দৃষ্টিসীমার প্রচলিত গণ্ডির বাইরেও আঘাত হানতে সক্ষম নতুন টাইপ-১০০ ট্যাংক, দাবি চীনের

চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) আনুষ্ঠানিকভাবে টাইপ-১০০ নামের চতুর্থ প্রজন্মের ট্যাংক তাদের সার্ভিসে আনতে শুরু করেছে। নতুন এই ট্যাংক সাধারণ থার্মাল সাইট, নাইটভিশন বা ট্যাংক কমান্ডারের সাইটে দেখা যায় না এমন এমন দূরত্বের লক্ষ্যবস্তুতেও আঘাত হানতে পারে। একইসঙ্গে এর রয়েছে নেটওয়ার্কভিত্তিক যুদ্ধ পরিচালনার সক্ষমতা।
আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হচ্ছে, দৃষ্টিসীমার প্রচলিত গণ্ডির বাইরে গিয়ে আঘাত হানবে এই ট্যাংকের ছোড়া গোলা ও মিসাইল। তবে এখানে শুধু খালি চোখে দেখার সীমাকেই বলা হচ্ছে না, যার প্রচলন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়েই ফুরিয়ে আসে। তাছাড়া আধুনিক ট্যাংকের সাইট ও সেন্সর সেই দৃষ্টিসীমাকে বহুদূর বিস্তৃত করে, তবে তারও একটা সীমা আছে। সেটাকেই দৃষ্টিসীমার প্রচলিত গণ্ডি বলা হচ্ছে এখানে।
চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমস গত ১৩ অক্টোবর জানিয়েছে, টাইপ-১০০ মেইন ব্যাটল ট্যাংককে কেন্দ্র করে চীনের গণমুক্তি ফৌজের সেনাবাহিনী এক নতুন ধরনের যুদ্ধের মডেল তৈরি করেছে। কারণ এই ট্যাংক অপটিক্যাল, ইনফ্রারেড ও রাডার সেন্সর যুক্ত, আবার নেটওয়ার্ক যোগাযোগের মাধ্যমে বিমান, আর্টিলারি ও ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার ইউনিটের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে। অর্থাৎ, বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে শত্রুর অবস্থানের স্পষ্ট চিত্র পায় ট্যাংকের ক্রুরা। ফলে তার ওপর আক্রমণও করতে পারে সরাসরি না দেখেই।
সাম্প্রতিক যৌথ মহড়ায় এই ট্যাংকগুলো অগমেন্টেড রিয়েলিটি (এআর) ইন্টারফেস ও হাইব্রিড ডিজেল-ইলেকট্রিক ইঞ্জিন ব্যবহার করে চোখের আড়াল থেকে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার সেই সক্ষমতা প্রদর্শনও করেছে।
টাইপ ১০০ বা জেটিজে-১০০ এর নকশা করেছে চীনের ২০১তম রিসার্চ ইনস্টিটিউট, আর উৎপাদন করছে বাওতো ট্যাংক প্ল্যান্ট। ডিজিটাল প্রযুক্তিনির্ভর এই ট্যাংকে ঐতিহ্যবাহী ভারী আর্মারের পরিবর্তে ডেটা সংযোগ, সক্রিয় প্রতিরক্ষা ও বহুমাত্রিক যুদ্ধ সমন্বয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। গ্লোবাল টাইমস জানিয়েছে, পিএলএ এখন এমন এক যুদ্ধ কাঠামোর দিকে এগোচ্ছে যেখানে সাঁজোয়া ইউনিটগুলো সরাসরি দৃশ্যমানতা ছাড়াই দীর্ঘ দূরত্বে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারে।
মহড়ায় অংশ নেওয়া ট্যাংক কমান্ডার সান ইয়ংমিং জানান, নতুন সিস্টেমগুলো ট্যাংক ক্রুদের সব দিক থেকে যুদ্ধক্ষেত্র দেখার ও দূর থেকে আক্রমণ চালানোর সুযোগ দেয়, যা নিকট দূরত্বের যুদ্ধ থেকে দূর-পাল্লার যুদ্ধের যুগে প্রবেশের জন্য দরকার। আরেক কমান্ডার, ইউয়ান, বলেন যে তিনি এখন তার ব্যাটালিয়নের পাশাপাশি বিমান ও অন্যান্য ইউনিটের সঙ্গে সমন্বয় করে অভিযান পরিচালনা করতে পারেন, যা চীনের যুগপৎ যুদ্ধ কাঠামোর সক্ষমতা তুলে ধরছে।
চলতি বছরের ৩ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয় উপলক্ষে জমকালো এক সামরিক কুচকাওয়াজের আয়োজন করে চীন। বেইজিংয়ের ওই প্যারেডে অন্যান্য অত্যাধুনিক যুদ্ধসরঞ্জমের পাশাপাশি টাইপ-১০০ ট্যাংকও প্রথমবারের মতো প্রদর্শিত হয়।
এতে রয়েছে ১০৫ মিমি স্বয়ংক্রিয় মূল কামান, যা প্রায় ১,৭০৬ মিটার/সেকেন্ড বেগে আর্মার-পিয়ার্সিং শেল নিক্ষেপ করতে সক্ষম — যা পশ্চিমা ১২০ মিমি ও রুশ ১২৫ মিমি কামানের সঙ্গে তুলনীয়। সহায়ক অস্ত্র হিসেবে এতে রয়েছে ৭.৬২ মিমি কোঅক্সিয়াল মেশিনগান এবং ১২.৭ মিমি রিমোট ওয়েপন স্টেশন, যা ড্রোন ও অপেক্ষাকৃত নিচু দিয়ে উড়ে আসা শত্রুর বিমান বা হেলিকপ্টারের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষায় ব্যবহৃত হবে।
এই ট্যাংকের মানববিহীন টারেট নকশা ক্রুদের জন্য বাড়তি সুরক্ষা এবং গোলাবারুদ সংরক্ষণের জায়গা বাড়িয়েছে।
চতুর্থ প্রজন্মের এই ট্যাংকের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অ্যাকটিভ ডিফেন্স ও মাল্টি-স্পেকট্রাল প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে। এতে রয়েছে দুটি জিএল-6 অ্যাকটিভ প্রটেকশন সিস্টেম, এর চারটি টিউব থেকে ছোড়া গোলা ধেয়ে আসা শত্রুপক্ষের গোলা বা মিসাইলকে ট্যাংকে আঘাত হানার আগেই ধ্বংস করতে সক্ষম। শত্রুর গোলা শনাক্ত করতে এতে রয়েছে ফেজড-অ্যারে রাডার প্যানেল, যা ট্যাংকের চারদিকেই নজর রাখে এবং ৩৬০-ডিগ্রি সুরক্ষা দেয়।
এছাড়া লেজার ও আলট্রা-ভায়োলেট সেন্সর এবং মাল্টি-ব্যান্ড অপটিক্যাল ডিটেকশন সিস্টেম যুক্ত করা হয়েছে।
হাইব্রিড ডিজেল-ইলেকট্রিক ইঞ্জিনটি ১,৫০০ হর্সপাওয়ার সক্ষমতার, যা ট্যাংকটিকে পাকা সড়কে সর্বোচ্চ ৮০ কিলোমিটার গতিতে চলার সক্ষমতা দেয়। আর অফরোড সক্ষমতা ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার। ইঞ্জিনটি নিঃশব্দে চলাচলের ক্ষমতা রাখে, যা গোপন অভিযানে বিশেষ সুবিধা দেয়।