নিয়ান্ডারথালদের গোত্রভেদে নিজস্ব খাবার ছিল, ম্যাগটে ভরা পচা মাংস তার মধ্যে অন্যতম: গবেষণা
বাইরে কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে, তাপমাত্রা প্রায় শূন্য ডিগ্রি। কিন্তু একটি গুহার ভেতরে কয়েকজন নিয়ান্ডারথাল আগুনের চারপাশে গোল হয়ে বসে আছে। সমতল পাথরের ওপর বসে থাকা বড়দের সঙ্গে আছে শিশু ও একজন বৃদ্ধ। সকালের দিকে শিকার করা একটি হরিণের মাংস তখনও রান্না হয়ে ওঠেনি, সবাই অপেক্ষা করছে।
হাঁড়ি বা চামচ কিছুই নেই, তবে তারা রান্নার কৌশল জানে। তীক্ষ্ণ পাথরের ছুরি দিয়ে মাংসটিকে বিশেষভাবে কাটা হয়েছে। যাদের এখনো ক্ষুধা লেগে আছে, তাদের জন্য রাখা হয়েছে বীজ, গাছের কিছু অংশ, আর এক ধরনের বিশেষ খাবার—পচা মাংস, যেখানে বাসা বেঁধেছে পুষ্টিকর লার্ভা ও ম্যাগট।
এই দৃশ্যটি আজ থেকে প্রায় ৩ লাখ বছর আগে, মধ্য কিংবা পশ্চিম ইউরোপের কোনো এক অঞ্চলে ঘটতে পারে। তবে নিয়ান্ডারথালদের জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু জানা খুব কঠিন। তা সত্ত্বেও গবেষকরা ধীরে ধীরে এমন কিছু তথ্য আবিষ্কার করছেন, যেগুলো দিন দিন বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত দুটি গবেষণায় বলা হয়েছে, যদিও নিয়ান্ডারথালদের নির্দিষ্ট কোনো রন্ধনপ্রণালী ছিল না, তবে খাবারকে ঘিরে তাদের কিছু সাংস্কৃতিক অভ্যাস ছিল।
সম্প্রতি (১ আগস্ট) 'সায়েন্স অ্যাডভান্সেস' পত্রিকায় প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ম্যাগট খাওয়ার অভ্যাস নিয়ান্ডারথালের হাড়ে পাওয়া অস্বাভাবিক মাত্রার নাইট্রোজেনের ব্যাখ্যা হতে পারে। বহু বছর ধরে নিয়ান্ডারথালের হাড় বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তাদের হাড়ে এত বেশি পরিমাণ নাইট্রোজেন রয়েছে যে, তা শিয়াল, হায়না বা সিংহের মতো মাংসাশী প্রাণীর তুলনায়ও বেশি।
এই তথ্যের ভিত্তিতে এতদিন মনে করা হতো, নিয়ান্ডারথালরা ছিল অত্যন্ত মাংসাশী এবং খাদ্য শৃঙ্খলে সর্বোচ্চ স্তরে অবস্থান করত। তবে এই ধারণা এখন প্রশ্নের মুখে পড়েছে। কারণ মানুষের শরীর এমন অনেক প্রোটিন আত্মস্থ করতে পারে না, যেভাবে বিশেষ মাংসাশী প্রাণীরা পারে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, নিয়ান্ডারথালের শরীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্য না থাকার পরও তারা এত বেশি মাংসাশী হওয়ার চিহ্ন কীভাবে দেখাতে পারে?
কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক আইনারা সিস্তিয়াগা বলেন, 'নিয়ান্ডারথালদের জীবন সম্পর্কে অনেক কিছু বোঝা সম্ভব, যদি আমরা এমন কিছু বিষয় বিবেচনায় নেই, যেগুলো আমাদের খাদ্যবোধের সঙ্গে মেলে না।' যদিও তিনি এই গবেষণায় সরাসরি জড়িত ছিলেন না, তবু মনে করেন—পচা মাংস খাওয়ার সম্ভাবনাটিকে গুরুত্ব সহকারে দেখা দরকার। আজকের দিনে যা আমাদের কাছে অস্বাভাবিক বা ঝুঁকিপূর্ণ মনে হতে পারে, তা অতীতে কিছু সংস্কৃতিতে সাধারণ ছিল। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ইনুয়িটদের মধ্যে এখনো প্রচলন আছে মাটির নিচে পচিয়ে রাখা সিল মাছ খাওয়ার।
গবেষণায় বলা হয়েছে, নিয়ান্ডারথালদের অন্যতম প্রধান খাবার ছিল পচা মাংস, যা মাছির ডিম থেকে ফোটা ম্যাগটে ভরা থাকত। গবেষকদের মতে, এই ম্যাগট পচা মাংস খেয়ে শরীরে আরও বেশি নাইট্রোজেন জমায়—যেটা কাঁচা মাংসের চেয়েও বেশি। নিয়ান্ডারথালরা যখন সেই ম্যাগটসহ মাংস খেত, তখন তাদের শরীরেও নাইট্রোজেনের মাত্রা বেড়ে যেত। আর এ কারণেই ইতিহাসের নানা জায়গায় নিয়ান্ডারথালের দেহাবশেষে অস্বাভাবিক হারে নাইট্রোজেন পাওয়া গেছে।
গবেষকদের ধারণা, এটি নিয়ান্ডারথালদের একটি সচেতন ও কৌশলী সিদ্ধান্ত ছিল—শীতকালে শরীর গরম রাখা ও শক্তি পাওয়ার জন্য চর্বি ও প্রোটিনসমৃদ্ধ এসব খাবার তারা বেছে নিত।
তবে গবেষণাটির কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। স্পেনের আলকালা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ম্যানুয়েল দোমিনগেস-রদ্রিগো বলেন, নতুন এই ব্যাখ্যা 'খুবই অনিশ্চিত'। তার মতে, প্রাচীন মানুষের হাড়ে বেশি নাইট্রোজেন জমে থাকার পেছনে আরও অনেক কারণ থাকতে পারে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, যদি নিয়ান্ডারথালরা প্রচুর পরিমাণে পশুর গোবর খেত, তাহলেও তাদের হাড়ে একই মাত্রার নাইট্রোজেন পাওয়া যেত।
তিনি বলেন, 'সমস্যা হলো, এমন একটি ধারণা থেকে, যেমন এই গবেষণায় বলা হয়েছে, কীভাবে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণযোগ্য তথ্য বের করা যাবে? এখনো পর্যন্ত বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিয়ান্ডারথালরা প্রচুর পরিমাণে মাংস খেত—এই ব্যাখ্যাটিই এখনো সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য, কারণ অন্য বিকল্প ব্যাখ্যাগুলো এখনও প্রমাণিত নয়।'
গবেষক সিস্তিয়াগা বলেন, এই ধরনের অনিশ্চয়তা দেখায়, 'আসলে কী ঘটেছিল, তা জানা কতটা জটিল। বিশেষ করে যখন এমন একটি প্রজাতির খাদ্যাভ্যাস নিয়ে ভাবতে হয়, যারা হাজার হাজার বছর বেঁচে ছিল এমন পরিবেশে, যা আজও আমাদের জন্য রহস্যপূর্ণ।' তিনি আরও বলেন, 'এই ধরনের গবেষণা মানুষের বিবর্তনের ধাঁধায় নতুন নতুন টুকরো যোগ করে।'
প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম
নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, কাছাকাছি অবস্থিত দুটি গুহায় বসবাসকারী নিয়ান্ডারথাল গোষ্ঠীগুলো পশু জবাই ও রান্নার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করত। গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে চলতি বছরের ১৭ জুন 'ফ্রন্টিয়ার্স ইন এনভায়রনমেন্টাল আর্কিওলজি' সাময়িকীতে।
ইসরায়েলের হিব্রু ইউনিভার্সিটির গবেষক ও সহলেখক আনায়েল জালোঁ জানান, 'এই দুই গুহার মাঝে যে পার্থক্য দেখা গেছে, তা বোঝায়, খাবার নিয়ে তৎকালীন নিয়ান্ডারথালদের মধ্যে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ছিল।'
দুটি গুহাই একই ধরনের কাজে ব্যবহৃত হতো—বাসস্থান, আগুন জ্বালানো, খাবার রান্না, বর্জ্য ফেলা এবং মৃতদের কবর দেওয়া। আশপাশের পরিবেশ ও শিকারযোগ্য প্রাণীর মধ্যেও ছিল বিস্তর মিল। শীতকালে এসব গুহার ব্যবহার হতো বেশি।
এই কারণেই জালোঁ মনে করেন, 'সব নিয়ান্ডারথাল যদি এক রকম আচরণ করত, তাহলে পশু কাটা ও প্রস্তুতির পদ্ধতিতেও মিল থাকত।' কিন্তু বাস্তব চিত্র বলছে ভিন্ন কথা—প্রতিটি গোষ্ঠীরই ছিল নিজস্ব কৌশল। এই ভিন্নতা সময়ের সঙ্গে টিকে থেকেছে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে জ্ঞান ও অভ্যাস রূপান্তরিত হয়েছে।
যদিও এখনো প্রমাণের ঘাটতি রয়েছে বলে নির্দিষ্টভাবে রান্নার পদ্ধতি বোঝা সম্ভব নয়, তবে গবেষকদের ধারণা, নিয়ান্ডারথালদের রুচি ও রান্নার কৌশলেও ছিল পার্থক্য।
জালোঁ বলেন, 'ধরা যাক, সব নিয়ান্ডারথালই একই উপকরণ ব্যবহার করত, কিন্তু তাদের নিজস্ব রান্নার ধারা বা স্বাক্ষর ছিল। অথবা একই ধরনের খাবার তারা আলাদা উপায়ে তৈরি করত।'
নিয়ান্ডারথালের খাবারের মানচিত্র
নিয়ান্ডারথালদের খাদ্যাভ্যাস নির্ধারণ করা ঠিক ততটাই কঠিন, যতটা আজকের মানুষের জন্য একটি নির্দিষ্ট খাদ্যতালিকা তৈরি করা। যেমন, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মানুষ যেভাবে খায়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষ খায় একেবারেই ভিন্নভাবে—তেমনি নিয়ান্ডারথালরাও কোনো একটি অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল না। তারা এত বিস্তৃত এলাকাজুড়ে বসবাস করত যে, তাদের খাদ্যসংস্কৃতির মানচিত্র তৈরি করাটাই একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
তার ওপর, সব ধরনের খাবারের চিহ্ন রেখে যাওয়ার সম্ভাবনাও এক নয়। যেমন, মাংসের অস্তিত্ব অনেক সময় হাড়ের মাধ্যমে বোঝা যায়। কিন্তু শাকসবজি বা ডালের মতো উদ্ভিদজাত খাবারের চিহ্ন পাওয়া খুবই কঠিন। গবেষক সিসতিয়াগা জানান, 'উদ্ভিদের চিহ্ন হাড়ে পাওয়া দুরূহ। দাঁতের পাথরে উদ্ভিদের ডিএনএ বা প্রোটিন খোঁজার চেষ্টা হয়েছে, তবে ফলাফল খুব একটা নিশ্চিত নয়।' অনেক সময় দাঁতে থাকা উদ্ভিদের আঁশ খাওয়ার জন্য না-ও থাকতে পারে। আবার প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলোতেও উদ্ভিদের অবশেষ খুব একটা সংরক্ষিত থাকে না। ফলে এখনো পর্যন্ত প্রাণিজ প্রোটিনের উপস্থিতিই বেশি ধরা পড়ে। এখান থেকেই এসেছে একটি ভুল ধারণা—'নিয়ান্ডারথালরা শুধুই মাংস খেত'।
কিন্তু বাস্তবতা ছিল আরও জটিল ও বৈচিত্র্যময়। ২০২৩ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় জানা যায়, আজকের পর্তুগালের লিসবনে ৯০ হাজার বছর আগে নিয়ান্ডারথালরা আগুনে পোড়া সামুদ্রিক খাবার খেত। ২০১৭ সালের আরেক গবেষণায় দেখা যায়, তারা স্পেনের অন্তর্দেশীয় অঞ্চল থেকে মাশরুম সংগ্রহ করে খেত। এমনকি ২০১১ সালের একটি পর্যালোচনায় বলা হয়, মধুও হতে পারে তাদের শক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস।
এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই, ভালো খাবার পাওয়ার প্রতিযোগিতা মানব প্রজাতির বিবর্তনে বড় ভূমিকা রেখেছে।
২০১৫ সালের একটি গবেষণায় ধারণা করা হয়, রান্না করার ক্ষমতার সূচনা হয়েছিল আজ থেকে ৬০ লাখ বছরেরও বেশি আগে। রান্না করা খাবার সহজে হজম হয় এবং একই পরিমাণ কাঁচা খাবারের তুলনায় এতে শরীরে বেশি ক্যালরি জমে। এর ফলে মস্তিষ্কের বিকাশের পথ তৈরি হয়।
সবশেষে বলা যায়, স্বাদের পেছনে মানুষের ছুটে চলাই হতে পারে মানব বিবর্তনের এক বড় চালিকাশক্তি। আর কে জানে, সেই স্বাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল হয়তো এক টুকরো পচা মাংস থেকে—যেখানে গিজগিজ করত ম্যাগট।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়
