মামদানির নির্বাচনী প্রচারণার প্রশংসা জানিয়ে ওবামার ফোন, জিতলে পরামর্শক হিসেবে পাশে থাকার প্রস্তাব
নিউ ইয়র্ক সিটি মেয়র প্রার্থী জোহরান মামদানিকে ফোন করেছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। শনিবার প্রায় ৩০ মিনিটের এই ফোনালাপে তিনি মামদানির নির্বাচনী প্রচারণার প্রশংসা করেন এবং ভবিষ্যতে তার 'বিশ্বস্ত পরামর্শক' [সাউন্ডিং বোর্ড] হিসেবে পাশে থাকার প্রস্তাব দেন।
ওবামা আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো সমর্থন না জানালেও এই ঘটনাকে মামদানির প্রতি ওবামার জোরালো সমর্থন হিসেবেই দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
এই ফোনালাপের বিষয়টি সম্পর্কে জানেন এমন দুজন ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, বারাক ওবামা জোহরান মামদানির প্রচারণার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তিনি নিজে অতীতে রাজনীতিতে যেসব ভুল করেছেন, সেগুলোর কথা উল্লেখ করে বলেন, এমন তীব্র প্রচারণার মধ্যেও মামদানি খুব কমই ভুল করেছেন।
সূত্রের ভাষ্যে, ওবামা মামদানিকে বলেন, 'আপনার নির্বাচনী প্রচারণা দেখাটা ছিল দারুণ এক অভিজ্ঞতা।'
সাবেক প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, মঙ্গলবারের নির্বাচনের পরেও মামদানির সাফল্যের বিষয়ে তিনি আগ্রহী। একটি নতুন প্রশাসন পরিচালনার জন্য কর্মী নিয়োগ এবং নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণের মতো চ্যালেঞ্জগুলো নিয়েও তাদের মধ্যে আলোচনা হয়।
নির্বাচনে জয়ী হলে মামদানিকে যেকোনো বিষয়ে আলোচনা ও পরামর্শের জন্য 'সাউন্ডিং বোর্ড' হিসেবে কাজ করার প্রস্তাব দেন ওবামা। ভবিষ্যতে ওয়াশিংটনে তাদের দুজনের মধ্যে একটি বৈঠকের প্রাথমিক পরিকল্পনা নিয়েও কথা হয়েছে, যদিও কোনো দিনক্ষণ চূড়ান্ত হয়নি।
বারাক ওবামা সাধারণত ওভাল অফিস ছাড়ার পর থেকে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে সরাসরি হস্তক্ষেপ এড়িয়ে চলেন। সেই হিসেবে তিনি মামদানিকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো সমর্থন দেননি। তবে ডেমোক্রেটিক প্রাইমারির পর এটি ছিল দুজনের মধ্যে দ্বিতীয় ফোনালাপ।
এই ফোনকলটি ওবামার সমর্থনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত, বিশেষ করে যখন ডেমোক্রেটিক পার্টির শীর্ষ নেতাদের অনেকেই ৩৪ বছর বয়সী এই ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট প্রার্থী থেকে দৃশ্যত দূরত্ব বজায় রেখেছেন।
ফোনালাপের জন্য মামদানি সাবেক প্রেসিডেন্টকে ধন্যবাদ জানান। তিনি ওবামাকে বলেন, তার প্রথম প্রেসিডেন্সিয়াল প্রচারণার সময় বর্ণবাদ নিয়ে দেওয়া ভাষণ থেকেই তিনি নিজে ইসলামোফোবিয়া [মুসলমান বিদ্বেষ] বিষয়ে বক্তৃতা দেওয়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন।
ফোনালাপের ব্যাপারে বারাক ওবামার একজন মুখপাত্র মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে মামদানির মুখপাত্র ডোরা পেক এক বিবৃতিতে বলেন, 'জোহরান মামদানি প্রেসিডেন্ট ওবামার সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। আমাদের শহরে এক নতুন ধারার রাজনীতি আনার গুরুত্ব নিয়ে তাদের মধ্যে যে আলোচনা হয়েছে, তাকে তিনি সাধুবাদ জানিয়েছেন।'
ডেমোক্র্যাট শিবিরে বিভক্তি ও রিপাবলিকানদের পরিকল্পনা
ডেমোক্রেটিক পার্টির অন্যান্য জাতীয় নেতারা মামদানিকে সমর্থন জানাতে দ্বিধায় ছিলেন। নিউ ইয়র্কের সিনেটর এবং ডেমোক্রেটিক নেতা চাক শুমার এখনও জানাননি যে তিনি মামদানিকে ভোট দেবেন কি না। এই সপ্তাহে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, 'আমাদের আলোচনা চলছে।'
প্রতিনিধি পরিষদের শীর্ষ ডেমোক্র্যাট হাকিম জেফ্রিসও কয়েক মাস ধরে নীরব থাকার পর আগাম ভোটের ঠিক আগে মামদানিকে সমর্থন জানান।
অন্যদিকে, অন্যদিকে রিপাবলিকানরা মামদানিকে পুরো ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রতীক হিসেবে তুলে ধরার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
হাউস রিপাবলিকানদের প্রচার শাখা এই সপ্তাহে একটি বিবৃতিতে বলেছে, তারা মামদানিকে 'সারা দেশে ডেমোক্রেটিক পার্টির সমার্থক' করে তুলবে। মেমোতে বলা হয়, 'এটি শুধু নিউ ইয়র্কের একটি নির্বাচন নয়। এটি সমাজতন্ত্র ও বামপন্থার কাছে একটি দলের নতজানু হওয়ার জাতীয় কাহিনি।'
কুইন্সের অ্যাসেম্বলিম্যান জোহরান মামদানি গত জুনে ডেমোক্রেটিক প্রাইমারিতে সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুওমোকে পরাজিত করে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। কুওমো এখন রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়ার সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
গত জুন মাসের শেষ দিকে প্রাইমারিতে জয়ের পরই প্রথমবার মামদানিকে ফোন করেছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। মামদানির উপদেষ্টা এবং ওবামার ২০০৮ সালের প্রচারণা ও হোয়াইট হাউসের সাবেক রাজনৈতিক পরিচালক প্যাট্রিক গাসপার্ড বলেন, 'ওই ফোনটি ছিল সম্পূর্ণ স্বতঃস্ফূর্ত—ওবামার পক্ষ থেকে কোনো অনুরোধ বা পরিকল্পনা ছাড়াই।'
তিনি আরও বলেন, 'এটা এমন কিছু ছিল যা ওবামার করার প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু তিনি যখন নিজে থেকে ফোন করেন এবং পরে সেই খবর প্রকাশ্যে আসে—তা রাজনৈতিক অঙ্গন, ব্যবসায়িক মহল এমনকি সাধারণ ভোটারদের কাছেও মামদানির জন্য এক ধরনের স্বীকৃতি এনে দেয়।'
গাসপার্ডের ভাষায়, জুন মাসের সেই কলটি মামদানির জন্য ব্যক্তিগতভাবেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ, সেটি তাকে শাসনক্ষমতা অর্জনের পর প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক কাঠামো গঠনের বিষয়ে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে।
গত শনিবার দ্বিতীয়বার ফোনালাপটি হয়, যখন ওবামা ভার্জিনিয়া ও নিউ জার্সিতে ডেমোক্র্যাট প্রার্থীদের সঙ্গে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে যাচ্ছিলেন। নির্বাচনের আগের সপ্তাহে ওবামা আবারও দলের সবচেয়ে জনপ্রিয় মুখ হিসেবে প্রচারণায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
এই শরতে ক্যালিফোর্নিয়া, নিউ জার্সি ও ভার্জিনিয়ার টেলিভিশন বিজ্ঞাপনেও ওবামার উপস্থিতি ছিল বেশ– যা প্রমাণ করে, এক দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার জনপ্রিয়তা এখনও অটুট।
তবে দায়িত্ব ছাড়ার পর ওবামা কেবল একজন মেয়র প্রার্থীকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়েছেন—২০২২ সালে লস অ্যাঞ্জেলেসের ক্যারেন ব্যাসকে। সেই সমর্থনও এসেছিল শেষ মুহূর্তে, যখন তিনি একজন ধনী প্রাক্তন রিপাবলিকান প্রার্থী রিক কারুসোর কাছে হেরে যাওয়ার ঝুঁকিতে ছিলেন।
বর্তমানে জরিপ বলছে, মামদানি, অ্যান্ড্রু কুয়োমো ও কার্টিস স্লিওয়ার লড়াইটি তেমন ঘনিষ্ঠ অবস্থায় নেই। তবু কুয়োমো মামদানির প্রভাব কমাতে পুরনো একটি 'নিউইয়র্ক পোস্ট' প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি টেনে আনেন—যেখানে বলা হয়, এক দশক আগে সামাজিক মাধ্যমে মামদানি ওবামাকে 'অশুভ' বলেছেন। এ বিষয়ে মামদানি পরে সাংবাদিকদের বলেন, সেটি ছিল 'কলেজ জীবনের বোকামিপূর্ণ একটি টুইট।' কুয়োমো এখন সেই মন্তব্যকে কাজে লাগিয়ে কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছেন, যাদের মধ্যে ওবামা এখনও জনপ্রিয়।
ওবামা সবসময়ই প্রার্থীদের প্রকাশ্যে সমর্থন দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক ছিলেন। চলতি বছরের শুরুতে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, হোয়াইট হাউস ছাড়ার পর তিনি নিজেকে 'খেলোয়াড়' থেকে 'কোচ'-এর ভূমিকায় দেখতে চান।
ওবামার ভাষায়, 'দীর্ঘমেয়াদে আমি যদি সত্যিই সহায়ক হতে চাই, তবে আমাকে পরবর্তী প্রজন্মের নেতৃত্ব ও প্রতিভাকে তুলে ধরার কাজ করতে হবে।'
তার ঘনিষ্ঠ এক সূত্র জানিয়েছে, ওবামা মামদানিকে সেই নতুন প্রজন্মের স্বাধীনভাবে উঠে আসা নেতৃত্বের উদাহরণ হিসেবে দেখছেন।
মামদানির প্রচারণা দলে এখন প্রায় ৯০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক যুক্ত হয়েছে। সম্প্রতি তিনি সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স ও প্রতিনিধি আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্তেজের সঙ্গে একটি সমাবেশে অংশ নেন, যেখানে ১৩ হাজারেরও বেশি মানুষ জড়ো হয়।
মামদানির প্রচারণাকে অনেকে ওবামার ২০০৮ সালের নির্বাচনী লড়াইয়ের সঙ্গে তুলনা করছেন—যে লড়াই তরুণ প্রজন্মকে পরিবর্তনের আশায় উজ্জীবিত করেছিল।
ওবামার সাবেক মুখপাত্র এবং বর্তমানে 'পড সেভ আমেরিকা' অনুষ্ঠানের উপস্থাপক টমি ভিয়েটর মামদানিকে সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে বলেন, 'তোমার প্রচারণা আমাকে ২০০৭ সালের কথা মনে করিয়ে দেয়, যখন আমি আইওয়ায় ওবামার হয়ে কাজ করতাম—সবকিছুই তখন ছিল আশায় ও উদ্দীপনায় ভরা।'
জবাবে মামদানি বলেন, 'আশার সঙ্গে আসে এক বিশাল দায়িত্ব—আমি সেই দায়িত্বকে গভীর গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছি।'
