বিশ্বজুড়ে স্বর্ণ উন্মাদনা: রেকো ডিক খনি ঘিরে পাকিস্তানের ১৫০ বিলিয়ন ডলারের স্বপ্ন

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ও দেশটির সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির গত সেপ্টেম্বরে হোয়াইট হাউজের ওভাল অফিসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে একটি গোপন বৈঠক করেন। বৈঠকে গণমাধ্যমের উপস্থিতি ছিল না, কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতিও প্রকাশ করা হয়নি। হোয়াইট হাউসের প্রকাশ করা কিছু ছবিই এর একমাত্র প্রমাণ। প্রকাশিত একটি ছবিতে দেখা যায়, ফিল্ড মার্শাল মুনির ট্রাম্পকে খনিজের নমুনা ভর্তি একটি বাক্স দেখাচ্ছেন।
এই বৈঠককে দুই দেশের সম্পর্কের নতুন উষ্ণতার ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হচ্ছে। এর আগেও গত জুনে ট্রাম্প ও মুনির একসঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ করেন—যদিও তার মাত্র এক মাস আগে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে চার দিনের সামরিক উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল। প্রশ্ন উঠেছে, পাকিস্তানের খনিজ সম্পদই কি এই সম্পর্কের ভিত্তি?
প্রাথমিকভাবে দেখলে বলা যায়, পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ খনিজ সম্পদের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। বেলুচিস্তান প্রদেশের রেকো ডিক খনিকে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অনাবিষ্কৃত স্বর্ণ ও তামার খনি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। খনিটি চালু হলে পরবর্তী ৪০ বছরে প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলার রাজস্ব আসতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
১৯৯৩ সাল থেকে নানা আন্তর্জাতিক কোম্পানি খনিটি চালু করার চেষ্টা করলেও আর্থিক, আইনি ও রাজনৈতিক জটিলতায় তা সম্ভব হয়নি। তবে, এবার কানাডাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ব্যারিক গোল্ড তিনটি পাকিস্তানি রাষ্ট্রীয় সংস্থা ও বেলুচিস্তান প্রাদেশিক সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে প্রকল্পটি হাতে নিয়েছে। চলতি বছরই সেখানে কাজ শুরু হওয়ার কথা। বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) প্রকল্পটির জন্য অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে; এমনকি ট্রাম্পও এতে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়ন অর্থায়ন সংস্থাগুলো এককালীন ১ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ঋণ দেওয়ার সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করছে।
তবে খনন প্রকল্পটি নানা ঝুঁকিতে পরিপূর্ণ। এর অবস্থান আফগানিস্তান ও ইরানের সীমান্তঘেঁষা এলাকায়। পূর্ব বেলুচিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতায় প্রকল্পটি ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। অস্ট্রেলীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব ইকোনমিকস অ্যান্ড পিস-এর তালিকায় সন্ত্রাসবাদে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে বুরকিনা ফাসোর পরেই পাকিস্তানের অবস্থান।
আরেকটি বড় সমস্যা হলো—খনি থেকে উত্তোলিত তামা ও স্বর্ণ রপ্তানির পথ। পাকিস্তান, ব্যারিক এবং সম্ভাব্য ঋণদাতারা খনিটিকে চীনের প্রভাবমুক্ত রাখতে চাইছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাই আপাতত সিদ্ধান্ত হয়েছে, খনিজগুলো গওয়াদরের বদলে দূরবর্তী করাচি বন্দরের মাধ্যমে রপ্তানি করা হবে। কিন্তু করাচি পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ৩৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথের অবস্থা খুবই নাজুক।
চীন একসময় এই রেলপথ সংস্কারে ৭ বিলিয়ন ডলারের অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেটি একপ্রকার নীরবেই প্রত্যাহার করেছে। ঘাটতি পূরণে পাকিস্তান সরকার ৩৯০ মিলিয়ন ডলারের তহবিল অনুমোদন করেছে, যদিও অর্থের উৎস এখনও অনিশ্চিত। এডিবিও সরকারকে অতিরিক্ত ২ বিলিয়ন ডলারের এককালীন ঋণ দেওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত আলোচনা করছে (খনির জন্য আলাদাভাবে ৪১০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ ছাড়াও)।
ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত মাসের বৈঠকের আগে প্রস্তুত করা একটি অনানুষ্ঠানিক পরিকল্পনায় গওয়াদরের পাশে নতুন একটি বন্দর নির্মাণের প্রস্তাব ছিল। বন্দরের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ১.২ বিলিয়ন ডলার এবং এতে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক সহায়তার সম্ভাবনাও উল্লেখ ছিল। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বৈঠকে এ বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।
পাকিস্তানের এই পদক্ষেপ চীনের সঙ্গে তার সম্পর্ককে কীভাবে প্রভাবিত করবে, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। বেইজিং এতে অসন্তুষ্ট হলেও তাদের হাতে এখন চাপ প্রয়োগের খুব বেশি উপায় নেই। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি)-এর অধীনে নির্মাণকাজের মাধ্যমে স্থিতিশীলতা আনার যে কৌশল বেইজিং অনুসরণ করেছিল, তা থেকে তারা ধীরে ধীরে সরে আসছে। এখন 'সিপিইসি ২.০'-এর আওতায় জ্ঞান, টেকসই উন্নয়ন ও প্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে চীন।
এদিকে সময় ফুরিয়ে আসছে পাকিস্তানের জন্য। রেকো ডিক খনি ২০২৮ সালে উৎপাদন শুরু করবে; যা ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ বছর। বৈশ্বিক খনিজ উন্মাদনা, যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্কের উষ্ণতা ও বাণিজ্যিক অবস্থার জন্য এটি খুবই ক্ষণস্থায়ী সুযোগও বটে। এখন যদি খনি প্রকল্পটি বাস্তবায়িত না হয়, তবে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনা হয়তো সেই স্বর্ণের মতোই মাটির নিচে চাপা পড়ে থাকবে।