্টাম কম্পিউটার রয়েছে, যদিও চীন তাদের হাতে থাকা কোয়ান্টাম কম্পিউটারের প্রকৃত সংখ্যা গোপন রেখেছে।
তবুও কোয়ান্টাম বিশেষজ্ঞেরা এর সম্ভাবনা নিয়ে সাহসী ভবিষ্যদ্বাণী করতে দ্বিধা করছেন না।
"ভোক্তা হিসেবে আমরা জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে কোয়ান্টামের প্রভাব অনুভব করব," বলেন রাজীব হাজরা, যিনি ১০ বিলিয়ন ডলার বাজারমূল্যের কোম্পানি কোয়ান্টিনিয়ামের প্রধান নির্বাহী।
তার ভাষায়, "কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের ক্ষেত্রটি এআই-এর মতোই বড়—বরং কিছু ক্ষেত্রে আরও বড়।"
যুক্তরাজ্যের শীর্ষ কোয়ান্টাম বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক স্যার পিটার নাইট বিবিসি রেডিও ৪-এ বলেন, "যে গণনা করতে মহাবিশ্বের সমান সময় লাগত, সেটি কোয়ান্টাম কম্পিউটার কয়েক সেকেন্ডে করতে পারবে।"
তাহলে এই যন্ত্রগুলো দিয়ে কী হবে? তারা এমন কোন যুগান্তকারী কাজগুলো করবে যা বদলে দেবে মানুষের দৈনন্দিন জীবন, অর্থনীতিসহ আরও বহুকিছু।
স্বাস্থ্যসেবা থেকে কৃষি পর্যন্ত বিপ্লব
যেমন এআই স্বাস্থ্যসেবায় বিপ্লব আনছে, তেমনি কোয়ান্টাম গবেষণার বড় অংশও চিকিৎসা ও ওষুধ উদ্ভাবনে নিয়োজিত।
একদিন হয়তো কোয়ান্টাম কম্পিউটার কয়েক মিনিটেই কোটি কোটি অণুর সম্ভাব্য সংমিশ্রণ বিশ্লেষণ করে নতুন ওষুধ উদ্ভাবন করতে পারবে—যেখানে সাধারণ কম্পিউটারের এখন লাগে বহু বছর।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে গুগল তাদের নতুন কোয়ান্টাম চিপ 'উইলো' উন্মোচন করে জানায়, এটি এমন এক সমস্যা ৫ মিনিটে সমাধান করতে পারে, যা বর্তমান বিশ্বের দ্রুততম সুপারকম্পিউটারের লাগবে ১০ সেপটিলিয়ন বছর। এক সংখ্যার পর ২৫টি শূন্য যোগ করলে হয় এক সেপটিমিলিয়ন। এ থেকেই কোয়ান্টাম প্রযুক্তির বিশাল সম্ভাবনা সামনে চলে আসে।
হাজরা বলেন, এটি ভবিষ্যতে ব্যক্তিনির্ভর চিকিৎসা তৈরির পথ খুলে দেবে—যেখানে সবার জন্য আলাদা প্রেসক্রিপশন নয়, বরং ব্যক্তির শরীরের উপযোগী ওষুধ তৈরি হবে। কৃষিক্ষেত্রেও এর প্রভাব বিশাল হতে পারে—যেমন আরও কার্যকর সার উৎপাদন প্রক্রিয়া, যা কৃষকদের জন্য বড় সহায়ক হবে।
কোয়ান্টাম সেন্সর, কম্পাস ও জিপিএসের বিকল্প
কোয়ান্টাম সেন্সর ইতিমধ্যেই বাস্তব—যেমন অ্যাটমিক ক্লক বা পারমাণবিক ঘড়িতে এগুলো ব্যবহৃত হয়।
২০১৯ সালে নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা হেলমেট আকৃতির একটি প্রোটোটাইপ যন্ত্র তৈরি করেন, যা শিশুদের মস্তিষ্কের নন-ইনট্রুসিভ স্ক্যান করতে সক্ষম হয়। বিশেষ করে এপিলেপসি রোগে আক্রান্ত শিশুদের ওপর এটির পরীক্ষা করা হয়।
গবেষক রায়ান হিল বলেন, "প্রচলিত স্ক্যানারে রোগীদের সম্পূর্ণ স্থির থাকতে হয়, যা বাস্তব পরিস্থিতিতে মস্তিষ্কের সঠিক কার্যকলাপ দেখায় না। কোয়ান্টাম প্রযুক্তি সেই সীমাবদ্ধতা ভাঙছে।"
২০২৪ সালে লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজ ভূগর্ভস্থ মেট্রো নেটওয়ার্কে 'কোয়ান্টাম কম্পাস' পরীক্ষায় ব্যবহার করে, যা জিপিএস সিগন্যাল ছাড়াই অবস্থান নির্ণয় করতে সক্ষম হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল কোয়ান্টাম কম্পিউটিং সেন্টারের পরিচালক ড. মাইকেল কাথবার্ট বলেন, "আমাদের অর্থনীতি প্রতিদিন প্রায় ১ বিলিয়ন পাউন্ডের জিপিএস নির্ভর লেনদেন করে। কোয়ান্টাম ক্লক ও সেন্সর ব্যবহার করে আমরা এমন নেভিগেশন সিস্টেম তৈরি করতে পারি যেটিকে হ্যাক বা বিভ্রান্ত করা যাবে না।"
এমনকি যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল গ্রিড এখন গবেষণা করছে, কীভাবে কোয়ান্টাম প্রযুক্তি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও চাহিদার ভারসাম্য রক্ষা করে ব্ল্যাকআউট প্রতিরোধ করা যায়।
অন্যদিকে, এয়ারবাস যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠান আয়নকিউ-এর সঙ্গে কাজ করছে এমন কোয়ান্টাম-নির্ভর অ্যালগরিদম তৈরিতে, যা বিমানে পণ্য বোঝাই আরও দক্ষভাবে করতে পারে। কারণ বিমানের ভরকেন্দ্র সামান্য সরলেও কয়েক হাজার কেজি অতিরিক্ত জ্বালানি লাগে।
'কোয়ান্টাম ডে' ও এনক্রিপশন সংকট
তবে এখানে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের জায়গা হলো তথ্যের নিরাপত্তা।
বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞই মনে করেন, ভবিষ্যতে কোয়ান্টাম প্রযুক্তি বর্তমানের সব ধরনের এনক্রিপশন—ব্যক্তিগত ডেটা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য পর্যন্ত—অল্প সময়েই ভেঙে ফেলতে পারবে।
বিভিন্ন দেশে সেকারণে এরমধ্যেই একে অপরের এনক্রিপটেড ডেটা চুরি করছে, ভবিষ্যতে ডিক্রিপ্ট করার উদ্দেশ্যে।
সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ প্রফেসর অ্যালান উডওয়ার্ড বলেন, "এটি বলা হয় 'হারভেস্ট নাউ, ডিক্রিপ্ট লেটার' কৌশল।"
তিনি আরও যোগ করেন, "বর্তমান পাবলিক কি এনক্রিপশন ভাঙার তত্ত্বগুলো প্রস্তুত—এখন শুধু দরকার একটি পূর্ণাঙ্গ কার্যকর কোয়ান্টাম কম্পিউটার।"
এই দিনটিকেই বিশেষজ্ঞেরা বলেন 'কিউ-ডে '।
ফরেস্টারের ব্রায়ান হপকিন্সের ধারণা, ২০৩০ সালের কাছাকাছি এই বাস্তবতা এসে যেতে পারে।
অ্যাপল ও মেসেজিং প্ল্যাটফর্ম সিগন্যাল ইতিমধ্যেই পোস্ট-কোয়ান্টাম এনক্রিপশন প্রযুক্তি চালু করেছে, কিন্তু পুরনো ডেটায় তা প্রযোজ্য নয়—এবং এটাই এখন সবচেয়ে বড় ঝুঁকি।
গত অক্টোবরে ব্রিটেনের গোয়েন্দা সংস্থা জিসিএইচকিউ-এর সাবেক ক্রিপ্টোগ্রাফি প্রধান ড্যানিয়েল শিউ দেশটির সংবাদমাধ্যম সানডে টাইমসকে বলেন, "চীনের রাষ্ট্র-সমর্থিত সাইবার হামলায় এমন বিপুল পরিমাণ ডেটা চুরি হয়েছে যে, প্রায় প্রতিটি ব্রিটিশ নাগরিকের তথ্য হয়তো ইতিমধ্যেই আক্রান্ত, যা তারা ভবিষ্যতে কোয়ান্টাম কম্পিউটার দিয়ে বিশ্লেষণ করে জানবে।"
তাই প্রশ্ন এখন একটাই—যখন কোয়ান্টাম বাস্তবে কার্যকর হবে, তখন এআই-এর রাজত্ব টিকবে, নাকি কোয়ান্টামই হয়ে উঠবে প্রযুক্তির পরবর্তী মহাশক্তি?
