‘ভারত আমাদের বন্দির মতো নৌকায় তুলে সমুদ্রে ফেলে দেয়’: রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অভিযোগ

'মানুষ কীভাবে অন্য মানুষকে এভাবে সমুদ্রে ফেলে দিতে পারে? পৃথিবীতে মানবতা এখনও টিকে আছে হয়তো, কিন্তু আমি ভারত সরকারের মধ্যে কোনো মানবতা দেখিনি!'
আক্ষেপ করে কথাগুলো বলছিলেন নূরুল আমিন। ঠিক তিন মাস আগে ভাইয়ের সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল নূরুল আমিনের। সেই সংক্ষিপ্ত ফোনালাপে তিনি জানতে পারেন, তার ভাই কাইরুল ও চার নিকটাত্মীয়সহ মোট ৪০ জন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে ভারত সরকার। প্রাণের ভয়ে বহু বছর আগে যে দেশ ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলেন, সেখানেই তাদের জোর করে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
মিয়ানমার ভূখণ্ডে পৌঁছানোর পরপরই সেই ৪০ জন দলের অন্যতম সদস্য তার ভাইকে ফোনে জানান, 'তারা আমাদের হাত বেঁধে, মুখ ঢেকে বন্দির মতো নিয়ে এসে তারপর আমাদের সমুদ্রে ফেলে দেয়।'
২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারে চলছে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ। সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে লড়ছে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী ও প্রতিরোধ বাহিনী। এমন পরিস্থিতিতে নূরুল আমিনের পরিবারের সঙ্গে আর দেখা হওয়ার সম্ভাবনা এখন খুবই ক্ষীণ।
দিল্লিতে থাকা ২৪ বছর বয়সী নূরুল আমিন বিবিসিকে বলেন, 'আমার বাবা-মা এবং যাদের ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে, তাদের ওপর কী অমানবিক নির্যাতন চলছে, তা আমি কল্পনাও করতে পারছি না।'
ভারত থেকে ফেরত পাঠানোর তিন মাস পর অবশেষে মিয়ানমারে থাকা সেই সব শরণার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছে বিবিসি। তাদের বেশিরভাগই এখন দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইরত প্রতিরোধ গোষ্ঠী 'বা থু আর্মি' (বিএইচএ)-এর সঙ্গে রয়েছেন।
বা থু আর্মির এক সদস্যের ফোন থেকে ভিডিও কলে সৈয়দ নূর বিবিসিকে বলেন, 'মিয়ানমারে আমরা মোটেও নিরাপদ নই। এই পুরো এলাকাটাই এখন ঘোর যুদ্ধক্ষেত্র।' কাঠের তৈরি একটি আশ্রয়কেন্দ্রে আরও ছয়জন শরণার্থীকে পাশে নিয়ে তিনি এই কথাগুলো বলছিলেন।
শরণার্থীদের কাছ থেকে বিভিন্ন সাক্ষ্যপ্রমাণ এবং একইসঙ্গে দিল্লিতে থাকা তাদের স্বজনদের বক্তব্য সংগ্রহের পর বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিমানযোগে তাদের দিল্লি থেকে বঙ্গোপসাগরের একটি দ্বীপে নেওয়া হয়। এরপর একটি নৌবাহিনীর জাহাজে চাপিয়ে লাইফ জ্যাকেট পরিয়ে জোর করে নামিয়ে দেওয়া হয় আন্দামান সাগরে। কোনোমতে সেখান থেকে উপকূলে পৌঁছান তারা।
এখন মিয়ানমারে তাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। উল্লেখ্য, ব্যাপক নিপীড়ন থেকে বাঁচতে এই মুসলিম রোহিঙ্গা সম্প্রদায় দলে দলে মিয়ানমার ছেড়ে পালিয়েছিলেন।

মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক টমাস অ্যান্ড্রুজ জানান, এই অভিযোগগুলোর স্বপক্ষে 'উল্লেখযোগ্য প্রমাণ' রয়েছে। তিনি জেনেভায় ভারতীয় মিশন-প্রধানের কাছে এসব প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন, তবে এখনও কোনো উত্তর পাননি।
মানবাধিকার কর্মীরা বহুবারই ভারতে রোহিঙ্গাদের নাজুক পরিস্থিতি সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ভারত রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না, বরং দেশের 'ফরেনার্স অ্যাক্ট' অনুযায়ী তাদের অবৈধ অভিবাসী হিসেবে গণ্য করে।
ভারতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী বসবাস করছে। যদিও বাংলাদেশেই এর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, যেখানে প্রায় ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা রয়েছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর তথ্য অনুযায়ী, ভারতে ২৩ হাজার ৮০০ রোহিঙ্গা শরণার্থী নিবন্ধিত রয়েছে। তবে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের অনুমান, এই সংখ্যা ৪০ হাজারেরও বেশি।
গত ৬ মে, দিল্লির বিভিন্ন অংশে বসবাসকারী ৪০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে, যাদের সবার কাছে ইউএনএইচসিআর-এর শরণার্থী কার্ড ছিল, বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহের অজুহাতে স্থানীয় থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। ভারতীয় সরকার কর্তৃক নির্দেশিত এই প্রক্রিয়ায় প্রতি বছর রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ছবি তোলা এবং আঙুলের ছাপ নেওয়া হয়। কয়েক ঘণ্টা পর তাদের শহরের ইন্দরলোক ডিটেনশন সেন্টারে (আটক কেন্দ্র) নেওয়া হয় বলে জানান তারা।
৭ মে, শরণার্থীরা জানান যে তাদের দিল্লির পূর্ব দিকে অবস্থিত হিন্দন বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে তারা বঙ্গোপসাগরে ভারতের অন্তর্ভুক্ত আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের উদ্দেশে বিমানে ওঠেন।
ভিডিও কলে সৈয়দ নূর বলেন, 'বিমান থেকে নামার পর আমরা দেখলাম, দুটি বাস আমাদের নেওয়ার জন্য এসেছে।' বাসগুলোর গায়ে 'ভারতীয় নৌসেনা' লেখা ছিল।
'বাসে ওঠার সাথে সাথেই তারা আমাদের হাত প্লাস্টিকের দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে এবং কালো মসলিনের কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে দেয়,' জানান তিনি। বাসে থাকা ব্যক্তিরা নিজেদের পরিচয় না দিলেও, তাদের পরনে ছিল সামরিক পোশাক এবং তারা হিন্দিতে কথা বলছিলেন।
বাসে চড়ে অল্প কিছুক্ষণ ভ্রমণের পর দলটি বঙ্গোপসাগরে একটি নৌবাহিনীর একটি বিশাল যুদ্ধজাহাজে ওঠে। নূর জানান, তাদের হাত ও মুখের বাঁধন খোলার পরই তারা বিষয়টি বুঝতে পারেন।
মোহাম্মদ সাজ্জাদ, যিনি নূরের সঙ্গে ভিডিও কলে ছিলেন, বলেন, 'জাহাজে থাকা অনেকের পরনে ছিল টি-শার্ট, কালো রঙের ট্রাউজার এবং কালো সামরিক বুট। সবার পোশাক একই রকম ছিল না – কেউ কালো, কেউ বাদামী রঙের পোশাক পরেছিল।'
সৈয়দ নূর জানান, দলটি নৌবাহিনীর ওই জাহাজে প্রায় ১৪ ঘণ্টা ছিল। তাদের নিয়মিত খাবার হিসেবে ভারতীয় ভাত, ডাল ও পনির দেওয়া হয়।
তবে, দলের কিছু সদস্য অভিযোগ করেন যে জাহাজে তাদের ওপর সহিংসতা ও অপমান করা হয়েছে।
সৈয়দ নূর বলেন, 'আমাদের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করা হয়েছে। কয়েকজনকে খুব বাজেভাবে মারধর করা হয়েছে। তাদের একাধিকবার চড় মারা হয়েছে।'
ভিডিও কলে ফয়েজ উল্লাহ তার ডান হাতের কব্জিতে থাকা আঘাতের চিহ্ন দেখান এবং বলেন, তাকে বারবার পিঠ ও মুখে ঘুষি ও চড় মারা হয়েছে, এবং বাঁশের লাঠি দিয়ে খোঁচানো হয়েছে। তিনি বলেন, 'তারা আমাকে প্রশ্ন করছিল, আমি কেন অবৈধভাবে ভারতে আছি, এখানে কেন এসেছি?'
রোহিঙ্গারা প্রধানত মুসলিম জাতিগোষ্ঠী হলেও, গত মে মাসে জোরপূর্বক ফেরত পাঠানো ৪০ জনের মধ্যে ১৫ জন ছিলেন খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। দিল্লি থেকে যাত্রাপথে যারা তাদের আটক করে রেখেছিল, তারা নাকি বলতো, 'কেন তোমরা হিন্দু হওনি? কেন ইসলাম থেকে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছ?' জানান সৈয়দ নূর। তিনি আরও বলেন, 'এমনকি তারা আমাদের প্যান্ট নামিয়ে দেখতে বাধ্য করেছিল যে আমরা খৎনা করা কিনা।'
আরেক শরণার্থী ইমান হোসেন জানান, সামরিক কর্মীরা তাকে ভারতীয়-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে পাহেলগাম হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ করেন।
পরের দিন, ৮ মে স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ শরণার্থীদের নৌবাহিনীর জাহাজের এক পাশ দিয়ে মই বেয়ে নিচে নামতে বলা হয়। নিচে নেমে তারা কালো রঙের চারটি ছোট উদ্ধারকারী নৌকা দেখতে পান বলে জানান।
শরণার্থীদের দুটি নৌকায় তোলা হয়, প্রতিটিতে ২০ জন করে। নৌকা দুটিকে পথ দেখানো অন্য দুটি নৌকায় এক ডজনেরও বেশি কর্মী ছিল। সাত ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে হাত বাঁধা অবস্থায় তারা যাত্রা করে।
সৈয়দ নূর বলেন, 'সামরিক কর্মীদের বহনকারী একটি নৌকা প্রথমে সমুদ্র সৈকতে পৌঁছে একটি গাছের সঙ্গে লম্বা দড়ি বাঁধে। সেই দড়িটি পরে অন্য নৌকাগুলোর কাছে টানা হয়।'
তিনি জানান, এরপর তাদের লাইফ জ্যাকেট দেওয়া হয়, হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে পানিতে ঝাঁপ দিতে বলা হয়। নূর আরও বলেন, 'আমরা দড়ি ধরে ১০০ মিটারেরও বেশি পথ সাঁতরে তীরে পৌঁছাই।'
তাদের বলা হয়েছিল যে তারা ইন্দোনেশিয়ায় পৌঁছেছেন। এরপর যারা তাদের সেখানে নিয়ে এসেছিল, তারা চলে যায়।
এরপরের দিন ৯ মে ভোরের দিকে স্থানীয় জেলেরা দলটিকে খুঁজে পায় এবং জানায় যে তারা মিয়ানমারে রয়েছেন। জেলেরা শরণার্থীদের তাদের পরিবারের সদস্যদের ভারতে ফোন করার জন্য নিজেদের মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেন।
মিয়ানমারের তানিন্থারি অঞ্চলে তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে বা থু আর্মি এই আটকে পড়া শরণার্থীদের খাবার ও আশ্রয় দিয়ে সহায়তা করে আসছে। তবে ভারতে থাকা তাদের পরিবার মিয়ানমারে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম আতঙ্কে রয়েছে।

জাতিসংঘ জানিয়েছে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ যখন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জোরপূর্বক আন্দামান সাগরে ঠেলে দিয়ে তখন তাদের জীবন 'মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলা দিয়েছে'।
জাতিসংঘের অ্যান্ড্রুজ বলেন, 'এরা তো আর নিজ ইচ্ছায় ভারতে আসেনি। মিয়ানমারে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ সহিংসতার কারণেই তারা সেখানে আছে। আক্ষরিক অর্থেই জীবন বাঁচাতে পালিয়ে এসেছে।'
গত ১৭ মে, নূরুল আমিন এবং ফেরত পাঠানো শরণার্থীদের আরেকজন আত্মীয় তাদের দিল্লিতে ফিরিয়ে আনতে, অবিলম্বে একই ধরনের নির্বাসন বন্ধ করতে এবং ৪০ জন ব্যক্তির সবাইকে ক্ষতিপূরণ দিতে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে একটি আবেদন দাখিল করা হয়।
যদিও আবেদনের জবাবে, দুই বিচারপতির বেঞ্চের একজন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অভিযোগগুলোকে 'কাল্পনিক ধারণা' বলে অভিহিত করেন। তিনি আরও বলেন, অভিযোগকারী পক্ষ তাদের দাবি প্রমাণের জন্য পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ সরবরাহ করতে পারেনি।
আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর শুনানিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে যে রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে গণ্য করা হবে, নাকি তারা অবৈধ অভিবাসী হিসেবে বিবেচিত হবেন এবং ফলস্বরূপ তাদের প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করা হবে কি না।
তবে ভারতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী থাকা সত্ত্বেও, এই ৪০ জনকে বিতাড়িত করতে কেন এত চেষ্টা চালানো হলো, তা এখনও স্পষ্ট নয়। আবেদনকারীদের আইনজীবী কলিন গনসালভেস বলেন, 'মুসলিমদের প্রতি এই বিদ্বেষ ছাড়া কেন এমনটি করা হলো, তা ভারতে কেউই বুঝতে পারছে না।'
শরণার্থীদের প্রতি এমন আচরণ ভারতে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মধ্যে চরম আতঙ্ক তৈরি করেছে। কেউ কেউ এখন আত্মগোপনে। নূরুল আমিনের মতো অনেকেই এখন আর নিজের বাড়িতে ঘুমান না। তিনি তার স্ত্রী ও তিন সন্তানকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিয়েছেন।
নূরুল আমিন বলেন, 'আমার মনে এখন শুধু একটাই ভয়, যেকোনো সময় ভারত সরকার আমাদেরও ধরে নিয়ে সমুদ্রে ফেলে দেবে। এখন আমরা ঘর থেকে বের হতেও ভয় পাচ্ছি।'