ছবিতে দক্ষিণ এশিয়ায় পরিবহনের অনন্য শিল্পকর্ম
দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে যানবাহনে ছবি আঁকা ও নকশা করার ঐতিহ্য বহু পুরনো। তবে বর্তমানে এই শিল্প অনেকটাই অবহেলিত। ফটোগ্রাফার ক্রিস্টোফার হারউইগ এই শিল্পকর্ম সংগ্রহ ও নথিভুক্ত করার উদ্দেশ্যে প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার ভ্রমণ করেন। পাকিস্তানের উত্তর প্রান্ত থেকে শ্রীলঙ্কার দক্ষিণ পর্যন্ত প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য তিনি নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, নানা কারণে এই শিল্পকর্ম ক্রমশ বিলুপ্তির পথে। আর তাই এটি সংরক্ষণের কাজ এখন আগের চেয়ে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
কিরিবাথগোডা, শ্রীলঙ্কা

ভারতীয় উপমহাদেশের ট্রাক ও ছোট যানবাহনগুলো প্রায়শই দেখা যায় অপূর্ব সাজে সজ্জিত। স্বশিক্ষিত শিল্পীরা কাজল-লাগানো গভীর চোখ, রঙিন সুতোর গোছা (ঝালর), উড়ন্ত পাখি কিংবা দেব-দেবীর প্রতীক আঁকেন গাড়ির বিভিন্ন অংশে। প্রতিটি প্রতীক একটি গল্প বহন করে, তবে এর সঙ্গে মিশে থাকে পৌরাণিক কাহিনি, লোকগাঁথা, বিশ্বাস ও ঐতিহ্যের ছোঁয়া। শ্রীলঙ্কার এই অঞ্চলও এর ব্যতিক্রম নয়।
ইন্দোর, ভারত

একটি ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাক গড়ে দিনে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে। আর চালকরা বছরের অধিকাংশ সময় পরিবার ও বন্ধুদের থেকে দূরে থাকেন। সরকারি নিয়মকানুনে বাধা না থাকলে তারা ইচ্ছেমতো ট্রাক সাজাতে পারেন। এ অঞ্চলের চালকদের কাছে ট্রাক কেবল পণ্যবাহী যান নয়, যেন নিজের স্ত্রী! তাই ট্রাক সাজানো হয় বধূসুলভ অলঙ্করণে, আর কেবিন সাজানো হয় নববধূর শোবার ঘরের মতো করে। যেখানে থাকে রঙিন কাপড়, পরান্দি, ঝালর, আয়না ও নানা অলংকার সামগ্রী।
জয়পুর, ভারত

এখানকার ট্রাকের নকশায় ফুটে ওঠে চালকের পরিচয়, বিশ্বাস ও স্বপ্ন। তাই প্রায়ই দেখা যায়, গাড়ির গায়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা থাকে হর্ন বাজানোর অনুরোধ কিংবা কন্যাশিক্ষা প্রচারের বার্তা।
লাহোর, পাকিস্তান

দক্ষিণ এশিয়ায় অলঙ্করণ ও সাজসজ্জা যুগের পর যুগ ধরে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি শুধু যানবাহনেই নয়, বরং ঘরবাড়িতেও দেখা যায়। যেমন, আলপনার নকশা বা সূচ দিয়ে তৈরি কাঁথা। লাহোরের এই যানবাহনটি অসাধারণ একটি নকশার উদাহরণ।
কলম্বো, শ্রীলঙ্কা

চালকের জাতীয়তা ও সাংস্কৃতিক পটভূমি অনুযায়ী নকশার ধরণ ভিন্ন হয়। ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার কিছু অঞ্চলে ট্রাকের গায়ে বা পেছনের অংশে প্রায়ই আঁকা হয় শান্ত, মনোরম দৃশ্য। যেমন, ধান কাটছে কৃষক বা নারকেল গাছ ঘেরা নদীতীর।
কালিমাটি, নেপাল

এ অঞ্চলের কিছু যানবাহনের সাজসজ্জায় লোককাহিনি কিংবা গণমাধ্যম থেকে নেওয়া আবেগঘন দৃশ্য ফুটে ওঠে।
আটক, পাকিস্তান

এখানকার কিছু জেলায় মৌলবাদীরা ট্রাক থেকে মানুষ ও প্রাণীর ছবি সরিয়ে ফেলতে চালকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। এর ফলে শিল্পীরা এসব এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন, বন্ধ হয়েছে তাদের কর্মশালা। নিপীড়নের ভয় বা পণ্য লুট ও ক্ষতির আশঙ্কায় রঙিন অলঙ্কৃত ট্রাকের চালকেরা এসব এলাকা এড়িয়ে চলেন। যদিও মানুষ ও প্রাণীর ছবি ছাড়া বিমূর্ত বা অন্যান্য চিত্রযুক্ত ট্রাক এখনও এখানে দেখা যায়।
জোধপুর, ভারত

১৯৫০ থেকে ১৯৮০-এর দশকের মধ্যে যানবাহনের অলঙ্করণে বড় পরিবর্তন আসে। সে সময়ের নকশা অনুপ্রাণিত হয়েছিল ভারত ও পাকিস্তানের সিনেমার রঙিন বিলবোর্ড থেকে, যা আবার প্রভাবিত হয়েছিল ১৯৬০-এর দশকে পশ্চিম থেকে আসা পপ আর্ট ও সাইকেডেলিক আন্দোলনের দ্বারা। করাচির মিনি বাসে প্রথম এই ধরণের চিত্র আঁকা হয়, যা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে স্থানীয় ট্রাকগুলোতেও।
বাংলাদেশ

লোকশিল্প ও জনপ্রিয় ধারার সংমিশ্রণ এই শিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশের রিকশাশিল্পে প্রাচীন লোকশিল্পের ঐতিহ্য ও স্থানীয় নকশার সঙ্গে মিলেমিশে সৃষ্টি করেছে শহুরে লোকশিল্পের নতুন রূপ।
রাওয়ালপিন্ডি, পাকিস্তান

প্রতীক ও প্রতিকৃতির ব্যবহারে এখানে একই ধরনের ভিজ্যুয়াল ভাষা দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, পাকিস্তানের মুসলিম চালকেরা শিখ গুরু ও সাধুদের প্রতিকৃতি গ্রহণ করে সেগুলোকে নিজেদের সুফি সাধক ও বিশিষ্ট আলেমদের প্রতিকৃতিতে রূপান্তর করেন।
বাট্টারামুলা, শ্রীলঙ্কা

এ ধারার অধিকাংশ শিল্পীরই আনুষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা নেই। তারা একজন উস্তাদের (প্রবীণ শিল্পগুরু) অধীনে কাজের মধ্য দিয়ে শেখেন। কল্পনাশক্তি বিকাশে তারা আশপাশের পরিবেশ যেমন, পোস্টার, ছবির বই, ক্যালেন্ডার ইত্যাদি থেকে অনুপ্রেরণা নেন। এই উপকরণ থেকে গড়ে ওঠে নতুন ধারা, আর প্রতিষ্ঠিত নকশায় যুক্ত হয় নিজস্ব বৈচিত্র্য।
চিলাস, পাকিস্তান

এখানে রঙ, কবিতা ও প্রতীকের উজ্জ্বল সমাহার ছুটে চলে সড়কজুড়ে। এই জীবন্ত আর চলমান শিল্প আঁকাবাঁকা পাহাড়ি মোড় কিংবা দুর্গম কাদামাখা পথ অনায়াসে অতিক্রম করে। দেখে মনে হয়, যেন ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাণস্রোত বহন করছে।