‘আমার মা ছিলেন আমার জীবনের আশ্রয় ও ঝড়’: নতুন স্মৃতিকথা নিয়ে অরুন্ধতী রায়

নয়াদিল্লির এক ঘরোয়া আয়োজনে সম্প্রতি বুকারজয়ী ভারতীয় লেখক ও সমাজকর্মী অরুন্ধতী রায় বলছিলেন তার মায়ের কথা। হঠাৎই কেউ তাকে জিজ্ঞেস করে ওঠে, মায়ের কাছ থেকে পাওয়া সবচেয়ে বড় উত্তরাধিকার কী। রায় হাসতে হাসতে উত্তর দিয়েছিলেন, 'একটি প্রতিবাদী মধ্যমা আঙুল'!
তীক্ষ্ণ, অপ্রথাগত আর খানিকটা রসিকতাপূর্ণ এই মন্তব্যই যেন তার নতুন স্মৃতিকথা 'মাদার মেরি কামস টু মি'-র সেরা ভূমিকা। এই বই মূলত তার মা মেরি রয়ের জীবনকাহিনি।
মেরি রয় ছিলেন এক অসাধারণ, অস্থিরচিত্ত নারী; একাধারে নারীবাদী আইকন, শিক্ষাবিদ, লড়াকু, খামখেয়ালি, কখনো কঠিন, আবার অনেকের কাছে প্রেরণার উৎস। নিজের মেয়ে অরুন্ধতীর লেখায় তিনি ছিলেন 'আমার আশ্রয় এবং আমার ঝড়'।
উপন্যাসিক হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার আগে অরুন্ধতী রায় ছিলেন একেবারেই ভিন্ন পথে—স্থপতি, অভিনেত্রী, চিত্রনাট্যকার, এমনকি প্রোডাকশন ডিজাইনারও।
১৯৯৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস 'দ্য গড অব স্মল থিংস'। শৈশব থেকে অনুপ্রাণিত পারিবারিক এই গল্প তাকে এনে দেয় বুকার পুরস্কার। সাহিত্য সমালোচক জন আপডাইক বইটিকে তুলনা করেছিলেন 'টাইগার উডসের মতো দুর্দান্ত অভিষেক' হিসেবে। মাত্র ৩৬ বছর বয়সেই উপন্যাসটি তাকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। এরপর থেকে বইটি বিক্রি হয়েছে ৬০ লাখেরও বেশি কপি, যা তাঁকে শুধু পরিচিতিই নয়, আর্থিকভাবেও সমৃদ্ধ করেছে। রায়ের নিজের কথায়, এই পুরস্কার তাকে এনে দিয়েছিল 'নিজের শর্তে বাঁচা এবং লেখার স্বাধীনতা'।
কিন্তু অরুন্ধতীর পথ কখনোই সহজ ছিল না। দীর্ঘ বিশ বছর প্রবন্ধ লেখার মধ্য দিয়ে জনমতে বিভেদ সৃষ্টি এবং একইসঙ্গে শ্রদ্ধা ও নিন্দা কুড়িয়েছেন অরুন্ধতী রায়। এই সময়ের মধ্যে তার দ্বিতীয় উপন্যাসটিও প্রকাশিত হয়েছে। এবার তিনি ফিরেছেন তার প্রথম স্মৃতিকথা নিয়ে।

তবে এটি কোনো স্মৃতিমেদুর স্তুতি নয়। বরং মা-মেয়ের টানাপোড়েনের বাস্তব বিবরণ, যাকে অরুন্ধতী বলেছেন—'দুটি পারমাণবিক শক্তির মধ্যে শ্রদ্ধাপূর্ণ সম্পর্ক।' এই স্মৃতিকথার মূল সুর হলো টানাপোড়েন: সংঘাত-অস্থিরতা, আঘাত, কখনো নির্মম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত জীবনমুখী।
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে অরুন্ধতী রায় জানান, মায়ের সঙ্গে থাকাটা ছিল টিকে থাকার মতোই এক সংগ্রাম। শৈশবের স্মৃতি টেনে তিনি বললেন, 'আমার এক অংশ আঘাত সহ্য করছিল, আরেক অংশ সবকিছু টুকে নিচ্ছিল।'
মায়ের চরিত্র নিয়েও খোলাখুলি বলেন রায়। 'তিনি কখনোই কোনো সুসংবদ্ধ, পরিপাটি চরিত্র ছিলেন না। তাকে সাজানো গল্পে ফেলা সম্ভব নয়। আমি তাকে লিখেছি যেমন তিনি ছিলেন—অগোছালো, অমীমাংসিত।'
মেরি রয়ের জীবনও ছিল একইসঙ্গে ব্যতিক্রমী ও সংগ্রামমুখর। কেবল একটি শিক্ষা ডিগ্রি নিয়েই তিনি বেছে নিয়েছিলেন বিবাহবিচ্ছেদ। ১৯৬৭ সালে কেরালার কোট্টায়ামের একটি পুরোনো রোটারি ক্লাব ভবনে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি স্কুল। পরবর্তী সময়ে খ্রিষ্টান নারীদের উত্তরাধিকার সুরক্ষিত করতে সুপ্রিম কোর্টে জিতেছিলেন যুগান্তকারী এক মামলা।
তিনি গুরুতর হাঁপানি রোগীও ছিলেন, সবসময় তার পেছনে একজন 'ভীতু অনুচর থাকত, যে তার হাঁপানির ইনহেলার বহন করত, যেন এটি এক ধরনের মুকুট বা রাজদণ্ড।' ২০২২ সালে, ৮৮ বছর বয়সে মেরি রয় মারা যান, নিজের প্রতিষ্ঠিত সেই স্কুল থেকে অবসর নেওয়ার এক দশক পর।
বইয়ের শুরুতে অরুন্ধতী রায় লিখেছেন, 'একজন মেয়ে হিসেবে তার মায়ের মৃত্যুতে আমি যতটা না শোকাহত, তারচেয়ে বেশি শোক আমার একজন লেখক হিসেবে, যে কিনা তার সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়বস্তুটি হারিয়েছে।'
কেরালার নদী-বেষ্টিত আর্দ্র গ্রাম আইমেনেমেই শৈশব কেটেছে অরুন্ধতী রায়ের। এই গ্রামই পরে হয়ে ওঠে 'দ্য গড অব স্মল থিংস' উপন্যাসের প্রেক্ষাপট। ১৮ বছর বয়সে তিনি বাড়ি ছেড়ে দিল্লির স্কুল অব আর্কিটেকচারে ভর্তি হন—কোচি (তৎকালীন কোচিন) থেকে তিন দিনের ট্রেনযাত্রা শেষে পৌঁছান সেখানে। এরপর বহু বছর মায়ের সঙ্গে আর দেখা হয়নি, কথাও হয়নি।
সেই দূরত্বের কথা বলতে গিয়ে রায় বলেন, 'তিনি কখনো জিজ্ঞেস করেননি কেন আমি চলে গেলাম… এর প্রয়োজনও ছিল না। আমরা দুজনেই জানতাম। আমরা একটা মিথ্যায় স্থির হয়েছিলাম। একটা ভালো মিথ্যা। আমি এটা তৈরি করেছিলাম যে তিনি আমাকে এতটাই ভালোবাসতেন যে আমাকে যেতে দিয়েছিলেন!'
শৈশবের স্মৃতি হিসেবে অরুন্ধতী দেখেছেন, তার মা মেরি রায়ের ক্রোধ প্রায়ই ভাইয়ের ওপর পড়ত। একবার স্কুলে অরুন্ধতী ভালো ফল করলেও, কেবল 'গড়পড়তা' হওয়ার অপরাধে মেরি রয় তার ছেলেকে এত মারধোর করেছিলেন যে একটি কাঠের রুলার ভেঙে যায়।
দরজার ফাঁক দিয়ে এই দৃশ্য দেখেই অরুন্ধতী শিখেছিলেন: 'যেকোনো ব্যক্তিগত অর্জনই একরকম অশুভ ইঙ্গিত নিয়ে আসে। যখন আমাকে প্রশংসা করা হয় বা হাততালি দেওয়া হয়, তখন আমি সব সময় অনুভব করি যে অন্য কোনো ব্যক্তি অন্য ঘরে মার খাচ্ছে।'
তবে 'মাদার মেরি কামস টু মি' শুধু একটি অস্থির পারিবারিক কাহিনি নয়। এটি খামখেয়ালি চরিত্র, চটুল কৌতুক এবং ছোট শহর ও বড় শহরের জীবনের নানা বিচিত্র ঘটনায় ভরা।
রায়ের ভাষায়, 'এটি আমার মায়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নিয়ে… কীভাবে তিনি আমাকে এমন একজন লেখক করে তুলেছিলেন যা আমি আজ…এবং পরে এর জন্য ক্ষোভও পুষে রেখেছিলেন।'