মোদির দুর্লভ চীন সফর নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কি উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত?
পাঁচ বছর আগে হিমালয়ের উঁচু এলাকায় এক রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর ছিন্ন হয়ে যাওয়া সম্পর্ক আবার ঠিক হওয়ার মতো পরিস্থিতিতে এসেছে, মূলত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অর্থনৈতিক চাপের কারণে।
২০১৮ সালের পর প্রথমবারের মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই সপ্তাহে চীন সফরে যাচ্ছেন। সেখানে তিনি চীনের নেতা শি জিনপিংয়ের আয়োজিত শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেবেন। এ সফর এমন সময়ে হচ্ছে, যখন ট্রাম্প ভারতের আমদানি পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন।
অদ্ভুত একটি পরিস্থিতিতে দুই দেশের নেতারা—যাদের সেনারা ২০২০ সালে সীমান্তে হাত, পাথর ও লাঠি নিয়ে ভয়ঙ্কর লড়াই করেছিল—এবার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে গুরুত্ব দিয়ে একে অপরের সঙ্গে হাত মেলাতে পারেন।
মোদির সঙ্গে রাশিয়া, পাকিস্তান, ইরান এবং মধ্য এশিয়ার নেতারা এই সপ্তাহান্তে শি জিনপিংয়ের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন শাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন-এর (এসসিও) সবচেয়ে বড় সম্মেলনে। এটি মস্কো ও বেইজিং-এর তৈরি করা একটি আঞ্চলিক নিরাপত্তা ক্লাব, যা বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্য বদলাতে চায়।
এ অনুষ্ঠানে ভারতের অংশগ্রহণ যে দুই এশীয় শক্তির মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার ইঙ্গিত। এটি এমন একটি পরিবর্তন, যা বহু বছর ধরে চীনের উত্থান ও সক্রিয়তা মোকাবিলায় ভারতকে প্রতিদ্বন্দ্বী বানানোর মার্কিন কৌশলকে ব্যর্থ করতে পারে।
যদিও ভারত ও চীনের সম্পর্কের মধ্যকার উত্তেজনা কিছুটা কমতে শুরু করেছে; বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্পের 'আমেরিকা ফার্স্ট' নীতি দুই দেশের নেতাদেরকে—যারা জাতীয়তাবাদকে রাজনৈতিক ব্র্যান্ড হিসেবে ব্যবহার করেন—একটি প্রয়োজনীয় অংশীদারিত্বের অংশ হওয়ার কথা ভাবতে বাধ্য করছে।
রাশিয়ার তেল কেনার জন্য ট্রাম্প যখন ভারতের ওপর শুল্ক আরোপ করলেন, তা মোদির জন্য বেশ দুঃখজনক ছিল। কারণ ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে তাদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠছিল।
বেঙ্গালুরুর তক্ষশিলা ইনস্টিটিউশনের মনোজ কেওয়ালরামানি ইন্দো-প্যাসিফিক স্টাডিজের প্রধান মনোজ কেওয়ালরামানি বলেন, শুল্কের হুমকি 'নয়াদিল্লিকে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক করার জন্য তাড়াহুড়ো করতে বাধ্য করেছিল। তবে এটি মূল কারণ ছিল না। ভারত ও চীন দুই দেশই নিজেদের স্বার্থে সম্পর্ক স্থিতিশীল করতে চায়।'
পাশাপাশি, সফল বিভিন্ন হোয়াইট হাউস প্রশাসন ভারতকে প্রযুক্তি হস্তান্তর ও যৌথ সামরিক মহড়ার মাধ্যমে কৌশলগতভাবে সহযোগিতা বাড়াতে কাজ করেছে। এর লক্ষ্য ছিল ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ক্রমবর্ধমানভাবে আক্রমণাত্মক চীনের বিরুদ্ধে ভারতের সঙ্গে অংশীদারিত্ব করা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতকে হারানো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে খারাপ ফলাফল হবে।
গত সপ্তাহে নয়াদিল্লিতে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির মধ্যে বৈঠক শেষে দুই পক্ষই তাদের সম্পর্কের সাম্প্রতিক উন্নতি স্বীকার করেছেন।
মোদি বলেছেন, 'ভারত-চীন সম্পর্ক একে অপরের স্বার্থ ও সংবেদনশীলতার প্রতি সম্মান রেখে ধারাবাহিক উন্নতি করেছে। ভারত ও চীনের মধ্যে স্থিতিশীল, অনুমানযোগ্য ও গঠনমূলক সম্পর্ক অঞ্চল এবং বিশ্বে শান্তি ও সমৃদ্ধিতে বড় অবদান রাখবে।'
ওয়াশিংটনের স্টিমসন কেন্দ্রের চীনা প্রোগ্রামের পরিচালক ইয়ুন সান বলেছেন, বেইজিংয়ের দৃষ্টিতে 'এই শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি নিশ্চিতভাবেই ট্রাম্প শুরু করেছিলেন।'
তিনি বলেছেন, 'ভারত আর কল্পনা করতে পারছে না যে এখনো (যুক্তরাষ্ট্রের) পূর্ণ সমর্থন আছে।' সান আরও বলেন, তাই বেইজিং মনে করে, যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে কম সমর্থন দিচ্ছে, ভারতকে 'তার পররাষ্ট্রনীতি নতুনভাবে হিসাব করে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করতে হবে।'
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এই শীর্ষ সম্মেলন কোনো মূল পরিবর্তন আনার সম্ভাবনা কম।
মনোজ কেওয়ালরামানি বলেন, 'আমার মতে, ভারত এমনভাবে বলছে না যে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আর নেই। এটা হবে না। যুক্তরাষ্ট্র এখনও আমাদের সবচেয়ে বড় অংশীদার, কিন্তু চীন আমাদের সবচেয়ে বড় প্রতিবেশী। আমাদের এর সঙ্গে বসবাস করতে হবে।'
বন্ধুত্বের সম্পর্ক থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্পর্ক
ঔপনিবেশিক শাসনের প ভারত-চীনের সম্পর্ক শুরু হয়েছিল সহযোগিতামূলক বন্ধুত্ব থেকে, এখন তা কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরিণত হয়েছে।
ভারত ১৯৫০ সালে চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করা প্রথম দেশগুলোর মধ্যে একটি ছিল। সেই সময়ে দুই দেশের মধ্যে এশিয়ার ঐক্য নিয়ে মিল ছিল। কিন্তু ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধ ওই বন্ধুত্ব ভেঙে দিয়েছিল। ছোট কিন্তু নৃশংস এই যুদ্ধে গভীর অবিশ্বাস তৈরি হয় এবং এখনো দুই দেশের মধ্যে সীমানা বিরোধ মেটেনি, যা সম্পর্কের সবচেয়ে বড় সমস্যা।
পরবর্তী দশকগুলোতে দুই দেশের নেতৃত্ব অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করেছিল। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বেড়েছিল, যদিও সীমান্তে সমস্যা চলছিল। কিন্তু ২০২০ সালে গালওয়ান ভ্যালির সংঘর্ষে অন্তত ২০ ভারতীয় ও ৪ চীনা সেনা নিহত হওয়ার ঘটনায় এই ভারসাম্য ভেঙে পড়ে।
এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের সাউথ এশিয়া ইনিশিয়েটিভের পরিচালক ফারওয়া আমের বলেন, '২০২০ সালের সংঘর্ষ ভারত সহজে ভুলে যেতে পারবে না। মূল লক্ষ্য হলো, এমন ঘটনা আর না ঘটুক। এজন্য সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের জন্য সীমান্তে স্থিতিশীলতা নিয়ে যৌথ বোঝাপড়া তৈরি করা জরুরি।'
গত অক্টোবর রাশিয়ায় ব্রিকস সম্মেলনের সাইডলাইনে মোদি ও শি জিনপিংয়ের বৈঠকের পর ভারত ও চীনের সম্পর্ক ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। দুই দেশ করোনা মহামারির কারণে বন্ধ হওয়া সরাসরি ফ্লাইট পুনরায় চালু করতে সম্মত হয়েছে।
পাশাপাশি বেইজিং পশ্চিম তিব্বতের দুটি তীর্থস্থান ভারতের নাগরিকদের জন্য পাঁচ বছর পর প্রথমবারের মতো খুলতে সম্মত হয়েছে। এছাড়া, উভয় দেশই একে অপরের নাগরিকদের জন্য পর্যটন ভিসা পুনরায় জারি করতে শুরু করেছে।
সম্পর্কে নতুন সামঞ্জস্য
ভারত চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নতুনভাবে সমন্বয় করছে। এটি তার নীতির অংশ, যেখানে দেশের স্বার্থকে সবকিছুর আগে রাখা হয়।
এসকেও শীর্ষ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী মোদি চীনের শি জিনপিং-এর সঙ্গে থাকবেন। পাশাপাশি সেখানে থাকবেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, যার সঙ্গে সম্প্রতি ভারত মারাত্মক সংঘর্ষে জড়িয়েছিল; এবং রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী, যারা ইউক্রেন আক্রমণের পরও ভারতে তেল বিক্রি অব্যাহত রেখেছে। এই কারণে অসন্তুষ্ট হয়ে ট্রাম্প ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছিলেন।
চীন প্রাধান্য পাওয়া এই ব্লকের সঙ্গে ভারতের এই সম্পর্ক, কোয়াডের সাথে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিপরীতমুখী। কোয়াডে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া আছে, যা ভারত মহাসাগরে চীনের প্রভাবের বিপরীতে গণতান্ত্রিক ভারসাম্য হিসেবে দেখা হয়।
মনোজ কেওয়ালরামানি বলেন, হিমালয়ের সীমান্তে বিরোধ চললেও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিককে নিরাপত্তা সংঘাত থেকে আলাদা রাখার চেষ্টা করছে ভারত।
তিনি বলেন, 'উভয় দেশ জানে সম্পর্কের জটিলতা আছে এবং এটি সহজ হবে না। তবে উভয়ই বুঝতে পারে, যে মাত্রায় সম্পর্ক খারাপ হয়েছে, তা কোনো দেশের স্বার্থে নয়।'
স্থিতিশীলতার পথ
ভারত চীনের সঙ্গে সম্পর্কে সামঞ্জস্য আনছে মূলত অর্থনৈতিক কারণে, নিরাপত্তা শিথিল হওয়ার কারণে নয়।
গত বছর চীন ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের পর। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ১১৮ বিলিয়ন ডলার পৌঁছেছিল। ভারত চীনের ওপর নির্ভরশীল, শুধু ইলেকট্রনিক্সের মতো প্রস্তুত পণ্যের জন্য নয়, বরং শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও মাঝারি উপকরণের জন্যও।
তবে এই অর্থনৈতিক সম্পর্কের পেছনে থাকে সীমান্তে টানাপোড়েন। হিমালয়ের বিতর্কিত সীমান্তে এখনও হাজার হাজার সেনা মোতায়েন থাকায় মোদি ও শি জিনপিং-এর আলোচনায় জটিলতা রয়েছে। এই সমাধানহীন সংঘাতই মূল বাধা। গত সপ্তাহে দুই দেশ সীমান্ত বিষয়ক ১০টি বিষয়ে একমত হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে 'শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা'। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে এমনটাই বলা হয়েছে।
ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের এশিয়া পলিসি স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো তানভি মদন বলেন, 'উভয়ই একে অপরের প্রতি সত্যিই বিশ্বাস রাখবে কিনা, তা স্পষ্ট নয়।'
তিনি বলেন, দুই নেতার কথাবার্তা বাস্তবে উত্তেজনা কমাতে পারবে কিনা, তা বড় পরীক্ষা হবে। কারণ আগে এটি ব্যর্থ হয়েছে।
ভারত-চীনের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে তারা কতটা সাবধানে এই সম্পর্ক পরিচালনা করতে পারে তার ওপর।
সাউথ এশিয়া ইনিশিয়েটিভের পরিচালক ফারওয়া আমের বলেছেন, 'ভবিষ্যতে হয়তো সম্পর্ক কিছুটা স্থিতিশীল হবে, যেখানে প্রতিযোগিতা থাকবে, কিন্তু সংঘাত থাকবে না।'
