ইসরায়েলের যুদ্ধে যুক্তরাজ্যের ভূমিকা তদন্তে ‘গাজা ট্রাইব্যুনাল’: নেতৃত্বে জেরেমি করবিন

ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করতে দুই দিনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির সাবেক নেতা জেরেমি করবিন। তিনি এই অনুষ্ঠানকে একটি 'ট্রাইব্যুনাল' হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, এর লক্ষ্য হলো ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।
এতে অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে জাতিসংঘের অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড বিষয়ক বিশেষ প্রতিবেদক ফ্রান্সেস্কা আলবানিজের। তার পাশাপাশি গাজায় স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করা চিকিৎসক, ত্রাণকর্মী, বিশেষজ্ঞ এবং যুদ্ধের বেঁচে যাওয়া মানুষরাও থাকবেন।
আয়োজকরা জানান, লেবার পার্টির এমপি রিচার্ড বারগন এবং বেশ কয়েকজন সাংবাদিকও এ অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন। এর মধ্যে রয়েছেন অনুসন্ধানী সাংবাদিক ম্যাট কেনার্ড, যিনি গাজার আকাশে যুক্তরাজ্যের নজরদারি ফ্লাইটগুলো পর্যবেক্ষণ করে আসছেন।
বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টারের চার্চ হাউসে এই অনুষ্ঠান হবে। অংশগ্রহণকারীরা বিভিন্ন প্যানেল আলোচনায় যোগ দেবেন, যেখানে আলোচ্য বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাজ্যের আইনি দায়িত্ব।
উদ্যোগটির ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, 'সরকার যে গণহত্যায় কতটা জড়িত, জনগণের জানার অধিকার রয়েছে। সেই কারণেই আমরা গাজা ট্রাইব্যুনালের আয়োজন করছি। আমরা সত্যকে উন্মোচন করব।'
এই উদ্যোগটি আসে করবিনের আগের ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর। তিনি ইরাক যুদ্ধ নিয়ে যুক্তরাজ্যের ভূমিকা খতিয়ে দেখতে জন চিলকটের নেতৃত্বে হওয়া ইরাক ইনকোয়ারির মতো একটি সরকারি তদন্ত চালুর চেষ্টা করেছিলেন।
চলতি বছরের ৪ জুন করবিন—যিনি যুক্তরাজ্যে অন্যতম সুপরিচিত ফিলিস্তিনপন্থী কণ্ঠস্বর এবং একটি নতুন বামপন্থী রাজনৈতিক দল চালু করছেন—হাউস অব কমন্সে একটি বিল উত্থাপন করেন। এতে তিনি ইসরায়েলের গাজায় সামরিক অভিযানে যুক্তরাজ্যের সম্পৃক্ততা নিয়ে স্বাধীন তদন্তের দাবি জানান। এই তদন্তে অস্ত্র সরবরাহ, নজরদারি বিমান ব্যবহার এবং রয়্যাল এয়ার ফোর্স ঘাঁটি ব্যবহারের মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকার কথা বলা হয়।
করবিনের প্রস্তাবিত বিলটি ডজনখানেক সংসদ সদস্য এবং ২০টির বেশি ত্রাণ সংস্থার সমর্থন পেলেও শেষ পর্যন্ত তা শাসক লেবার পার্টি আটকে দেয়।
করবিন বলেন, 'ইরাকের মতোই সরকার নিজেদের জবাবদিহি থেকে রক্ষা করতে সবকিছু করছে। ইরাকের মতোই, সত্যকে দমিয়ে রাখার এই প্রচেষ্টা সফল হবে না। আমরা গণহত্যায় ব্রিটেনের সম্পৃক্ততার পূর্ণ চিত্র উন্মোচন করব।'
'সংসদে মতামত সামান্য কিন্তু ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসছে'
শীর্ষ সম্মেলনটি এমন সময় হচ্ছে যখন অনেক ব্রিটিশ নাগরিক মনে করছেন, তাদের সরকার জনগণের মতামতের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। প্রায় দুই বছর ধরে কয়েক লাখ মানুষ প্রতিবাদে অংশ নিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারকে আহ্বান জানিয়েছেন ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক কমাতে এবং ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে, যাতে তারা গাজায় যে হামলা চালাচ্ছে তা বন্ধ করে—যা শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা ও গবেষকরা ফিলিস্তিনীদের বিরুদ্ধে গণহত্যা হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
সাম্প্রতিক ইউগভ জরিপ অনুযায়ী, বেশিরভাগ ব্রিটিশ নাগরিক ফিলিস্তিনীদের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ গাজার পরিস্থিতিকে গণহত্যা হিসেবে মনে করেন।
গত সপ্তাহে করবিন আল জাজিরাকে বলেন, 'সংসদে মতামত অত্যন্ত সামান্য কিন্তু ধীরে ধীরে পরিবর্তন ঘটছে, কারণ যুক্তরাজ্যের অনেক মানুষ ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন দেখিয়েছেন।'
যুক্তরাজ্য সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে: চরমপন্থী কিছু ইসরায়েলি মন্ত্রীকে নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়েছে এবং কিছু অস্ত্র রপ্তানি লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। এই পদক্ষেপগুলো একটি পর্যালোচনার পরে নেওয়া হয়েছে, যেখানে দেখা গেছে যে কিছু সামরিক রপ্তানি আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘনে ব্যবহার হতে পারে। তবে যুক্তরাজ্যে তৈরি এফ-৩৫ বিমান এখনও বৈশ্বিক স্পেয়ার্স পুলের মাধ্যমে ইসরায়েলে পৌঁছতে পারে।
গাজার ওপর যুক্তরাজ্যের নজরদারির জন্য পাঠানো বিমানগুলোর বিষয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, তার মধ্যে কয়েকশো বিমান সাইপ্রাস থেকে উড়ে গেছে।
যুক্তরাজ্য সরকারের দাবি, এই বিমানগুলো হামাসের তত্ত্বাবধানে থাকা বন্দিদের অবস্থান শনাক্ত করার জন্য চালানো হয়।
তবে মার্চে 'অ্যাকশন অন আর্মড ভায়োলেন্স' নামের একটি গবেষক সংস্থা জানিয়েছে, সংসদীয় পর্যবেক্ষণ বা জনসাধারণের নজরদারির অভাব এখনও স্পষ্ট নয়। কারণ এই বিমান থেকে সংগৃহীত ব্রিটিশ গোয়েন্দা তথ্য কতটা ইসরায়েলের সঙ্গে শেয়ার করা হয়েছে তা অজানা। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, 'এই বিমানগুলো গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, নজরদারি ও খোঁজ-খবর ছাড়াও [অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে] লক্ষ্য নির্ধারণের কাজ করেছে কিনা তা অজানা।'
সংবাদ বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, 'ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন এবং যুক্তরাজ্যের ইসরায়েলের সঙ্গে চলমান সামরিক সহযোগিতার প্রেক্ষাপটে এই বিমানগুলোর প্রকৃতি নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অস্ত্র সরবরাহের কাজ অব্যাহত রয়েছে, যেমন এফ-৩৫ ইসরায়েলের বেসামরিক অঞ্চলে ব্যাপক বোমাবর্ষণে ব্যবহৃত হয়েছে।'
২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় অন্তত ৬৩ হাজার ৭৪৬ জন নিহত এবং এক লাখ ৬১ হাজার ২৪৫ জন আহত হয়েছে। আর এ সংখ্যায় শিশুদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
ইসরায়েলের সাম্প্রতিক এই যুদ্ধ গাজার উপত্যকায় শুরু হয়েছিল, যখন হামাস দক্ষিণ ইসরায়েলে একটি আক্রমণ চালায়। সেই সময় এক হাজার ১৩৯ জন নিহত হন এবং ২০০-এর বেশি মানুষকে বন্দি করা হয়।