গাজায় বিদেশি সাংবাদিকদের প্রবেশে ইসরায়েলের নিষেধাজ্ঞা কেন অযৌক্তিক

বিশ্বের সব যুদ্ধই সবসময় সংবাদ সংগ্রহের কাজটিকে বিপজ্জনক করে তোলে। তবে আধুনিক সংঘাতগুলোর মধ্যে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় সাংবাদিকদের জন্য যে মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, তা তুলনাহীন। এই ভূখণ্ডে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ২০০ জন সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী। আধুনিক ইতিহাসে গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য এটি এক নজিরবিহীন কালো অধ্যায়ই বলা যায়।
গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত আনুমানিক ৬৩ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। নির্বিচারে ধ্বংস হয়ে গেছে অসংখ্য পরিবার, নিশ্চিহ্ন হয়েছে পুরো জনপদ। এমন দুঃসহ পরিস্থিতিতেও যুদ্ধের নির্মম চিত্র বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে গিয়ে বহু সাহসী সাংবাদিক তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন।
নিহতদের সিংহভাগই ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা পর্যবেক্ষক সংস্থা 'কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস' (সিপিজে) জানায়, ১৯৯২ সালে সাংবাদিক মৃত্যুর রেকর্ড রাখা শুরু করার পর গত দুই বছরই ছিল সবচেয়ে প্রাণঘাতী সময়।
তবে, এই নিহত সাংবাদিকদের প্রায় সবাই ফিলিস্তিনি। এর মূল কারণ হলো, ইসরায়েল কোনো বিদেশি সাংবাদিককে গাজায় ঢুকতে দেয়নি।
গাজায় বিদেশি গণমাধ্যমকর্মীদের প্রবেশে ইসরায়েলের নিষেধাজ্ঞা কেবল নিন্দনীয়ই নয়, বরং তাদের জন্য একটি আত্মঘাতী পদক্ষেপও। আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করতে না দেওয়ার এই সিদ্ধান্ত ইসরায়েলি সরকারকে এমন একটি মানদণ্ড থেকে বিচ্যুত করেছে, যা অনেক সরকার, বিশেষ করে গণতান্ত্রিক দেশগুলো মেনে চলে। আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সাংবাদিকদের সংবাদ সংগ্রহের অনুমতি দিয়েছিল। একইভাবে, ইউক্রেনও রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে বিদেশি সাংবাদিকদের কভারেজের সুযোগ দিয়েছে।
বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তার সরকার হয়তো মনে করেন, বিদেশি সাংবাদিকদের গাজার বাইরে রেখে তাদের নিজস্ব বয়ান প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। ইসরায়েলের ভেতরে এই কৌশল কিছুটা কার্যকরও হতে পারে। এতে অনেক ইসরায়েলি গাজার ভয়াবহতার খবরকে সহজেই 'ফিলিস্তিনি অপপ্রচার' বলে উড়িয়ে দিতে পারছেন।
কিন্তু বিশ্বমঞ্চে এই নীতি শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর সাহসী ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের নিরলস প্রচেষ্টায় গাজার গণহত্যা, তীব্র ক্ষুধা আর ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের ছবি পৌঁছে গেছে বিশ্বজুড়ে। আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার না দেওয়ার এ সিদ্ধান্তটিই আসলে বুঝিয়ে দেয়, ইসরায়েলের নেতারা যুদ্ধের পূর্ণ ভয়াবহতা আড়াল করতে চান। এটি অনেকটা ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় আমেরিকান নেতাদের ব্যর্থ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা মনে করিয়ে দেয়।
গাজায় বিদেশি সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা সেখানকার যুদ্ধ পরিস্থিতি কভার করা সাংবাদিকদের প্রতি ইসরায়েল সরকারের উদাসীনতাকেই আরও স্পষ্ট করেছে। সাধারণত যুদ্ধরত দেশগুলো সংঘাত কভার করা সাংবাদিকদের ঝুঁকি কমাতে কিছু পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। সামরিক পরিকল্পনাকারীরাও অনেক সময় সাংবাদিকদের অবস্থান ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ইসরায়েল সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ।
অনেকে মনে করেন, নিহত সাংবাদিকদের মধ্যে যদি আমেরিকান বা অন্য দেশের নাগরিক বেশি থাকতেন, তাহলে হয়তো ইসরায়েল তাদের সুরক্ষায় আরও উদ্যোগ নিত।
গত সপ্তাহে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা গাজায় সাংবাদিক ও বেসামরিক মানুষের প্রতি এই উদাসীনতাকেই আরও স্পষ্ট করে তুলে ধরে। ইসরায়েল প্রায়ই তথাকথিত 'ডাবল-ট্যাপ' হামলা চালায়—যেখানে প্রথম আঘাতের পরপরই আরেকটি হামলা হয়, যেন শত্রুর সর্বোচ্চ ক্ষতি করা যায়। কিন্তু প্রথম হামলার পরপরই সাধারণত ঘটনাস্থলে পৌঁছে যান সাংবাদিক ও জরুরি চিকিৎসাকর্মীরা।
গত সোমবার দক্ষিণ গাজার নাসের হাসপাতালে এমনই এক হামলা হয়। ইসরায়েলি সেনারা প্রথমে সেখানে শেল নিক্ষেপ করে। পরে তারা দাবি করে, তারা হামাসের একটি নজরদারি ক্যামেরাকে লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছিল। কিন্তু কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ঘটে দ্বিতীয় হামলা। এই দুই হামলায় অন্তত ২০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন। তাদের মধ্যে ছিলেন অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস, রয়টার্স, আল জাজিরা ও মিডল ইস্ট আই-এর পাঁচজন সাংবাদিক। নিহতদের বেশির ভাগই দ্বিতীয় হামলায় প্রাণ হারান।
গাজায় সাংবাদিকদের প্রাণহানির ঘটনাকে নেতানিয়াহু 'দুঃখজনক দুর্ঘটনা' বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি দাবি করেন, ইসরায়েল সাংবাদিকদের মূল্য দেয় এবং এসব ঘটনার সামরিক তদন্তের প্রতিশ্রুতিও দেন। তবে সমালোচকদের মতে, নগর যুদ্ধে ইসরায়েলের 'ডাবল-ট্যাপ' কৌশল আসলে বেসামরিক জীবন ও যুদ্ধের সত্য প্রকাশ করতে চাওয়া সাংবাদিকদের প্রতি গভীর অবজ্ঞারই বহিঃপ্রকাশ।
গাজায় সাংবাদিকদের মৃত্যুর সমালোচনায় ইসরায়েল দাবি করছে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ হামাসের এজেন্ট। কিছু সংবাদমাধ্যমকর্মী হামাস বা ইসলামিক জিহাদের সঙ্গে যুক্ত বলেও তারা উল্লেখ করে। কিন্তু ইসরায়েলের এই অভিযোগ, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের সাহসী সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে, যারা প্রায় অসম্ভব পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন, তাদের হামাসের যোদ্ধা হিসেবে আখ্যায়িত করা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। ইসরায়েল তাদের এ দাবি প্রমাণেও ব্যর্থ।
দুই সপ্তাহ আগে, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি সহ ২৮টি দেশ ইসরায়েলের প্রতি গাজায় গণমাধ্যমের অবিলম্বে প্রবেশাধিকার দেওয়ার আহ্বান জানায়। তারা বলেছিল, সাংবাদিকরা 'যুদ্ধের ভয়াবহ বাস্তবতা তুলে ধরতে অপরিহার্য।'
স্বাধীন গণমাধ্যমের প্রবেশাধিকারের দাবি প্রত্যাখ্যান করতে গিয়ে ইসরায়েল তাদের নিরাপত্তার উদ্বেগকে সামনে এনেছে। কিন্তু এই যুক্তি মূলত একটি অজুহাত। বিশ্বের সাংবাদিকরা যুদ্ধ কভার করতে প্রস্তুত। দ্য টাইমসসহ ৭০টিরও বেশি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবং সুশীল সমাজের সংগঠন এক চিঠিতে জানিয়ে দিয়েছে, তারা 'যুদ্ধাঞ্চলে সংবাদ সংগ্রহের ঝুঁকি পুরোপুরি বোঝে।'
ইসরায়েলি সরকার প্রায়শই অভিযোগ করে, বিশ্ব গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও হামাস-নিয়ন্ত্রিত অন্যান্য সংস্থার উপর নির্ভর করছে। কিন্তু যখন তারা বাইরের পর্যবেক্ষকদের গাজার প্রবেশে বাধা দেয়, তখন নেতানিয়াহু ও তার কর্মকর্তারা আর কী আশা করেন? যদি তারা বিশ্বকে সত্য দেখা দিতেই চায়, তাহলে গণমাধ্যমকে প্রবেশাধিকার দেওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প তাদের কাছে নেই।