‘ফিরছে ইসলামোফোবিয়া’; মামদানিকে ঘিরে মুসলিম ভোটারদের মনে গর্ব ও ভয়, ভবিষ্যৎ নিয়েও আশঙ্কা
নিউইয়র্ক সিটি মেয়র পদে জোহরান মামদানি'র প্রতিদ্বন্দ্বিতা শহরের মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য এক মিশ্র অনুভূতি নিয়ে এসেছে। ৯/১১-এর ভয়াবহতার ছায়ায় বেড়ে ওঠা মুসলিম নারী সাবাহ মুনাওয়া রজানান, মামদানি নির্বাচনী প্রচারে তার ধর্মীয় পরিচয়কে সম্পূর্ণভাবে ধারণ করেও নিউইয়র্কের মেয়র হওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছেন দেখে তিনি বিস্মিত।
তবে মামদানিকে ঘিরে ইসলামোফোবিক অনুভূতি যেমন প্রসারিত হচ্ছে, তেমনি এর তীব্রতাও বাড়ছে। মুনাওয়ার বলেন, 'মাঝে মাঝে মনে হয়, পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে, কারণ আগে তো অনেকে আড়ালে লুকিয়ে থাকতেন, ভয় পেতেন, তাই তারা দৃশ্যমান ছিলেন না। আর এখন মানুষ বলছে, 'আমরা এখানে আছি,' সেই সাথে বিদ্বেষ আরও তীব্র হচ্ছে।'
বেশিরভাগ জনমত জরিপে দুই অঙ্কের ব্যবধানে এগিয়ে থাকা মামদানি নিউইয়র্ক সিটির প্রথম মুসলিম মেয়র হওয়ার পথে। ব্রঙ্কসের লিটল ইয়েমেন থেকে ব্রুকলিনের লিটল বাংলাদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য এটি স্পষ্টতই গর্বের বিষয়।
এই সপ্তাহের কয়েক ডজন সাক্ষাৎকারে মুসলিম ভোটাররা জানিয়েছেন, মামদানি'র বিরুদ্ধে বাড়তে থাকা ইসলামোফোবিক আক্রমণ তাদের উচ্ছ্বাসকে কিছুটা ম্লান করে দিয়েছে।
মামদানি এখন দেশের অন্যতম হাই-প্রোফাইল মুসলিম ব্যক্তিত্ব। তারা মামদানি'র উত্থানকে স্বাগত জানাচ্ছে এবং নিজেদের ও তাদের সন্তানদের জন্য নতুন সম্ভাবনা দেখছে। কিন্তু একই সাথে তারা তার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং ভাবছে একজন মুসলিম মেয়রের উপস্থিতি তার ধর্মাবলম্বী অন্যান্য লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে কী প্রভাব ফেলবে।
দক্ষিণ-পূর্ব কুইন্স-এর সাবেক মুসলিম কাউন্সিলম্যান আই. ড্যানিক মিলার বলেন, 'মামদানিকে লক্ষ্য করে করা মন্তব্যগুলোকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। তারা ভয় পাচ্ছেন যে এই নির্বাচনের পরেও এর গুরুতর পরিণতি দেখা দিতে পারে।'
বিরোধীদের বিদ্বেষপূর্ণ প্রচারণা
মামদানি'র প্রতিদ্বন্দ্বী – স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু এম. কুমো এবং রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়া – তাদের কথা ও আচরণের মাধ্যমে মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা উসকে দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত।
একটি টেলিভিশন বিতর্কে স্লিওয়া মিথ্যাভাবে মামদানিকে 'বৈশ্বিক জিহাদ' সমর্থনের জন্য অভিযুক্ত করেন। একটি রেডিও সাক্ষাৎকারে, ডব্লিউএবিসি-র একজন রক্ষণশীল উপস্থাপক মামদানি আরেকটি ৯/১১- হামলায় আনন্দিত হবেন বললে কুমো হাসিতে ফেটে পড়েন।
এমনকি বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামস সম্প্রতি কুওমোকে সমর্থন জানিয়ে বলেছেন যে, মামদানি নির্বাচিত হলে ইউরোপের মতো শহরটিও 'ইসলামী চরমপন্থার' ঝুঁকিতে পড়বে।
এই মন্তব্যগুলোর পাশাপাশি, কুমো'র প্রচারণা দল সাময়িকভাবে একটি এআই দ্বারা তৈরি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করে। সেই ভিডিওতে মামদানিকে হাত দিয়ে ভাত খেতে এবং তাকে 'অনভিজ্ঞ কট্টরপন্থী' হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছিল।
মামদানি ও সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া
এই ধারাবাহিক হামলার কারণে মামদানি গত সপ্তাহে ব্রঙ্কসের ইসলামিক কালচারাল সেন্টারে জুমার নামাজের জন্য তার একটি রুটিন প্রচারণা সফরকে পরিবর্তন করতে বাধ্য হন। সেখানে তিনি ১০ মিনিটের এক আবেগঘন বক্তৃতা দেন, যেখানে ইসলামোফোবিয়া কীভাবে তার জীবন এবং তার পরিবার ও বন্ধুদের জীবনকে প্রভাবিত করেছে তা তুলে ধরেন।
মামদানি তার রাজনৈতিক প্রচারণার মূল কেন্দ্রে রেখেছেন মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকে। তার কমিউনিটি আউটরিচ সুপারভাইজার মোহাম্মদ আলহার্বি জানিয়েছেন, নির্বাচনের শুরু থেকেই মামদানি'র 'মুক্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা' থাকায় মুসলিম নেতা ও ভোটাররা সরাসরি তার কাছে সাম্প্রতিক মন্তব্যগুলো নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন।
মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে মামদানি ৫০টিরও বেশি মসজিদ পরিদর্শন করেছেন এবং তার নির্বাচনী প্রচারণা দল ১৮০টিরও বেশি মসজিদ পরিদর্শন করেছে। যতটা সম্ভব মুসলিমদের কাছে পৌঁছাতে এই প্রচারণা দল উর্দু, আরবি, বাংলা এবং অন্যান্য ভাষায় ফোন ব্যাংকের আয়োজন করেছে।
মামদানি'র মুসলিম এনগেজমেন্ট ডিরেক্টর হাসান চৌধুরী বলেন, 'জোহরান প্রকাশ্যে যা বলেছেন, মুসলিমরা মাস ধরে নীরবে আমাদের তা-ই বলে আসছেন। নীরবতা যখন সম্মতি হয়ে দাঁড়ায়, তখন আমাদের সম্প্রদায় নীরব থাকতে চায় না।'
ব্রঙ্কসের লিটল ইয়েমেনে হালাল কসাই হিসেবে কর্মরত ২৮ বছর বয়সী ইউসুফ নাসের জানান, মামদানি জনমত জরিপে এগিয়ে আসার পর ইসলামোফোবিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং ট্যাবলয়েড পত্রিকার প্রথম পাতায় এর বৃদ্ধি লক্ষ্য করেছেন তিনি।
তিনি 'দ্য নিউইয়র্ক পোস্ট'-এর সাম্প্রতিক একটি প্রচ্ছদের কথা তুলে ধরেন, যার শিরোনাম ছিল 'উইপনস অব হামাস ডিস্ট্রাকশন'। এটি মামদানিকে ইসরায়েলের গাজায় যুদ্ধবিরতির সমর্থন না করার জন্য অভিযুক্ত করে।
বিশেষ করে চার্লি কার্ক-এর হত্যাকাণ্ডের পর এই অত্যন্ত উত্তপ্ত পরিবেশে নাসের মামদানি'র নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। নাসের বলেন, 'তিনি অনেক ঘৃণা পাচ্ছেন, অর্থাৎ তিনি সঠিক দিকে এগোচ্ছেন।'
'স্ট্রিট ভেন্ডর প্রজেক্ট'-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আতিয়া মামদানি'র পক্ষে বাড়ি বাড়ি প্রচারণার সময় কিছু বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্যের শিকার হয়েছেন। তিনি বলেন, 'অনেক সময় কেউ দরজা খুলে চিৎকার করে বলবে, 'আমি কোনো কমিউনিস্টকে ভোট দেব না। আমি কোনো মুসলিমকে ভোট দেব না।' যদিও এমন ঘটনা খুব বিরল, কারণ বেশিরভাগ নিউইয়র্কবাসী আসলে তিনি মুসলিম কিনা বা তাকে কমিউনিস্ট হিসেবে দেখে কিনা, তা নিয়ে মাথা ঘামায় না।'
ইসলামোফোবিয়ার অভিযোগ অস্বীকার
বৃহস্পতিবার কুমো এবং মেয়র অ্যাডামস হারলেমে একটি যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে কুমোকে বেশ কয়েকজন ইমাম এবং মুসলিম ব্যবসায়ী ও সম্প্রদায়ের নেতা সমর্থন জানান। তারা কেউই বিশ্বাস করেন না যে কুমো বা অ্যাডামস ইসলামোফোবিক।
কুমো বলেন, এই অভিযোগটি একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার, যা মামদানি নিউইয়র্কবাসীকে বিভক্ত করার জন্য ব্যবহার করছেন। কুওমোর মতে, 'এই নির্বাচনে ইসলামোফোবিয়া বাস্তব নয়।'
তবে এই প্রতিবেদনের জন্য সাক্ষাৎকার নেওয়া বেশিরভাগ মুসলিম নিউইয়র্কবাসী এই মন্তব্যের সঙ্গে একমত নন। ব্রুকলিনের বেশ কয়েকটি এলাকার প্রতিনিধিত্বকারী এবং সিটি কাউন্সিলে নির্বাচিত প্রথম মুসলিম নারী শাহানা হানিফ বলেন, মামদানিকে লক্ষ্য করে করা ইসলামোফোবিক মন্তব্য ও ভিডিও দেখে তিনি স্তম্ভিত।
হানিফ বলেন, 'মানুষ আমাকে বলছে যে, ৯/১১-এর পর তারা যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছিল, তা ২০২৫ সালেও আবার ঘটছে, এটা তারা প্রায় বিশ্বাস করতে পারছে না।'
