হার্ট অ্যাটাক চিকিৎসার সাধারণ ওষুধ কিছু নারীর মৃত্যু ঝুঁকি বাড়ায়: গবেষণা

বিটা-ব্লকার নামে পরিচিত এক শ্রেণীর ওষুধ কয়েক দশক ধরে হার্ট অ্যাটাকের পর প্রথম সারির চিকিৎসা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিন্তু এক নতুন গবেষণায় বলা হচ্ছে, এই ওষুধটি বেশিরভাগ রোগীর কোনো উপকারে তো আসেই না, বরং কিছু নারীর ক্ষেত্রে এটি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এবং মৃত্যুর ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।
গবেষণাপত্রটির লেখক ডক্টর ভ্যালেন্টিন ফাস্টার বলেন, "এই গবেষণার ফলাফল নারী ও পুরুষের জন্য বিটা-ব্লকারের ব্যবহার সংক্রান্ত সমস্ত আন্তর্জাতিক নির্দেশিকাকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে। হৃদরোগের চিকিৎসায় নারী-পুরুষের জন্য আলাদা পদ্ধতির যে প্রয়োজন, তা এই গবেষণা সামনে নিয়ে এসেছে।"
'ইউরোপিয়ান হার্ট জার্নালে' প্রকাশিত এই গবেষণায় দেখা গেছে, যে সমস্ত নারীদের হার্ট অ্যাটাকের পর হৃদপিণ্ডের তেমন ক্ষতি হয়নি, তাদের বিটা-ব্লকার দিয়ে চিকিৎসা করা হলে পুনরায় হার্ট অ্যাটাক বা হার্ট ফেইলিওরের কারণে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সম্ভাবনা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। এমনকি, যারা এই ওষুধ গ্রহণ করেননি তাদের তুলনায় মৃত্যুর ঝুঁকি প্রায় তিনগুণ বেড়ে যেতে পারে।
গবেষণার প্রধান লেখক ডক্টর বোর্হা ইবানেজ বলেন, "বিশেষ করে যে নারীরা উচ্চ মাত্রার বিটা-ব্লকার গ্রহণ করছিলেন, তাদের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি ছিল।" তিনি আরও বলেন, "এর আগে হার্ট অ্যাটাকের পর বিটা-ব্লকার নিয়ে যত গবেষণা হয়েছে, তার মধ্যে এই গবেষণায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক নারী অংশগ্রহণ করেছেন, তাই এর ফলাফল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।"
তবে গবেষণায় এটাও বলা হয়েছে যে, এই ফলাফল শুধুমাত্র সেই নারীদের জন্য প্রযোজ্য যাদের হৃদপিণ্ডের 'ইজেকশন ফ্র্যাকশন' ৫০ শতাংশের বেশি, যা স্বাভাবিক বলে মনে করা হয়। 'ইজেকশন ফ্র্যাকশন' হলো হৃদপিণ্ডের বাম নিলয় কতটা ভালোভাবে অক্সিজেনযুক্ত রক্ত সারা শরীরে পাম্প করছে, তা মাপার একটি পদ্ধতি। যাদের হার্ট অ্যাটাকের পর এই মাত্রা ৪০ শতাংশের নিচে নেমে যায়, তাদের জন্য বিটা-ব্লকার এখনও একটি জরুরি ওষুধ।
কিন্তু এই ওষুধের কিছু অপ্রীতিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও থাকতে পারে বলে জানান ডক্টর অ্যান্ড্রু ফ্রিম্যান, যিনি এই গবেষণার সাথে যুক্ত ছিলেন না। তিনি বলেন, "এই ওষুধের কারণে রক্তচাপ কমে যাওয়া, হৃদস্পন্দন কমে যাওয়া, ক্লান্তি এবং মেজাজের পরিবর্তন হতে পারে।"
নারীরা কেন বেশি ঝুঁকিতে?
বিটা-ব্লকারের কারণে পুরুষদের তুলনায় নারীরা কেন বেশি ক্ষতির শিকার হতে পারেন, এর উত্তরে ডক্টর ফ্রিম্যান বলেন, "এটা আসলে আশ্চর্যজনক নয়। লিঙ্গভেদে মানুষ কীভাবে ঔষধে সাড়া দেয়, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। অনেক ক্ষেত্রে, নারীদের হৃদপিণ্ড আকারে ছোট হয়। তারা রক্তচাপের ওষুধের প্রতি বেশি সংবেদনশীল।"
আসলে, হৃদরোগ নিয়ে প্রাথমিক গবেষণাগুলো মূলত পুরুষদের ওপর কেন্দ্র করে হওয়ায়, নারীদের ক্ষেত্রে যে হৃদরোগের লক্ষণ ভিন্ন হতে পারে, তা জানতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের বহু বছর লেগে গেছে। পুরুষদের সাধারণত প্রধান ধমনীগুলোতে প্লাক জমে এবং বুকে ব্যথার মতো পরিচিত লক্ষণ দেখা যায়। অন্যদিকে, নারীদের ক্ষেত্রে হৃদপিণ্ডের ছোট রক্তনালীতে প্লাক জমার সম্ভাবনা বেশি এবং পিঠে ব্যথা, বদহজম ও শ্বাসকষ্টের মতো ভিন্ন লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
আধুনিক চিকিৎসায় কমেছে বিটা-ব্লকারের প্রয়োজনীয়তা
এই গবেষণাটি 'রিবুট' নামক একটি বৃহত্তর ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অংশ ছিল। এতে স্পেন এবং ইতালির ১০৯টি হাসপাতালে হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসা নেওয়া ৮,৫০৫ জন নারী ও পুরুষকে প্রায় চার বছর ধরে পর্যবেক্ষণ করা হয়।
গবেষণার ফলাফল 'দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন'-এ প্রকাশিত হয়েছে।
ডক্টর ফাস্টার বলেন, "আমরা দেখেছি, হার্ট অ্যাটাকের পর যাদের হৃদপিণ্ডের কার্যকারিতা স্বাভাবিক ছিল, তাদের ক্ষেত্রে বিটা-ব্লকার ব্যবহারের কোনো উপকারিতা নেই, যদিও প্রায় ৪০ বছর ধরে এটিই ছিল চিকিৎসার উপায়।"
এর কারণ সম্ভবত আধুনিক চিকিৎসার অগ্রগতি, যেমন স্টেন্ট (রিং) এবং রক্ত পাতলা করার ওষুধের তাৎক্ষণিক ব্যবহার। আজকাল হার্ট অ্যাটাক থেকে বেঁচে যাওয়া বেশিরভাগ নারী-পুরুষের হৃদপিণ্ডের কার্যক্ষমতা ৫০ শতাংশের উপরেই থাকে।
ডক্টর ইবানেজ বলেন, "তা সত্ত্বেও, বর্তমানে আমেরিকা, ইউরোপ এবং এশিয়ায় প্রায় ৮০ শতাংশ রোগীকে বিটা-ব্লকার দিয়ে চিকিৎসা করা হয়, কারণ চিকিৎসা নির্দেশিকাগুলোতে এখনও এটির সুপারিশ করা আছে।"
তবে, যাদের হৃদপিণ্ডের কার্যক্ষমতা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত (৪০% থেকে ৫০%-এর মধ্যে), তাদের জন্য বিটা-ব্লকার এখনও উপকারী। 'দ্য ল্যানসেট'-এ প্রকাশিত আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, এই রোগীদের ক্ষেত্রে বিটা-ব্লকার নতুন হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেইলিওর এবং মৃত্যুঝুঁকি প্রায় ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে পারে।