ফোনের নীল আলো কি সত্যিই ঘুমের শত্রু?

দীর্ঘদিন ধরে বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন, ঘুমানোর আগে স্ক্রিনের নীল আলো ক্ষতিকর। ফোন, টিভি, ল্যাপটপ কিংবা ট্যাবের আলো আমাদের মস্তিষ্কে মেলাটোনিন নামের হরমোন তৈরিকে কমিয়ে দেয়। এই হরমোনই সাধারণত ঘুম আনে। কিন্তু আলোতে বাধা পেলে মানুষ আরও সতেজ বোধ করে, আর ঘুম আসতে দেরি হয়।
তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বিষয়টি এত সরল নয়। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যার সহকারী অধ্যাপক লরেন ই. হার্টস্টেইন বলেন, কেবল নীল আলোই খারাপ ঘুমের জন্য দায়ী এমন প্রমাণ স্পষ্ট নয়। বরং কিছু ক্ষেত্রে স্ক্রিনে কিছু দেখা উল্টো ঘুম আনতে সাহায্য করতে পারে।
নীল আলো নিয়ে গবেষণা
স্ক্রিনের নীল আলো নিয়ে বেশিরভাগ গবেষণা পুরোনো, অংশগ্রহণকারীর সংখ্যাও ছিল সীমিত। অনেক গবেষণাই নিয়ন্ত্রিত ল্যাবরেটরিতে হয়েছে, তাই বাস্তব জীবনে ফলাফল মিলবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
নিউইয়র্কের আইকান স্কুল অব মেডিসিনের বিজ্ঞানী মারিয়ানা ফিগেইরো বলেন, নীল আলোতে মেলাটোনিন কমে যেতে পারে, তবে সব সময় স্ক্রিন ব্যবহারেই তা ঘটে না। তার গবেষণায় দেখা গেছে কতক্ষণ ডিভাইস ব্যবহার করা হচ্ছে, চোখের কত কাছে ধরা হচ্ছে কিংবা আলো কত উজ্জ্বল, সেটিও বড় ভূমিকা রাখে।
একটি গবেষণায় দেখা যায়, টানা দুই ঘণ্টা উজ্জ্বল আলোতে আইপ্যাড ব্যবহার করলে মেলাটোনিন সামান্য কমে যায়। কিন্তু এক ঘণ্টা ব্যবহার করলে কোনো পরিবর্তন হয় না। টেলিভিশন নয় ফুট দূরে বসে দেখলেও মেলাটোনিনে কোনো প্রভাব পড়ে না। আবার স্ক্রিনের আলো যত বেশি উজ্জ্বল, প্রভাবও তত বেশি।
দিনে পর্যাপ্ত সূর্যালোক পাওয়া থাকলে রাতে স্ক্রিনের কারণে হরমোনের এই কমতি হয় না, এমন প্রমাণও আছে। তবে সবাই সমানভাবে আলোতে সংবেদনশীল নয়। কারও ক্ষেত্রে সামান্য নীল আলোতেও হরমোন কমে যায়, আবার কারও ক্ষেত্রে অনেক বেশি আলো লাগলেও তেমন প্রভাব পড়ে না।
কীভাবে স্ক্রিন ব্যবহার করছেন, সেটিই গুরুত্বপূর্ণ
কেবল আলো নয়, আপনি স্ক্রিনে কী করছেন সেটিও ঘুমের ওপর প্রভাব ফেলে। গেম খেলা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম স্ক্রল করা, অনলাইন শপিং বা জুয়া খেলা, এসব মস্তিষ্ককে উদ্দীপিত করে। ফলে অনেক রাত পর্যন্ত চোখ স্ক্রিনে আটকে থাকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক, কারণ এটি এমনভাবে তৈরি যাতে মানুষ সহজে থামতে না পারে।
কোনো খবর বারবার দেখা বা টানা ভিডিও দেখা মস্তিষ্ককে অস্থির করে তোলে। ডিভাইস বন্ধ করা গেলেও মস্তিষ্ক বন্ধ করা যায় না, বললেন ড. হার্টস্টেইন।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব কিশোর ঘুমানোর আগে গেম খেলে বা টেক্সট করে, তারা দেরিতে ঘুমায় এবং ঘুমের সময়ও কম হয়। তবে শুধু টেলিভিশন দেখা বা বই পড়ার প্রভাব নিয়ে বিজ্ঞানীরা একমত নন।
রাতের নতুন কোনো রোমাঞ্চকর সিরিজ দেখা ঘুম নষ্ট করতে পারে। বিপরীতে পরিচিত পুরোনো গল্প পড়া বা দেখা ঘুম আনতে সাহায্য করে।
কিছু ক্ষেত্রে স্ক্রিন ব্যবহার উল্টো ঘুম আনতে পারে
যাদের ঘুমানোর আগে নানা দুশ্চিন্তা ঘিরে ধরে, তাদের জন্য হালকা ধরনের সিরিজ দেখা বা বই পড়া উপকারী হতে পারে। তবে বিষয়বস্তু যেন শান্ত ও পরিচিত হয়।
ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিসকো বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী অ্যারিক প্র্যাদার বলেন, 'ইটস অলওয়েজ সানি ইন ফিলাডেলফিয়া' সিরিজ তার এক রোগীর সবচেয়ে কার্যকর ঘুম আনার উপায়।
তবে শোবার বিছানায় এসব করা উচিত নয়। বিছানা শুধু ঘুমের জন্য, এ ধারণা মস্তিষ্কে তৈরি হওয়া দরকার।
সবশেষে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি কারও ক্ষেত্রে স্ক্রিন ব্যবহার ঘুমে প্রভাব না ফেলে, তবে চিন্তার কিছু নেই। দ্রুত ঘুম আসছে, রাতভর ঘুম হচ্ছে আর সকালে সতেজ লাগছে, এমনটা হলে তাহলে আচরণ বদলানোর প্রয়োজন নেই।