‘মোনালিসা’ থেকে নাৎসিদের লুটের চেষ্টা: ল্যুভ জাদুঘরের চুরির দীর্ঘ ইতিহাস; তবে কেন এবারের চুরি আলাদা?
শিল্প-সংস্কৃতির পীঠস্থান, ইতিহাসের নীরব সাক্ষী প্যারিসের ল্যুভ জাদুঘর। শত শত বছর ধরে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্মগুলোকে পরম যত্নে আগলে রাখা এই জাদুঘরটি যেন বারবার হয়ে উঠেছে দুঃসাহসী চোরদের লক্ষ্যবস্তু। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না।
গত রোববার সকালে প্যারিসের ল্যুভ জাদুঘরে ঢুকে চার মিনিটের এক দুঃসাহসিক ডাকাতিতে আটটি অমূল্য নেপোলিয়নিক গয়না চুরি করে একদল ডাকাত। এটি ল্যুভ জাদুঘরের চুরির দীর্ঘ ইতিহাসে সর্বশেষ সংযোজন।
জানা যায় , ডাকাতরা একটি ট্রাকের ওপর বসানো মই ব্যবহার করে দ্বিতীয় তলার সোনালী 'গ্যালারি ডি'অ্যাপোলোন' (অ্যাপোলো গ্যালারি)-তে পৌঁছায়। এরপর তারা একটি অ্যাঙ্গেল গ্রাইন্ডার দিয়ে জানালা কেটে ফরাসি রাজকীয় গয়না রাখার কক্ষে প্রবেশ করে।
রবিবার সকালে জাদুঘরটি দর্শনার্থীদের জন্য খোলার মাত্র আধা ঘণ্টা পর এই ডাকাতির ঘটনাটি ঘটে। ফরাসি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, চুরি হওয়া নেপোলিয়ন তৃতীয়ের স্ত্রী সম্রাজ্ঞী ইউজেনির মুকুট লুটেরাদের দ্বারা ফেলে যাওয়ার পর উদ্ধার করা হয়েছে। ডাকাতরা এখনও পলাতক এবং ল্যুভ জাদুঘর বর্তমানে বন্ধ রয়েছে।
দুই শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ল্যুভ একটি রাজকীয় প্রাসাদ ছিল। ফরাসি বিপ্লবের সময়, ১৭৯৩ সালে এটি একটি পাবলিক জাদুঘর হিসেবে খোলা হয়। বিপ্লবের ফলে রাজতান্ত্রিক ইতিহাসের নিদর্শনগুলো লুটেরাদের কাছে বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছিল। ল্যুভ সাধারণ ফরাসি জনগণকে এই মূল্যবান জিনিসগুলো দেখার সুযোগ দেওয়ার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তাদের প্রতিনিধিত্ব করা ঐতিহ্যকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিল।
ল্যুভ এসব মূল্যবান জিনিস রক্ষার চেষ্টা করলেও চোরদের সম্পূর্ণরূপে আটকাতে পারেনি। সময়ের সাথে সাথে ল্যুভ থেকে মূল্যবান জিনিস চুরি করার বেশ কয়েকটি প্রচেষ্টা হয়েছে - প্রায়শই সফলভাবে।
১৯১১: যখন চুরি হয়েছিল মোনালিসা
ল্যুভ চুরির ইতিহাসে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ছিল ১৯১১ সালের ২১ আগস্ট লিওনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকা মোনালিসা চিত্রকর্মটি চুরি হয়ে যাওয়া। এটি সে সময় 'শতাব্দীর ডাকাতি' হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। অনেকের মতে, এই চুরিই চিত্রকর্মটিকে আধুনিক খ্যাতি এনে দিয়েছে।
ভিনসেঞ্জো পেরুজিয়া নামের এক ইতালীয় অভিবাসী, যিনি ল্যুভতে অল্প সময়ের জন্য কাজ করেছিলেন, এই ডাকাতির মূল হোতা ছিলেন। তিনি পুরনো জাদুঘরের ইউনিফর্ম পরে বিনা বাধায় জাদুঘরে প্রবেশ করেন, একটি স্টোরেজ আলমারিতে লুকিয়ে ছিলেন এবং সকালে জাদুঘর প্রায় খালি থাকাকালীন দেয়াল থেকে ছবিটি সরিয়ে নিয়ে যান। এমনকি, একজন প্লাম্বার তাকে সহকর্মী ভেবে তালাবদ্ধ দরজা খুলতেও সাহায্য করেন।
নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে একদিনের বেশি সময় মোনালিসার অনুপস্থিতি কেউ টেরই পাননি। পরবর্তীতে এক শিল্পী ছবিটি না দেখে উদ্বেগ প্রকাশ করলে পুলিশে খবর দেওয়া হয়। অ্যাভান্ট-গার্ড কবি গুইলাউম অ্যাপোলিনায়ার এবং পাবলো পিকাসোকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল, যদিও তারা নির্দোষ প্রমাণিত হন।
তবে পিকাসোর কাছে ল্যুভ থেকে চুরি হওয়া ইবেরিয়ান মূর্তির মাথা পাওয়া যায়, যা তিনি পরে ফেরত দেন। মোনালিসা ছবিটি পেরুজিয়ার প্যারিসের এক অ্যাপার্টমেন্টেই ছিল এবং ১৯১৩ সালে ইতালির একটি গ্যালারিতে বিক্রি করার চেষ্টার সময় তিনি গ্রেপ্তার হন। ১৯১৪ সালে ছবিটি ল্যুভতে ফেরত আনা হয়। পেরুজিয়া দাবি করেছিলেন, জাতীয়তাবোধ থেকেই তিনি ছবিটি চুরি করেছিলেন।
১৯৪০-এর দশক: নাৎসিদের লুটপাটের ব্যর্থ প্রচেষ্টা
১৯৪০ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি বাহিনী ফ্রান্স দখল করে ল্যুভ লুট করার প্রস্তুতি নিলেও, ফ্রান্সের জাতীয় জাদুঘরের পরিচালক জ্যাক জোজার্ডের দূরদর্শী পদক্ষেপের কারণে তা সম্ভব হয়নি। তিনি মোনালিসাসহ ল্যুভর ১৮০০টিরও বেশি মূল্যবান শিল্পকর্ম ফরাসি গ্রামাঞ্চলে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেন, ফলে নাৎসি সেনারা খালি জাদুঘরের মুখোমুখি হয়।
তবে, নাৎসিরা ইহুদিদের মালিকানাধীন অনেক শিল্পকর্ম চুরি করেছিল, যার বেশিরভাগই ফ্রান্সে ফিরিয়ে আনা হয়েছে এবং ল্যুভ ২০১৮ সাল থেকে এগুলো প্রদর্শন শুরু করেছে।
এছাড়াও ১৯৬৬ সালে নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ল্যুভ থেকে ধার দেওয়া পাঁচটি প্রাচীন গয়না চুরি হয়। পরে সেগুলো একটি মুদি দোকানের ব্যাগ থেকে উদ্ধার করা হয় এবং তিনজন গ্রেপ্তার হয়। ১৯৯০ সালে ল্যুভর তৃতীয় তলা থেকে পিয়েরে অগাস্ট রেনোয়ারের 'পোর্ট্রেট অব অ্যা সিটেড ওম্যান' নামের চিত্রকর্মটি ফ্রেম থেকে কেটে চুরি করা হয়। একই সময়ে কিছু ছোট গয়নাও নিখোঁজ পাওয়া যায়, যদিও সেগুলোর মূল্য খুব বেশি ছিল না।
কেন এবারের চুরি আলাদা?
এই সপ্তাহের গয়না চুরির ঘটনাটি আগের উচ্চ প্রোফাইল চুরিগুলোর থেকে ভিন্ন, কারণ সেগুলো ছিল মূলত চিত্রকর্ম। আমেরিকান শিল্প ইতিহাসবিদ নোহা চার্নি বলেন, 'গয়না চুরি একটি ভিন্ন বিষয়, কারণ চুরি হওয়া বস্তুর নিজস্ব অন্তর্নিহিত মূল্য অনেক বেশি।'
চিত্রকর্মের মূল্য তার সাংস্কৃতিক গুরুত্বের কারণে নির্ধারিত হয়, যেখানে গয়নার মূল্য তার উপাদানগুলোর (যেমন হীরা, সোনা) কারণেও অনেক বেশি থাকে। চোরেরা গয়নার সাংস্কৃতিক মূল্যের চেয়ে এর উপাদানগুলোর দিকেই বেশি আগ্রহী হয়।
নোহা চার্নি আরও জানান, চুরি হওয়া গয়নাগুলো ভেঙে, নতুন করে কেটে বিক্রি করা যায়, যা সেগুলোকে অক্ষত চুরি যাওয়া জিনিসের সঙ্গে যুক্ত করা কঠিন করে তোলে। এর ফলে সেগুলো খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। যদি গয়নাগুলো এতটাই উল্লেখযোগ্যভাবে পুনরায় কাটা হয় যে সেগুলো আর সনাক্ত করা না যায়, তবে সেগুলোর কালো বাজারে থাকারও প্রয়োজন হয় না।
চার্নি বলেন, 'পুলিশের একমাত্র আশা হলো, যদি তারা অক্ষত সব গয়না পুনরুদ্ধারের জন্য এমন একটি পুরস্কারের ঘোষণা করে যা গয়নার উপাদানগুলির মোট মূল্যের চেয়ে বেশি।' এমন পদক্ষেপ হয়তো পুলিশকে আরও কিছু সময় দেবে অপরাধীদের ধরতে, যখন চোরেরা তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে চিন্তাভাবনা করবে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, 'অন্যথায়, এই জিনিসগুলো পুনরুদ্ধার হওয়ার খুব বেশি আশা নেই। সম্ভবত চুরির কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেগুলোকে ভেঙে ফেলা হয়েছে।'
