ট্রাম্প-শি বৈঠকের আগে সিউলে 'নো ট্রাম্প!', 'নো চায়না!' বিক্ষোভ: দুই পরাশক্তির টানাপোড়েনের মাঝে দ.কোরিয়া
দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলের কেন্দ্রস্থলে গেল শনিবার 'নো ট্রাম্প!' স্লোগানে মার্কিন দূতাবাসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল শত শত মানুষের একটি বিক্ষোভ মিছিল। যত তারা দূতাবাস ফটকের কাছাকাছি আসছিল, ততই চড়া হচ্ছিল তাদের কণ্ঠস্বর। পুলিশের বাস দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করে তাদের গেটে পৌঁছানো ঠেকানো হলেও, মাইকের কল্যাণে তাদের আওয়াজ গোয়াংওয়ামুন স্কয়ার ছাপিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিনিধিদের কানে পৌঁছেছে ঠিকই।
এদিকে, এর থেকে অল্প দূরে গেয়ংবোকগুং প্রাসাদের সামনে ভেসে আসে ভিন্ন স্লোগান: 'নো চীন', 'সিসিপি (চায়নিজ কমিউনিস্ট পার্টি) দূর হও!'। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিবাদী সংস্কৃতির নিরিখে এই সমাবেশগুলো আকারে ছোট হলেও, এরা ইঙ্গিত দিচ্ছিল এক জটিল কূটনৈতিক পরিস্থিতির, যেখানে দেশটির প্রেসিডেন্ট লি জে-মিয়ংকে একই সপ্তাহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের নেতাদের আতিথ্য দিতে হচ্ছে।
আগামী বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) ট্রাম্প ও শি জিনপিংয়ের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
সিউল ঐতিহাসিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র। ১৯৫০-৫৩ সালের কোরিয়া যুদ্ধে আমেরিকান সেনাদের সহায়তার কথা স্মরণ করে উভয় দেশই তাদের সম্পর্ককে 'রক্ত দিয়ে গড়া' বলে উল্লেখ করে। আজও দক্ষিণ কোরিয়ার নিরাপত্তা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল।
কিন্তু একই সাথে, বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার এবং রপ্তানির প্রধান বাজার হিসেবে চীনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখাও তাদের জন্য অপরিহার্য।
এশিয়া সোসাইটির ইউএস-চায়না রিলেশনস সেন্টারের সিনিয়র ফেলো জন ডেলুরির মতে, এই সফরের মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়ার সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তার জন্য অনেক কিছু বাজি ধরা হয়েছে। তিনি বলেন, 'অদ্ভুতভাবে, ডোনাল্ড ট্রাম্প যত কম সময় এখানে থাকবেন, প্রেসিডেন্ট লি জে-মিয়ংয়ের জন্য ততই ভালো হতে পারে।' কারণ, বাণিজ্য চুক্তিতে কোনো অগ্রগতি হবে বলে আশা করা হচ্ছে না।
প্রেসিডেন্ট লি জে-মিয়ং এর সামনে এখন বেশ কঠিন একটি চ্যালেঞ্জ। ছয় মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতার পর, গত জুনে তার বিপুল বিজয় আসে। লি ক্ষমতা গ্রহণের পরই ট্রাম্পের বাণিজ্য শুল্ক নীতি মিত্র ও প্রতিপক্ষ উভয়কেই হতবাক করে দেয়। গত আগস্টে লি হোয়াইট হাউসে গিয়ে ট্রাম্পকে কিছু ছাড় দেন।
সিউল জানায়, তারা যুক্তরাষ্ট্রে ৩৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে এবং ১০০ বিলিয়ন ডলারের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কিনবে। এর বিনিময়ে ট্রাম্প শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশে আনতে রাজি হন। কিন্তু এরপরই যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ার হুন্দাই কারখানায় ৩০০-র বেশি দক্ষিণ কোরিয়ানকে আটকের ঘটনা সম্পর্কে একটি বড় অভিবাসন অভিযান সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
হোয়াইট হাউস নগদ বিনিয়োগের মতো আরও দাবি নিয়ে এসেছে। চুক্তি স্বাক্ষরের চেষ্টা সত্ত্বেও, কোনো চূড়ান্ত চুক্তি হয়নি। বুধবারের বৈঠকে কোনো অগ্রগতি হবে এমন আশাও কম।
প্রচণ্ড ক্ষোভ ও মোহভঙ্গের একটি কারণ ট্রাম্পের বিতর্কিত রাজনীতি। বিক্ষোভে ২২ বছর বয়সী ছাত্রী কিম সোল-ই ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন বহন করছিলেন। তিনি বলেন, 'যখন তিনি দক্ষিণ কোরিয়াকে 'টাকা তৈরির মেশিন' বলেছিলেন, তখন আমি সত্যিই ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম।' তার মতে, যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়াকে 'ক্যাশ কাউ' হিসেবে দেখছে, সমান অংশীদার হিসেবে গণ্য করছে না।
তবে, জনমত জরিপ অনুযায়ী, বেশিরভাগ দক্ষিণ কোরিয়ান যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের প্রধান মিত্র হিসেবেই দেখে। কিন্তু চীন সম্পর্কে তাদের ধারণা ততটা ইতিবাচক নয়; এক-তৃতীয়াংশ মানুষ চীনকে তাদের দেশের সবচেয়ে বড় হুমকি মনে করে।
২৭ বছর বয়সী পার্ক দা-সম চীনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অংশ নিয়ে বলেন, 'আমি আজ এখানে এসেছি দক্ষিণ কোরিয়াকে ভালোবেসে, দক্ষিণ কোরিয়াকে রক্ষা করতে।' তিনি যোগ করেন, 'আমার মনে হয়, রিপাবলিক অফ কোরিয়া ধীরে ধীরে চীনের প্রভাবে আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে।' তবে তিনি স্বীকার করেন, 'অবশ্যই, আমাদের চীনের সাথে একটি নির্দিষ্ট মাত্রার অনুকূল কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখা উচিত। তবে আমরা সিসিপি (চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টি) অপছন্দ করি।'
২০১৬ সালে সিউল উন্নত মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন করতে রাজি হওয়ার পর থেকেই দক্ষিণ কোরিয়ায় চীন-বিরোধী মনোভাব বাড়তে থাকে। বেইজিং এরপর অর্থনৈতিক প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ঐতিহাসিক বিদ্বেষ তো ছিলই, তার ওপর ইউন-এর অভিশংসন ঘিরে চীনের প্রভাব নিয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ডানপন্থী মহলে অবিশ্বাস আরও বাড়িয়েছে।
লি জে-মিয়ং নিজে চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের পক্ষে। তিনি ভিসা নীতি শিথিল করেছেন এবং আগামী শনিবার শি জিনপিংয়ের সঙ্গে একান্তে বৈঠক করবেন। বেইজিং থেকে অল্প দূরত্ব হওয়া সত্ত্বেও, গত ১১ বছরে এটি শি-র দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রথম সফর।
পর্যবেক্ষকদের মতে, চীন-বিরোধী মনোভাব একটি সংখ্যালঘু মত হলেও, ভিসা নীতি শিথিল করার পর তা কিছুটা বেড়েছে। প্রেসিডেন্ট লি এই ধরনের ঘৃণা বা বৈষম্যমূলক সমাবেশ নিষিদ্ধ করার বিল এনেছেন। তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, তার সরকার চীনের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী।
শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠকের পর অ্যাপেক (APEC) শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে তিনি গিয়ংজুতে যাবেন। ট্রাম্পের চেয়ে বেশি সময় ধরে তিনি দক্ষিণ কোরিয়ায় থাকবেন, যা চীনকে স্থিতিশীল বাণিজ্য অংশীদার ও বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে উপস্থাপনের সুযোগ দেবে। ইউন-এর চীন-কঠোর নীতির বিপরীতে, লি-র বেইজিংয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে আলোচনার পথ খুলতে পারে।
আমেরিকার প্রভাব দক্ষিণ কোরিয়ার সংস্কৃতিতে গভীরভাবে প্রোথিত হলেও, দেশটি এখন একটি ধনী, 'সফট-পাওয়ার' দৈত্য হিসেবে নিজস্ব কণ্ঠস্বর প্রতিষ্ঠা করেছে। কে-পপ, কে-বিউটি বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়। অর্থনীতিও গতি ফিরে পেয়েছে। তবে, এই দুই পরাশক্তির মধ্যে কোন পথে হাঁটবেন প্রেসিডেন্ট লি, তা নির্ধারণ করবে দক্ষিণ কোরিয়ার ভবিষ্যৎ। তিনি কোনো পক্ষকেই অবহেলা করতে পারবেন এমনটা কল্পনা করা কঠিন।
