চীনে গ্যাস সরবরাহে ‘পাওয়ার অব সাইবেরিয়া-২’ পাইপলাইন প্রকল্পে রাশিয়া-চীনের সম্মতি

রাশিয়া ও চীন 'পাওয়ার অব সাইবেরিয়া ২' পাইপলাইনের অনুমোদন দিয়েছে। তবে গ্যাসের দামের ব্যাপারে এখনও কোনো সমঝোতায় পৌঁছায়নি বলে মঙ্গলবার জানিয়েছে রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত একটি বৃহৎ এনার্জি সংস্থা গাজপ্রম। এ অবস্থায় পশ্চিমা দেশের দাবিকে উপেক্ষা করে রাশিয়ার সঙ্গে গভীরতর অংশীদারিত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের অটল অবস্থান আরও স্পষ্ট হয়েছে।
এই পাইপলাইনটি চালু হলে একসময় ইয়ামালের আর্কটিক গ্যাসক্ষেত্র থেকে মঙ্গোলিয়ার মধ্য দিয়ে চীনে বছরে অতিরিক্ত ৫০ বিলিয়ন ঘনমিটার (বিসিএম) গ্যাস সরবরাহ করতে সক্ষম হবে। এর ফলে বিশ্বের সর্ববৃহৎ জ্বালানি ব্যবহারকারী দেশ চীন ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য আরও বিকল্প জোগান পাবে।
গাজপ্রমের প্রধান নির্বাহী আলেক্সেই মিলার জানিয়েছেন, 'পাওয়ার অব সাইবেরিয়া ২' পাইপলাইন নির্মাণে একটি আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই ঘোষণা আসে চীনে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একসঙ্গে হাত ধরে হাসিমুখে ছবি তোলার পর। এর আগে বেইজিংয়ে শি-পুতিন বৈঠক এবং মঙ্গোলিয়ার নেতার সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
মিলার আরও বলেন, বিদ্যমান 'পাওয়ার অব সাইবেরিয়া' পাইপলাইনের (যা পূর্ব সাইবেরিয়া থেকে চীনে গ্যাস সরবরাহ করে) সরবরাহের পরিমাণ বছরে ৩৮ বিলিয়ন ঘনমিটার (বিসিএম) থেকে বাড়িয়ে ৪৪ বিসিএম করার ব্যাপারে সমঝোতা হয়েছে।
তবে নতুন পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা গ্যাসের মূল্য এখনো নির্ধারিত হয়নি। মিলারের ভাষ্যমতে, এই মূল্য আলাদাভাবে নির্ধারণ করা হবে, কারণ এটি পাইপলাইন নির্মাণ ব্যয় এবং সেই ব্যয় সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে কীভাবে ভাগ হবে—তা বোঝার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
অক্সফোর্ড ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি স্টাডিজের চায়না এনার্জি রিসার্চ বিভাগের প্রধান মিখাল মেইদান বলেন, 'পাওয়ার অব সাইবেরিয়া ২' নিয়ে ঘোষণাগুলো বৈশ্বিক জ্বালানি ভূরাজনীতিতে একটি বড় মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া ঘটনা।
তিনি বলেন, 'বার্তাটা হলো—চীন আর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা মানার ভানও করছে না, কিংবা পশ্চিমা দেশগুলো কী ভাবছে তা নিয়েও মাথা ঘামাচ্ছে না। আর চীন একা নয়।'
সম্প্রতি চীন রাশিয়ার নিষিদ্ধ আর্কটিক এলএনজি ২ প্রকল্প থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) গ্রহণ করেছে, যা প্রমাণ করে যে পশ্চিমা চাপ উপেক্ষা করে মস্কোকে আলাদা করে রাখার প্রচেষ্টা প্রতিহত করতে সক্ষম বেইজিং। তবে গ্যাসের দাম নির্ধারণে অগ্রগতি না হওয়া ইঙ্গিত দিচ্ছে যে চীন রাশিয়ার কাছ থেকে খুব বেশি ছাড় আদায়ের চেষ্টা করছে।
'কোনো সীমাবদ্ধতা নেই'
পুতিন ও শি — যারা দুজনেই ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে রাশিয়ার জন্য এক ধরনের অপমান এবং ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক আধিপত্যের শতাব্দীগুলোকে চীনের জন্য অপমানজনক ইতিহাস হিসেবে দেখেন — তারা বলেন, বিশ্ব এখন এক নতুন যুগে প্রবেশ করছে, যেখানে পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাব ধীরে ধীরে কমছে।
যুক্তরাষ্ট্র চীনকে তার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী এবং রাশিয়াকে সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রভিত্তিক হুমকি হিসেবে দেখে। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সমালোচনা করে বলেছেন, পশ্চিমা বিশ্বের এমন কিছু পদক্ষেপের কারণে তার মতে উল্টো মস্কো ও বেইজিংকে আরও কাছাকাছি নিয়ে এসেছে।
রাশিয়া ও চীনের মধ্যে ঘোষিত 'সীমাহীন অংশীদারিত্ব' আরও দৃঢ় হয়েছে, বিশেষত ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর থেকে।
লাভজনক ইউরোপীয় গ্যাসবাজারের বড় অংশ হারানোর পর রাশিয়া এখন চীনের দিকে ঝুঁকছে। আর গাজপ্রম বহু বছর ধরে 'পাওয়ার অব সাইবেরিয়া ২' পাইপলাইন নিয়ে চুক্তি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
মস্কোভিত্তিক 'চায়না অ্যান্ড কনটেম্পোরারি এশিয়া ইনস্টিটিউট'-এর প্রধান এবং রুশ সরকারের চীনবিষয়ক উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক কিরিল বাবায়েভ বলেন, 'বড় চুক্তিটি অবশেষে বাস্তবায়নের পথে।'
তিনি বলেন, 'যদিও আমরা এখনো দাম, সরবরাহের পরিমাণ কিংবা পাইপলাইনের সাবকন্ট্রাক্টরদের বিষয়ে কিছু জানি না, তবে রাজনৈতিক আলোচনা শেষ হয়েছে এবং এখন বাণিজ্যিক কাজের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। রাশিয়া, মঙ্গোলিয়া ও চীনের তিন নেতার আশীর্বাদ থাকায় এ কাজ অবশ্যই সফল হবে।'
অনেক বিষয়ই এখনো অস্পষ্ট রয়ে গেছে: গ্যাসের দাম, পাইপলাইন নির্মাণ এবং সময়সীমা সম্পর্কে কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি। এদিকে অন্তত একজন শীর্ষ রুশ জ্বালানি নির্বাহী মনে করেন, চীন তার বিশাল নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও পারমাণবিক প্রকল্পের মাধ্যমে ধীরে ধীরে জ্বালানি স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে এগোচ্ছে।
গাজপ্রম প্রধান আলেক্সেই মিলার বলেছেন, চীনে সরবরাহ করা গ্যাসের দাম ইউরোপীয় ক্রেতাদের তুলনায় কম হবে। কারণ পাইপলাইন নির্মাণে বিশাল দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে এবং কঠিন ভূপ্রকৃতির মধ্য দিয়ে তা করতে হবে।
ক্রেমলিন জানিয়েছে, চীন সফরে মোট ২২টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, যার মধ্যে গাজপ্রম ও চায়না ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (সিএনপিসি) মধ্যে কৌশলগত সহযোগিতার একটি চুক্তিও রয়েছে। তবে এ বিষয়ে কোনো বিস্তারিত তথ্য দেয়নি ক্রেমলিন, দেয়নি চীনও।
বৃহৎ পাইপলাইন
রাশিয়ার উত্তরাঞ্চলের বোভানেনকোভো ও খারাসাভে গ্যাসক্ষেত্র থেকে সাইবেরিয়ার দুর্গম বনভূমি পেরিয়ে মঙ্গোলিয়া হয়ে চীনে গ্যাস সরবরাহের পাইপলাইন নির্মাণ হবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং সর্বাধিক মূলধননির্ভর গ্যাস প্রকল্প—এমনটাই জানিয়েছেন গাজপ্রম প্রধান আলেক্সেই মিলার।
ক্রেমলিনের তথ্যমতে, চীন বর্তমানে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। দেশটি রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের সবচেয়ে বড় ক্রেতা, রাশিয়ার কয়লার দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্রেতা এবং তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) তৃতীয় বৃহত্তম ক্রেতা।
গাজপ্রম বর্তমানে প্রায় ৩ হাজার কিলোমিটার (১,৮৬৫ মাইল) দীর্ঘ 'পাওয়ার অব সাইবেরিয়া' পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করছে। ৩০ বছরের জন্য ৪০০ বিলিয়ন ডলারের এই চুক্তি ২০১৯ সালের শেষের দিকে কার্যকর হয়। চলতি বছর এর সরবরাহ বার্ষিক ৩৮ বিলিয়ন ঘনমিটার (বিসিএম) নির্ধারিত ক্ষমতায় পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মিলার আরও জানান, রাশিয়ার দূরপ্রাচ্যের সাখালিন দ্বীপ থেকে চীনে গ্যাস সরবরাহের চুক্তিও সংশোধন করা হয়েছে। নতুন চুক্তি অনুযায়ী, এর সরবরাহ বাষির্ক ১০ বিসিএম থেকে বাড়িয়ে ১২ বিসিএম করা হবে।