সামুদ্রিক ড্রোন: কেন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এখনও প্রস্তুত নয়

চীনের সঙ্গে পাল্লা দিতে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী অত্যাধুনিক চালকবিহীন সমুদ্রযান বা সামুদ্রিক ড্রোন তৈরির যে চেষ্টা চালাচ্ছে, তা এখন নানা ধরনের বাধার মুখে পড়েছে।
রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সফটওয়্যারের ত্রুটি, চুক্তি বাতিল এবং নেতৃত্বের সংকটের কারণে এই প্রচেষ্টা অনেকটাই থমকে গেছে।
মার্কিন নৌবাহিনীর এই ব্যর্থতার পেছনে রয়েছে একাধিক দুর্ঘটনা। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ক্যালিফোর্নিয়া উপকূলে পরীক্ষার সময় স্যারোনিক কোম্পানির তৈরি একটি সামুদ্রিক ড্রোন হঠাৎ বিকল হয়ে যায়। এরপর ব্লাক সি টেকনোলজিস-এর একটি নৌকা সেটিকে ধাক্কা দেয়। এর কয়েক সপ্তাহ আগে, ব্লাক সি-এর আরেকটি সামুদ্রিক ড্রোন একটি ছোট নৌযানকে টেনে নেওয়ার সময় অপ্রত্যাশিতভাবে গতি বাড়িয়ে দিলে পেছনেরটি উল্টে যায় এবং এর ক্যাপ্টেন পানিতে পড়ে যান।
এই দুটি ঘটনাই মূলত সফটওয়্যারের ত্রুটি এবং মানবীয় ভুলের কারণে ঘটেছে।
এই দুর্ঘটনার জেরে ডিফেন্স ইনোভেশন ইউনিট (ডিআইইউ), এলথ্রিহ্যারিসের সঙ্গে করা ২০ মিলিয়ন ডলারের একটি সফটওয়্যার চুক্তি স্থগিত করে দেয়। একই সঙ্গে, মার্কিন নৌবাহিনীর ড্রোন অধিগ্রহণ অফিসকেও তদন্তের আওতায় আনা হয়। এর আগে, নৌবাহিনীর নেতৃত্বে থাকা রিয়ার অ্যাডমিরাল কেভিন স্মিথকে তার পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল।
এই সমস্যাগুলো এমন এক সময়ে সামনে এসেছে যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউক্রেনে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত সস্তা, দূর-নিয়ন্ত্রিত সামুদ্রিক ড্রোনের সাফল্যের উদাহরণ টেনে এই প্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন।
তাৎক্ষণিক দুর্ঘটনা ছাড়াও, কাঠামোগত নানা চ্যালেঞ্জ মার্কিন নৌবাহিনীর চালকবিহীন সমুদ্রযান (ইউএসভি) কর্মসূচিকে বাধাগ্রস্ত করছে।
২০২৫ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত এক নিবন্ধে জ্যাক রাউলি লিখেছেন, জাহাজ তৈরির খরচ বৃদ্ধি, কর্মী সংকট এবং বিশ্বজুড়ে সামরিক চাহিদা মেটাতে মার্কিন নৌবাহিনীর তাদের হাইব্রিড ফ্লিট ব্যবস্থাকে উন্নত করা উচিত।
তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, বাজেট হ্রাস, পুরোনো প্রযুক্তি এবং অনির্ভরযোগ্য অপারেশনাল ধারণা এই অগ্রগতির পথে বড় হুমকি। তিনি আরও উল্লেখ করেন, দ্রুত পরিবর্তন না আনলে মার্কিন নৌবাহিনী ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে আরও পিছিয়ে পড়বে।
যখন মার্কিন নৌবাহিনী বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি, তখন চীন দ্রুত গতিতে সামুদ্রিক ড্রোন প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে।
২০২৫ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে জেক রুকে লিখেছেন যে, চীনা নৌ পরিকল্পনাবিদরা সামুদ্রিক যুদ্ধে চালকবিহীন সমুদ্রযানকে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে দেখছেন। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর নির্দেশে, পিপলস লিবারেশন আর্মি নেভি (পিএলএএন) এই প্রযুক্তির উপর জোর দিয়েছে।
মেরিন লিজার্ড, তিয়ানক্সিং-১ এবং ঝু হাই ইউন-এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলো সেই অগ্রগতির প্রমাণ দেয়। কিছু চীনা বিশ্লেষক মনে করেন, চালকবিহীন সমুদ্রযান বিমান হামলার চেয়েও বেশি বিপজ্জনক হতে পারে।
তবে, চীনও এই প্রযুক্তিতে কিছু সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।
এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনা বিশেষজ্ঞরা সামরিক ড্রোনগুলোতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রয়োগের ক্ষেত্রে বড় ধরনের বাধার কথা তুলে ধরছেন। তাদের যুক্তি, বর্তমান এআই কেবল নির্দিষ্ট কিছু কাজের জন্য উপযুক্ত। এতে দুর্বোধ্য যুক্তি, পূর্বাভাস এবং নির্ভরযোগ্য সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার অভাব রয়েছে।
এই সীমাবদ্ধতাগুলোর কারণে সামরিক ঝুঁকিও বাড়তে পারে।
যেমন, ডানলি নামের এক বিশ্লেষক সতর্ক করে বলেন, চালকবিহীন সিস্টেমগুলো মোতায়েন করলে প্রতিরোধের ব্যবস্থা দুর্বল হতে পারে এবং ভুল হিসাব-নিকাশের ঝুঁকিও তৈরি হতে পারে। তিনি মনে করেন, এই ড্রোনগুলো মানব-চালিত জাহাজের সরাসরি বিকল্প হতে পারে না, বরং ড্রোনগুলোকে সেগুলোর পাশাপাশি কাজ করানো উচিত।
মার্কিন ও চীনা উভয় দেশই বুঝতে পারছে যে সমুদ্রে স্বয়ংক্রিয় নৌযানের ধারণা এখনো পূর্ণতা পায়নি। প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা, নতুন ধারণার অভাব এবং প্রশাসনিক বাধাগুলো এখনো বড় চ্যালেঞ্জ।
তবে, মানব-চালিত এবং স্বয়ংক্রিয় নৌযানের সমন্বয়ে গঠিত নৌবাহিনীই আগামীদিনের ভবিষ্যৎ। আর সেই ভবিষ্যতের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকবে, তা নিয়ে ইতোমধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে।