ত্যাজ্যপুত্র কী, সন্তানকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা আইনত বৈধ নাকি অবৈধ?
বহুল প্রচলিত 'ত্যাজ্যপুত্র' বা 'ত্যাজ্যকন্যা' শব্দটি সমাজে বহুদিন ধরে ব্যবহৃত হলেও বাংলাদেশের কোনো আইনে এর অস্তিত্ব নেই। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি সম্পূর্ণ সামাজিক ও ধর্মীয় ভুল ধারণা, যার কোনো আইনি ভিত্তি নেই।
বাংলা চলচ্চিত্র, নাটক ও দৈনন্দিন কথোপকথনে 'ত্যাজ্যপুত্র' শব্দটি প্রায়ই ব্যবহৃত হয়। ফলে অনেকের ধারণা, সন্তানকে 'ত্যাজ্য' ঘোষণা করলে সে পারিবারিক সম্পর্ক ও সম্পত্তির অধিকার থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশের আইন সে ধারণাকে সমর্থন করে না।
ত্যাজ্যপুত্র ধারণা ও বাস্তবতা
ত্যাজ্যপুত্র মূলত মা-বাবার ক্ষোভ বা অভিমান প্রকাশের একটি সামাজিক রীতি, যার কোনো আইনি মূল্য নেই। সাধারণত অবাধ্য বা বেপরোয়া সন্তানদের 'শিক্ষা' দিতে মা-বাবা এ ধরনের ঘোষণা দেন। অনেক সময় এটি মৌখিকভাবে হয়, আবার কেউ কেউ এ বিষয়ে হলফনামাও করেন। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে শর্তসাপেক্ষে ত্যাজ্য ঘোষণা করা হয় যে, যদি সন্তান সঠিক পথে ফিরে আসে, তবে ঘোষণাটি বাতিল হবে।
তবে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, 'ত্যাজ্যপুত্র' একটি ভ্রান্ত ধারণা, যা বাংলাদেশের কোনো আইনেই নেই। মুসলিম পারিবারিক আইন সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণেই এমন বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে, যার ফলে সামাজিক জটিলতা ও বিরোধ তৈরি হয়।
আইন কী বলে
বাংলাদেশে উত্তরাধিকার বা সম্পত্তি বণ্টন মুসলমান ও হিন্দুদের নিজ নিজ ধর্মীয় আইনে নিয়ন্ত্রিত। মুসলিম আইনে জন্মসূত্রেই সন্তানের উত্তরাধিকার নির্ধারিত হয়, যা কোনোভাবেই পিতা-মাতা বাতিল করতে পারেন না। ১৯২৫ সালের উত্তরাধিকার আইনে ( The Succession Act, 1925) এই বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
পিতা-মাতা চাইলে জীবদ্দশায় সম্পত্তি দান বা হেবা করতে পারেন, তবে সেটি ১৯০৮ সালের রেজিষ্ট্রেশন আইনের আওতায় নিবন্ধিত হতে হবে। তাতেও সর্বোচ্চ এক-তৃতীয়াংশ সম্পত্তি দান করা যায়। বাকি অংশ উত্তরাধিকারসূত্রে সন্তানদের মধ্যে বণ্টিত হবে।
তবে মুসলিম আইনে কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে; যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত বা ভুলবশত কাউকে হত্যা করে, কিংবা ধর্ম পরিবর্তন করে, তবে সে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
হিন্দু আইনে কিছু শর্তসাপেক্ষে সন্তানকে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করার বিধান রয়েছে, তবে মুসলিম আইনে এর কোনো সুযোগ নেই।
আইনের প্রয়োগ ও বিভ্রান্তি
বাংলাদেশে 'ত্যাজ্যপুত্র' ধারণা অনেক মুসলমানের সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ায়, বাবার মৃত্যুর পর অন্য উত্তরাধিকারীরা অনেক সময় ওই সন্তানের অংশ দিতে অনীহা প্রকাশ করেন। গ্রামীণ সালিশে আইনের ভুল ব্যাখ্যার কারণে এমন অন্যায় সিদ্ধান্ত দেখা যায়, যা মুসলিম আইনের পরিপন্থী।
এই পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ১৮৯৩ সালের বাটোয়ারা আইনের আওতায় ৫০০ টাকা কোর্ট ফি দিয়ে দেওয়ানি আদালতে মামলা করে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেন।
বিশেষজ্ঞের মতামত
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খাদেমুল ইসলাম বলেন, 'ত্যাজ্যপুত্র বিষয়টা আসলে একটা সামাজিক মিথ। মুসলিম পারিবারিক আইনে এমন কোনো বিধানের অস্তিত্ব নেই। কেউ সন্তানকে ত্যাজ্য করলেও সে রেখে যাওয়া সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে না। তবে মৃত্যুর আগেই সম্পত্তি হস্তান্তর করলে সেটি ভিন্ন বিষয়।'
ঢাকার চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা সংক্রান্ত কাজে আসা মো. ফয়সাল বলেন, 'ত্যাজ্যপুত্র বা ত্যাজ্যকন্যা নিয়ে কোনো আইন আছে কি না জানি না, তবে নাটক-সিনেমায় শব্দটি বহুবার শুনেছি। আমার ধারণা, ত্যাজ্যপুত্র মানে সবকিছু থেকেই বঞ্চিত করা।'
আইনজীবীদের মতে, বাস্তবে এমন কোনো আইনি বিধান না থাকলেও সমাজে প্রচলিত ভুল ধারণাই বহু পরিবারে বিভেদ ও জটিলতার জন্ম দিচ্ছে। তাই উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোই এখন সময়ের দাবি।
