আমি যদি আরও বেশি পরিশ্রম করি, তুমি কি আমাকে ভালোবাসবে?

সফল মানুষদের জগৎটা একবার উঁকি দিয়ে দেখুন তো! দেখবেন, তাদের দিন-রাত কাটে কেবল কাজেই। দিন মানে ১৩ ঘণ্টার ডিউটি, সপ্তাহ মানে সাত দিনই অফিস, আর ছুটি? সে তো ক্যালেন্ডারে থাকা একটা শব্দ মাত্র। অনেকের মধ্যেই দেখা যায় এমন এক অদ্ভুত নেশা, যার নাম 'ওয়ার্কোহলিজম' বা কাজের প্রতি তীব্র আসক্তি।
এই নেশার লক্ষণগুলো বেশ স্পষ্ট: ছুটির দিনেও ল্যাপটপ কোলে বসে থাকা, বন্ধুদের আড্ডায় বসেও অফিসের কথা ভাবা, আর যতটা না দরকার, তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি খেটে চলা। মজার ব্যাপার হলো, তাদের টাকার অভাব নেই, কিন্তু এই খাটুনিতে আনন্দও নেই!
এই ছবির সাথে কি নিজের জীবনের মিল খুঁজে পাচ্ছেন? যারা শুধু কাজকেই জীবনের কেন্দ্রবিন্দু বানিয়ে ফেলেন, এমনকি কাজের বাইরে অন্য সময়েও মানসিকভাবে অন্য কোথাও হারিয়ে থাকেন, তাদের জীবন থেকে আনন্দ, তৃপ্তি আর বেঁচে থাকার অর্থটাই যেন মুছে যায়। সবচেয়ে বড় সর্বনাশটা হয় ব্যক্তিগত জীবনে। কারণ ভালোবাসা আর সম্পর্ক যত্ন চায়, যা এই কাজের নেশা কেড়ে নেয়। একটি সুস্থ সম্পর্কের জন্য যে সময়, শক্তি আর চেষ্টা দরকার, তা দেওয়ার ফুরসত কোথায়?
অন্যান্য নেশার মতোই, একজন কাজপাগল মানুষকে যদি বলা হয়, "ভাই, কাজটা একটু কমাও," তাহলে ব্যাপারটা হাস্যকর শোনায়। মনে হয় যেন এই পরামর্শ শুনলেই তিনি কপালে হাত চাপড়ে বলবেন, "আরে! এটা তো মাথায়ই আসেনি!" আসল কথা হলো, এই সমস্যার সমাধান উপদেশে নেই, আছে এর পেছনের কারণটা খুঁজে বের করার মধ্যে।
আসলে এই নেশার পেছনে লুকিয়ে আছে এক গভীর, কিন্তু ভুল বিশ্বাস। তা হলো, প্রিয়জনদের—সে জীবনসঙ্গী হোক, বাবা-মা বা বন্ধু—ভালোবাসা পেতে হলে অবিরাম খেটে যেতে হবে, নিজেকে সবার সেরা প্রমাণ করতে হবে। আর এই ভুল ধারণাটাই হলো জীবনের সবচেয়ে বড় ফাঁদ। কিন্তু এর পেছনের কারণটা ধরতে পারলেই মুক্তির পথও খুঁজে পাওয়া সম্ভব।

জীবনে পুরস্কার মেলে দুই রকমের। এক ধরনের পুরস্কার হলো ভেতরের, যা টাকা দিয়ে কেনা যায় না, যেমন—মন খুলে হাসা বা সত্যিকারের ভালোবাসা। আরেক ধরনের পুরস্কার হলো বাইরের, যা কেনা যায়, যেমন—দামী গাড়ি বা বড় বাড়ি।
আমাদের দুটোই লাগে, কিন্তু গবেষণায় বারবার এটাই প্রমাণিত হয়েছে যে, বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয়টুকু একবার জোগাড় হয়ে গেলে, মানুষ ভেতরের পুরস্কার থেকেই আসল শান্তি পায়। ভেবে দেখুন তো, কোনটা বেশি দামী? ঝকঝকে ফেরারি হাঁকিয়ে একা একা কোনো দামী রেস্তোরাঁয় বসে থাকা? নাকি প্রিয় বন্ধুদের সাথে পুরোনো একটা গাড়িতে চড়ে ঘোরা বা রাস্তার ধারের কোনো টং দোকানে বসে মন খুলে আড্ডা দেওয়া?
তবুও, লাখ লাখ সফল মানুষ এমনভাবে ছোটেন, যেন বাইরের পুরস্কারটাই সব। তারা পরিবার আর বন্ধুদের অবহেলা করে শুধু কাজের পেছনেই ছোটেন। এটাকে এক ধরনের মানসিক গোলযোগ বলা চলে, যার ফলে তারা টাকা দিয়ে ভালোবাসা কেনার মরীচিকার পেছনে ছোটেন। অবচেতন মনে তারা হয়তো ভাবেন, 'আমি যদি আরও সফল হই, আরও টাকা কামাই, তাহলেই আমি সেই ভালোবাসা পাব, যা আমি মন থেকে চাই।'
কিন্তু এমন একটা ভুল ধারণা মাথায় ঢোকে কীভাবে? এর বীজ বোনা থাকতে পারে সেই ছোটবেলায়। যে বাবা-মায়েরা নিজেরা কাজপাগল, তাদের সন্তানরাও প্রায়ই সেই পথেই হাঁটে। ছোটবেলায় যদি কেউ দেখে যে তার বাবা-মা সারাদিন বাড়ির বাইরে, তাহলে বড় হয়ে সেও এই আচরণকেই দায়িত্বশীলতার প্রতীক বলে মনে করতে পারে।

অনেক সময় বাবা-মায়েরা সন্তানের ভালোবাসার সাথে জুড়ে দেন। "যদি পরীক্ষায় ফার্স্ট হও, তবেই তুমি ভালো ছেলে।" ভালো উদ্দেশ্য থাকলেও, এই কথাগুলো শিশুর মনে গেঁথে দেয় এক ভয়ঙ্কর ধারণা: ভালোবাসা এমনি এমনি পাওয়া যায় না, তা অর্জন করতে হয়।
একজন কাজপাগল মানুষের গল্পটা হয়তো এমনই: ছোটবেলায় বাবা-মায়ের মনোযোগ পেতে হলে তাকে পরীক্ষায় ভালো ফল করতে হতো, নয়তো খেলাধুলায় জিততে হতো। বুদ্ধিমান শিশুটি তখন মনে মনে একটা সমীকরণ মিলিয়ে নেয়: 'আমার দাম তখনই, যখন আমি কিছু জিতি বা সেরা হই।' সেই জেতার দৌড় শৈশবে শুরু হয়েছিল বাবা-মায়ের মনোযোগ পাওয়ার জন্য, আর বড়বেলায় তা রূপ নেয় অন্যদের ভালোবাসা পাওয়ার চেষ্টায়।
যাদের মধ্যে কাজের এই নেশা তৈরি হচ্ছে, তারা একটা সময়ে গিয়ে দেয়ালে ধাক্কা খান। তারা দেখেন, যা পাচ্ছেন, তার চেয়ে হারাচ্ছেন অনেক বেশি। এই অতিরিক্ত কাজ করার অভ্যাস নিয়ে তারা হয়তো গর্ব করেন, কিন্তু অবাক হন এটা ভেবে যে, এত ভালো একটা গুণের জন্য বাড়িতে প্রশংসা না পেয়ে উল্টো কেন অভিযোগ শুনতে হয়। এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসার জন্য তিনটি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
১. নিজের আয়নার সামনে দাঁড়ান
ছোটবেলার কথা ভাবুন। বাবা-মায়ের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য কি আপনাকে সবসময় সেরা হতে হতো? 'ভালো ছাত্র' বা 'মেধাবী সন্তান'—এই তকমাগুলো পেলেই কি নিজেকে ভালোবাসার যোগ্য মনে হতো? যদি উত্তর 'হ্যাঁ' হয়, তবে বাবা-মায়ের ওপর রাগ করবেন না। তারা হয়তো তাদের সাধ্যমতোই চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এর ফল যা হয়েছে, তা হলো আপনার মাথার ভেতরে একটা অদৃশ্য বার্তা লেখা হয়ে গেছে: 'তুমি যেমন, তেমনভাবে ভালোবাসার যোগ্য নও, তাই তোমাকে সবসময় জিততে হবে।' সেই জেতার দৌড় আপনি আজও দৌড়ে চলেছেন।

২. যা পেতে চান, আগে তা-ই দিন
বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের একটা দারুণ কথা আছে: "ভালোবাসা পেতে চাও? তাহলে আগে ভালোবাসো এবং ভালোবাসার যোগ্য হও।" এর সহজ অর্থ হলো, ভালোবাসা পেতে হলে ভালোবাসা দিতে হয়। টাকা বা দামী উপহার নয়, দিন আপনার অমূল্য সময় আর মনোযোগ। একবার চেষ্টা করেই দেখুন না: একদিনের জন্য কাজ থেকে ছুটি নিন, ফোনটা বন্ধ রাখুন, আর আপনার ভালোবাসার মানুষটিকে সারাদিন ধরে সেই মনোযোগ দিন, যার জন্য তিনি হয়তো অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন।
৩. শুধু ভাবলেই হবে না, এবার কাজে নামুন
একদিনে কিছুই বদলায় না। কোনো নেশা রাতারাতি ছাড়া যায় না। এর জন্য দরকার পরিকল্পনা আর প্রতিজ্ঞা। নিজের কাজের নেশার কথা স্বীকার করুন, এর পেছনের কারণটা বুঝুন এবং প্রিয়জনদের সাথে বসে জীবনটাকে নতুন করে সাজানোর একটা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করুন। হতে পারে সেটা চাকরি বদলানো, প্রতি মাসে ঘুরতে যাওয়া, অথবা আপনার পরিবর্তনে নজর রাখার জন্য পরিবারকে দায়িত্ব দেওয়া।
সবশেষে একটা ছোট্ট গল্প বলি, যা হয়তো হাজারটা গবেষণার চেয়েও বেশি কিছু বলে দেবে। অনেক ধনী এক বয়স্ক ব্যক্তি বলছিলেন, কীভাবে তিনি তার ভাগ্য গড়ার জন্য নিজেকে তিলে তিলে শেষ করে দিয়েছেন। কয়েক দশক ধরে তিনি যখন তার কোম্পানিকে বড় করতে ব্যস্ত, তখন স্ত্রী-সন্তানদের সাথে কথা বলারও ফুরসত পাননি।
তিনি স্বপ্ন দেখতেন, একদিন যখন অনেক টাকা হবে, তখন জীবনটা কতই না সুন্দর হবে! তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ধনী হলে জীবনটা কেমন হবে বলে ভাবতেন।
তিনি বললেন, ভাবতাম আলিশান বাড়ি-গাড়ির কথা। "কিন্তু সবচেয়ে বেশি যা ভাবতাম," তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, "তা হলো, আমি ধনী হলে আমার স্ত্রী আমাকে ভালোবাসবে।"
"তারপর?"
"সে বাসেনি।"
গল্পটা এখানেই শেষ।
অনুবাদ: নাফিসা ইসলাম মেঘা