ঢাকায় অরুন্ধতীর যেভাবে আসা…

১৯৯৯ সন ফেইডার নামে এক প্রকাশক আমার সঙ্গে যোগাযোগ করল, তারা একটা নতুন বই বের করতে চায়। বইয়ের পরিকল্পনা হলো এ রকম: ১০ জন কিউরেটর, তারা প্রত্যেকে একজন করে আলোকচিত্রী বাছাই করবে, সঙ্গে প্রতি কিউরেটর আলোকচিত্রীদের নিয়ে একটা করে লেখাও বাছাই করবে, যে লেখাটি লেখা হয়েছে ১৯৯৫ সালের পরে। এবং ওই লেখাটি তাদের মতে এমন হতে হবে, যে লেখাটি একজন নতুন আলোকচিত্রী ও তার সংস্কৃতিক পরিবেশ সবচেয়ে ভালোভাবে ধারণ করতে পেরেছে।
যে ১০টি কাজ এই বইয়ে ব্যবহৃত হবে, তার অনেকগুলো দিক ছিল। আর যে ১০টি লেখা থাকবে, তারও অনেকগুলো ক্ষেত্র ছিল: যেমন সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণ, রাজনীতি, উপন্যাস, সমালোচনা, সাংবাদিকতা-এ রকম সবকিছুই তার মধ্যে আসতে পারত।
আমার বন্ধু সঞ্জীব শেঠ, একজন প্রকাশক। অরুন্ধতী রায়ের 'গড অব স্মল থিংস' উপন্যাসের প্রথম ভারতীয় প্রকাশক ছিলেন। ১৯৯৭ সালে বইটি তার প্রকাশনা থেকে ভারতে প্রকাশিত হয়। এটা ভারতীয় প্রকাশনা সংস্থাটির জন্য বিরাট একটি প্রকাশনা বলতে হবে। তারপর অনেক আন্তর্জাতিক প্রকাশনী থেকেই অরুন্ধতীর বইটি বেরিয়েছে। অরুন্ধতীর 'গড অব স্মল থিংস'-এর সাবলীল ছন্দময় লেখা, তার তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ, তার সঙ্গে তার অসাধারণ এক ক্ষমতা হলো লেখার মাধ্যমে ছবিকে ফুটিয়ে তোলা, দৃশ্যমান করা- এগুলোর কারণে অরুন্ধতীকে ওই বইয়ের জন্য বাছাই করাটা খুব একটা কঠিন ব্যাপার ছিল না, এটা স্বাভাবিকভাবেই হয়েছিল।
২০১৭ সালে আমি নিউইয়র্কে গিয়েছি, আমার তখনকার নতুন বই 'মাই জার্নি অ্যাজ এ উইটনেস' রিজোলি বুক স্টোর থেকে প্রকাশিত হবে। কাকতালীয়ভাবে তার আগের রাতে অরুন্ধতীও ওখানে, তার বই 'দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস'-এর প্রকাশনার জন্য এসেছে।
স্বাভাবিকভাবেই আমি ওখানে গেলাম। রেহনুমার জন্য একটা বই সই করালাম। তারপর আমার বন্ধুর সঙ্গে ওখানকার কাছের এক রেস্টুরেন্টে গেছি খেতে, কিছুক্ষণ পর দেখি অরুদ্ধতীও তার বন্ধুবান্ধব নিয়ে ওখানে হাজির। সেই সুবাদে আমাদের কথা বলার সুযোগ হলো আবার, আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম ঢাকায় ছবি মেলায় আসবে কি না, ও আগ্রহ দেখাল। ঠিক করলাম যে আমরা পরে আলাপ করে মোটামুটি কখন কী হতে পারে, সেসব ঠিক করে নেব।
দেশে ফিরে এসেছি, ওই বছরই ২০১৭ সালে রোহিঙ্গারা বিশালাকারে আসা শুরু করল। আমি চলে গেলাম ছবি তুলতে। তখন চিন্তা রোহিঙ্গাদের জন্য কী হতে পারে, কী করা যেতে পারে, কী কী ভূমিকা রাখা যেতে পারে, কীভাবে, কোনোভাবে ওদের সাহায্য করতে পারি কি না।
পরের বছর জুলাই ২০১৮-তে আমি দিল্লি গেলাম। এএফপির সঙ্গে আলোচনা, ঠিক হলো দৃক এবং এএফপি মিলে একটা বড় প্রদর্শনী করব; কারণ, ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গাদের আসার এক বছর পূর্ণ হবে। আর দিল্লিতে যখন গিয়েছি, ওই সুযোগে অরুন্ধতীর সঙ্গেও দেখা করতে ওর দিল্লির ফ্ল্যাটে গেলাম। দেখা হলো, মজার একটা বিকেল কাটল। অনেক বিষয় নিয়ে গল্প করলাম আমরা। কাশ্মীর, আলোকচিত্র, ভূ-উপনিবেশিকতা, রাজনীতি, ফিলিস্তিনসহ বহু বিষয় নিয়ে আলাপ হলো। ওর কুকুরগুলোর সঙ্গেও কিছুক্ষণ খেলাধুলা হলো। অরুন্ধতী রাজি হলো ছবি মেলায় আসতে, তখন ফেব্রুয়ারিতে ছবি মেলা হবে আমরা ভেবেছিলাম।
আমি ঢাকায় ফেরত আসলাম, আর তখনই জুলাই মাসের শেষেই নিরাপদ সড়ক আন্দোলন শুরু হয়ে গেল। সরকার তার ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দিয়েছে ছাত্রছাত্রীদের ওপর। আমি নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের ছবি তুলছি, আন্দোলন কাভার করছি, রিপোর্ট করছি, লাইভ করছি- ৪ জুলাই আমি ওদের আক্রমণের শিকার হলাম, আমার যন্ত্রপাতি ভেঙে ফেলল। পরদিন আল-জাজিরায় একটা সাক্ষাৎকার ব্রডকাস্ট হলো। তারপর ওই দিন রাতেই নিরাপত্তা বাহিনী আমাদের ফ্ল্যাটে এসে আমাকে জোরপূর্বক নিয়ে তুলে নিয়ে গেল। জেলে পোরা হলো আমাকে।
আমার মুক্তির জন্য আন্দোলন শুরু হলে, তাতে অরুন্ধতী রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে, সক্রিয় ভূমিকা রাখে। ওর সঙ্গে এ সময় যোগ দেয় নোয়াম চমস্কি, বিজয় প্রসাদ, নাওমি ক্লাইনরা- সবাই মিলে একটা লিখিত স্টেটমেন্ট দিল। এর বাইরে আরও অনেকে তখন বিবৃতি দিয়েছিল, প্রফেসর ইউনূস দিয়েছিলেন, অনেক নোবেল লরিয়েটও দিয়েছিলেন।
তবে অরুন্ধতী রায়, নোয়াম চমস্কিরাই সবচেয়ে আগে স্টেটমেন্টটা দিয়েছিল। তারপর জেলে ১০০ দিন হয়ে গেল, এ সময় অরুন্ধতী একটা শক্তিশালী চিঠি লিখল আমার জন্য পেন ইন্টারন্যাশনালের হয়ে। রেহনুমারা এক অর্থে গোপনে, চোরাইভাবে চিঠিটা আমার কাছে পৌঁছে দিয়েছিল। আমার পড়া হয়েছিল, কিন্তু কিছু করার উপায় ছিল না তখন।
পরে আমি জেল থেকে বেরিয়ে ওই চিঠিটার উত্তর দিই। এ সময় জেল থেকে বের হওয়ার পর 'দ্য টাইড উইল টার্ন' নামে একটা বই লিখি, ওই বইয়ের একটা চ্যাপ্টার এই দুটো চিঠি নিয়ে। 'টাইড উইল টার্ন' বইয়ের এই নামকরণটা অরুন্ধতীর ওই চিঠি থেকেই নেওয়া। ও চিঠিতে লিখেছিল দ্য টাইড উইল টার্ন এবং আসলেই তো বদলে গেছে, সেই বদলের দিনে আমরা এসেছি।
সংকল্প তখন, জেল থেকে যেহেতু বের হয়েছি, জামিনে হোক বা যেভাবেই হোক, ছবি মেলা তো আমি করবই। কিন্তু সরকার আমাকে দুই চোখে দেখতে পারে না, এটা জানতাম; এবং আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা তো দূরের কথা, লোকজন কথা বলতেই ভয় পায়। তাই দেখা গেল অরুন্ধতী রায়কে নিয়ে আমরা একটা বিশেষ আয়োজন করব, কিন্তু এ ব্যাপারে কেউ আগ্রহী হচ্ছিল না। অরুন্ধতী যথাসময়ে চলে এল, আমি ও চলে আসার পরে অন্তত বুঝলাম- যা করতে চেয়েছি, তা হবে।
কিন্তু তখনও বুঝিনি নাটক যে মাত্র শুরু। আমাদের কথোপকথনের নাম ছিল 'আপ মোস্ট এভ্রিথিং'। ৫ মার্চ ২০১৯ বিকেল ৫টায় হবে এই অনুষ্ঠান, ভেন্যু ঠিক হয়েছিল কৃষিবিদ ভবনের অডিটরিয়াম। আমাদের জন্য ওখানে আয়োজন একটু ব্যয়বহুল ছিল; কিন্তু অরুন্ধতী এসেছে...এ রকম একজন মানুষকে আবার কবে পাব?
কাজেই আমরা একটু আমাদের সামর্থ্যের বাইরে গিয়েই কৃষিবিদ ভবনের অডিটরিয়াম বুক করেছিলাম। অনুষ্ঠানের আগে অরুন্ধতীর সঙ্গে কথা বলবেন মাহফুজ আনাম, আনু মুহাম্মদ আরও অনেকেই, ঠিক হলো। ছবির তোলার জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট করল নাসির আলী মামুন। অরুন্ধতীকে ঘিরে এ রকম নানা পরিকল্পনা- সবই ঠিকঠাকভাবে এগোচ্ছিল, কোনো সমস্যা নেই। ৪ মার্চ রাতে, অনুষ্ঠানের ঠিক আগের দিন, বেশ রাতে প্রায় মাঝরাত হবে, হঠাৎ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে আমাদের জানাল, ১৬ ডিসেম্বরে আমরা যে আবেদনটা করেছিলাম অনুষ্ঠান করার জন্য, সেটা করা যাবে না। এটাকে বাতিল করা হয়েছে। বলা হলো, অনিবার্য কারণবশত একে বাতিল করা হলো।
৫টার সময় অনুষ্ঠান, রাতে এই বাতিলের খবর। তখন লোকজনকে এটা জানাব কীভাবে?
তখন কী করব, ঠিক করা শুরু করলাম। লেখালেখি শুরু করলাম। রাত সোয়া দুইটায় আমরা অনুষ্ঠানের জন্য যারা নাম রেজিস্ট্রি করেছিল, তাদের সবাইকে চিঠি পাঠালাম- অনুষ্ঠানটা হচ্ছে না। অথচ ২৫ ফেব্রুয়ারিতে আমাদের অুনষ্ঠানের অনুমতি দিয়ে চিঠি ইস্যু করা হয়েছিল। অনুমতির চিঠিটায় তেজগাঁও থানার ওসিকে সিসিতে রেখে ১২টা শর্ত দেওয়া হয়েছিল। আমরা সব শর্ত মেনে নিয়েছিলাম। হঠাৎ করে ভেন্যু বাতিল করে দেওয়ায় এ ধাক্কা সামাল দেওয়ার জায়গায় আমরা ছিলাম না, হাজারখানেক মানুষের বসার মতো একটা নতুন জায়গা তখন হুট করে আমরা কোথায় পাব?
আর আমরা তখন নমঃশূদ্র, আমাদের ধারেকাছে কেউ আসবে না। সরকার কী করবে, সেটা নিয়েও দুশ্চিন্তা। এরকম একটা অবস্থায় অনুষ্ঠানটি আমরা দৃকে করব ভাবলাম, কিন্তু ওখানেও সরকার বাধা দিতে পারে ভেবে ঠিক হলো যদি বাধা দেয় তাহলে রাস্তায় করব, সেভাবেই ঠিক করা হলো। অরুন্ধতীর তাতে কোনো সমস্যা নেই; বলল, হ্যাঁ, অবশ্যই করব। আমি এদিক-ওদিক ফোন করা শুরু করলাম, কীভাবে কী করব?
ওই সময়ে আমার ওই কেরানীগঞ্জের জেলের পুরোনো যোগাযোগগুলো অনেক কাজে দিল। যাহোক, ওটার মধ্যে বিশদ আর গেলাম না এখন।
শেষে একটা জায়গা পাওয়া গেল। একটু দেরি করেই অনুষ্ঠান হলো, কিন্তু হাজারখানেক মানুষ মাটিতে বসে, কেউ তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না, চাদর বিছিয়ে, মাটিতে বসে সবাই শুনছে। এক ঘণ্টার অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল। আড়াই ঘণ্টা হয়ে গেল। কেউ যায় না। সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছে।
অনুষ্ঠানটা ভালোভাবেই শেষ হলো। শেষে আমরা যখন দাঁড়িয়ে কথা বলছি, তখন দেখি শেখ হাসিনা একজনকে পাঠিয়েছেন। আমাকে জিজ্ঞেস করতে যে অরুন্ধতীর সঙ্গে তিনি একটু দেখা করতে পারেন কি না?
না বলি আর... ওটা অন্য গল্প।
অরুন্ধতীকে এখন আবার আমরা বাংলাদেশে আনার কথা ভাবছি। আমাদের যে রাজনীতি, আমরা যে আন্দোলনগুলো করি, তাতে আমাদের মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে। অরুন্ধতী ফিলিস্তিনি আন্দোলনেও জোরালো ভূমিকা রেখেছে। তার বাইরে অনেক কিছুতে আমরা যুক্ত। অনেক ধরনের লড়াইয়ে আমরা আছি। এখন ওর সঙ্গে আমার শেষ যে স্মৃতিটা মনে পড়ছে, এখানকার এই ছবিটা: আমাদের ধানমন্ডির ফ্ল্যাটে অরুন্ধতী যখন এল এবং সেদিন আমরা দুজন মিলে একটা বাচ্চা পেঁচাকে কাকের আক্রমণ থেকে বাঁচিয়েছিলাম, এই ছবিটা সেই স্মৃতির স্বাক্ষর।
(লেখাটি সৈয়দ মূসা রেজাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে রচিত)