ট্রাম্পকে বশ করে হোয়াইট হাউসে যেভাবে 'জেলেনস্কির পরিণতি’ এড়ালেন দ.কোরিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট

২৫শে আগস্ট দক্ষিণ কোরিয়ার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট লি জে মিয়ংয়ের সঙ্গে বৈঠকের ঠিক কয়েক ঘণ্টা আগে নিজের ট্রুথ সোশ্যালে একটি পোস্ট করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেখানে তিনি লি জে মিয়ংয়ের বামপন্থী সরকারকে রক্ষণশীল বিরোধীদের নির্মূল করার অভিযোগে অভিযুক্ত করে লেখেন: 'দক্ষিণ কোরিয়ায় কী হচ্ছে?'
ট্রাম্পের এমন মন্তব্যে লি-এর উপদেষ্টারা আশঙ্কা করেছিলেন যে হোয়াইট হাউসে তাদের একটি 'জেলেনস্কি মুহূর্তের' মুখোমুখি হতে হতে পারে। কিন্তু লি জে মিয়ং শান্ত থাকেন এবং হোয়াইট হাউসের সুবর্ণ সংস্কারের প্রশংসা করে কথোপকথন শুরু করেন। এতে ট্রাম্পের সুর দ্রুত পরিবর্তিত হয়: 'আমাদের দারুণ সম্পর্ক হতে চলেছে!' বলেন তিনি।
এই শীর্ষ সম্মেলনটি লি জে মিয়ংয়ের জন্য একটি সফল কূটনৈতিক অভিষেকের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। জুন মাসের শুরুতে পূর্বসূরি ইউন সুক ইওলের অভিশংসনের পর ক্ষমতা গ্রহণ করা নতুন প্রেসিডেন্টের আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা ছিল সামান্যই। তিনি দারিদ্র্যের মধ্যে বেড়ে উঠেছেন, একজন শ্রমিক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন এবং স্থানীয় কর্মকর্তা হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনীতিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। প্রচারণার সময় তিনি বাস্তববাদী পররাষ্ট্রনীতির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কিন্তু সমালোচকরা প্রথমে সন্দিহান ছিলেন তা বাস্তবায়ন করতে পারবেন কি না। এখন পর্যন্ত তিনি ধীরে ধীরে সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করছেন।
লি জে মিয়ংয়ের এই সফর টোকিওতে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। বিরোধী ডেমোক্রেটিক পার্টির (ডিপি) নেতা হিসেবে লি, জাপানের সঙ্গে ইউন সুক ইওলের সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার সমালোচনা করেছিলেন। ডিপি প্রশাসনগুলো সাধারণত দক্ষিণ কোরিয়ার প্রাক্তন ঔপনিবেশিক প্রভুদের প্রতি কঠোর মনোভাব পোষণ করে থাকে। কিন্তু দুই দেশের তিক্ত অতীত স্মরণ করে টোকিওতে লি দুই প্রতিবেশীর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার পক্ষে সমর্থন জানান। ১৯৬৫ সালে সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার পর থেকে তিনি প্রথম দক্ষিণ কোরিয়ান নেতা হিসেবে জাপানকে তার প্রথম বিদেশ সফরের গন্তব্য হিসেবে বেছে নেন।
সম্ভবত দেশের জনমতের বড় ধরনের পরিবর্তনই প্রেসিডেন্ট লি জে মিয়ংকে এমন আত্মবিশ্বাসী পদক্ষেপ নিতে প্ররোচিত করে। দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপান জনসংখ্যাগত পরিবর্তন থেকে শুরু করে আগ্রাসী প্রতিবেশীদের মতো একই ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। লি জে মিয়ং জানান, জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইশিবা শিগেনুর সঙ্গে তার বৈঠক নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি সময় ধরে চলেছিল, কারণ তারা তাদের ক্রমবর্ধমান অননুমেয় মিত্র আমেরিকার সঙ্গে কীভাবে আলোচনা করা যায় তা নিয়ে আলাপ করছিলেন।
ওয়াশিংটনে পৌঁছার পর লি জে মিয়ং ট্রাম্পের সঙ্গে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে বেশ পারদর্শী ছিলেন। তিনি ট্রাম্পের তত্ত্বাবধানে উৎপাদন খাতের 'পুনর্জন্ম' এবং সমৃদ্ধ স্টক মার্কেটের প্রশংসা করেন। লি একটি কাস্টম-মেড গল্ফ পাটার উপহার দেন, যা জাপানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী আবে শিনজোর কৌশল অনুসরণ করে তৈরি করা হয়েছিল। ট্রাম্প যখন লি জে মিয়ংয়ের ফাউন্টেন পেনের প্রতি আগ্রহ দেখালেন, তখন তিনি সেটিও উপহার হিসেবে দেন।
মূলত, লি জে মিয়ং ওয়াশিংটনে অনেক ভালো খবর নিয়ে এসেছিলেন। একটি থিঙ্ক-ট্যাঙ্কে দেওয়া বক্তৃতায় তিনি প্রতিরক্ষায় আরও বেশি ব্যয় করার প্রতিশ্রুতি দেন এবং ঘোষণা করেন যে দক্ষিণ কোরিয়া নিরাপত্তার জন্য আর শুধুমাত্র আমেরিকার ওপর নির্ভর করবে না, এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য চীনের ওপরও নির্ভরশীল হবে না—যা নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা অবশ্য নিন্দা জানিয়েছিলেন।
সাথে ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে দক্ষিণ কোরিয়ার নেতারা বড় বিনিয়োগের ঘোষণা দেন। কোরিয়ান এয়ার বোয়িং থেকে ১০৩টি নতুন জেট কেনার অঙ্গীকার করে, যা দেশটির এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় অর্ডার। লি জে মিয়ং ফিলাডেলফিয়াতেও থেমে আমেরিকার জরাজীর্ণ জাহাজ নির্মাণ শিল্পের পুনরুজ্জীবনে দক্ষিণ কোরিয়ার সমর্থন তুলে ধরেন। এই প্রচেষ্টার নাম দেওয়া হয়েছে 'এমএএসজিএ: মেইক আমেরিকান শিপবিল্ডিং গ্রেট এগেইন'!
লি জে মিয়ং ওয়াশিংটন থেকে খালি হাতে ফেরেননি। আপাতত, ডোনাল্ড ট্রাম্প দক্ষিণ কোরিয়া থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের আলোচনা থেকে সরে এসেছেন। লি ট্রাম্পকে উত্তর কোরিয়ার স্বৈরশাসক কিম জং উনের সঙ্গে পুনরায় আলোচনার জন্য সহায়তা চেয়েছেন। এমনকি ভবিষ্যতে উত্তর কোরিয়ার একটি ট্রাম্প টাওয়ারে গল্ফ খেলার বিষয়ও তিনি আলোচনায় তুলেছেন।
গুরুত্বপূর্ণভাবে, দক্ষিণ কোরিয়া পারমাণবিক জ্বালানি সমৃদ্ধকরণ ও পুনঃপ্রক্রিয়াকরণের অনুমতি পেতে আলোচনা শুরু করতে সফল হয়েছে। দেশটির কর্মকর্তারা বলছেন, এই সক্ষমতা তাদের বেসামরিক পারমাণবিক শিল্পকে শক্তিশালী করতে অপরিহার্য। তবে সমালোচকরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, এই ক্ষমতা অর্জন করলে দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য নিজস্ব পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করা সহজ হয়ে যেতে পারে। উল্লেখ্য, পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার নিয়ে উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে দক্ষিণ কোরিয়াকে এই সক্ষমতা অর্জনে বাধা দিয়েছে।
তবে, এই সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের বাইরেও বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে। যদিও দক্ষিণ কোরিয়া আমেরিকার সাথে একটি চুক্তি সম্পন্ন করেছে যেখানে তাদের শুল্ক হার ১৫শতাংশ (জাপানের সমান) নির্ধারণ করা হবে, তবে এই চুক্তির বিশদ বিবরণ এখনও চূড়ান্ত হয়নি। লি জে মিয়ং ওয়াশিংটন ছাড়ার মাত্র কয়েক দিন পরেই, আমেরিকা দক্ষিণ কোরিয়ার চিপ নির্মাতাদের চীনে কার্যক্রমের ওপর নতুন বিধিনিষেধ ঘোষণা করে।
আমেরিকার দিকে ঝুঁকে পড়লেও, লি জে মিয়ং তবুও দুই পরাশক্তির (আমেরিকা ও চীন) মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার আশা করছেন। হোয়াইট হাউসে থাকাকালীন তিনি গোপনে বেইজিংয়ে বিশেষ দূত পাঠান। সেই দূত শি জিনপিংকে অক্টোবরের শেষের দিকে দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিতব্য এশীয় নেতাদের একটি শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। লি জে মিয়ংয়ের বাস্তববাদী পররাষ্ট্রনীতির আসল পরীক্ষা এখনও বাকি।