সেনা সংকটে ইউক্রেন: মারধর ও জোর করে নিয়োগের অভিযোগ; বাড়ছে দেশ ছাড়ার ঘটনা

'যদি যুদ্ধ করতেই হয়, তবে আমি ইউক্রেনের জন্য যুদ্ধ করব না,' বলছিলেন পশ্চিম ইউক্রেনের জাকারপাতিয়া অঞ্চলের ২৯ বছর বয়সী আর্তেম (ছদ্মনাম)।
গত জুনের শেষ দিকে উঝহোরোদের একটি গির্জা থেকে রোববারের প্রার্থনা শেষে বের হওয়ার সময় তাকে আটক করে একটি 'কনস্ক্রিপশন প্যাট্রোল'। এতে ছিলেন তিন পুলিশ সদস্য ও দুই সেনা কর্মকর্তা।
আর্তেমের কাছে প্রমাণস্বরূপ নথি ছিল যে তিনি তার ৬৬ বছর বয়সী অসুস্থ ও প্রতিবন্ধী মায়ের একমাত্র অভিভাবক, ফলে তাকে সেনাবাহিনীতে নেওয়া যাবে না। তবু প্যাট্রোল দল তাকে আটক করে নিয়োগ কার্যালয়ে নিয়ে যায়।
সেখানে দুই কর্মকর্তা তাকে আলাদা কক্ষে নিয়ে গিয়ে মারধর করেন এবং স্বেচ্ছায় সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চাপ দেন বলে অভিযোগ করেন তিনি। রাজি না হলে তাকে বেঁধে চোখ বেঁধে ফেলা হয়।
আর্তেমের ভাষ্য, একইভাবে আরও চারজন অনিচ্ছুক ব্যক্তিকে আটক করে উঝহোরোদের বাইরে একটি জঙ্গলে নিয়ে যাওয়া হয়।
আর্তেমের দাবি, এক কর্মকর্তা বন্দুক তাক করে তাদের দৌড়াতে বলেন। পরে জানা যায়, সেটি ছিল স্লোভাক সীমান্তের একটি বেড়া।
অন্য এক কর্মকর্তা ওই দৃশ্য ভিডিও করেন এবং বলেন, তারা 'অবৈধভাবে সীমান্ত পেরোনোর চেষ্টা করছে'—যা ইউক্রেনে সর্বোচ্চ চার বছরের কারাদণ্ডযোগ্য অপরাধ। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, তারা চাইলে 'মুক্তির জন্য দরদামও করতে পারে'।
আর্তেমের ভাষ্য, তার পরিবার ২ হাজার ডলার দিয়ে তাকে মুক্ত করে এবং আরও ১৫ হাজার ডলার দিয়ে জাল অনুমতিপত্র সংগ্রহ করে, যাতে তিনি বিদেশে যেতে পারেন। ইউক্রেনে ২৫ থেকে ৬০ বছর বয়সী পুরুষদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
পূর্ব ইউরোপের একটি দেশ থেকে মেসেজিং অ্যাপে কথা বলার সময় আর্তেম অনুরোধ করেন, তার আসল নাম, ব্যক্তিগত তথ্য ও যে নিয়োগ কার্যালয়ে তাকে মারধর করা হয়েছিল বলে অভিযোগ, তার অবস্থান প্রকাশ না করতে।
আর্তেমের সব বক্তব্য স্বাধীনভাবে যাচাই করতে না পারলেও, তার কিছু অভিযোগ ইউক্রেনে জোরপূর্বক সেনা নিয়োগ ও দুর্নীতির অন্যান্য ঘটনার সঙ্গে মিলে যায়। রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ফ্রন্টলাইনে জনবল সংকটের মধ্যে এসব ঘটনা ঘটছে।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সেনা ও পুলিশ সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত 'কনস্ক্রিপশন প্যাট্রোলে'র বলপ্রয়োগের ঘটনায় ইউক্রেনের মানবাধিকার ওমবাডসম্যান কার্যালয়ে দুই হাজারের বেশি অভিযোগ জমা পড়ে।

এক ঘটনায়, চলতি বছরের জানুয়ারিতে মধ্যাঞ্চলের রিভনে অঞ্চলে এক সাইকেল আরোহী থামতে অস্বীকার করলে প্যাট্রোল কর্মকর্তারা তাকে গাড়ি দিয়ে ধাক্কা দেন। এরপর মারধর ও টিয়ারগ্যাস ছুড়ে তাকে নিয়োগ কার্যালয়ে নিয়ে গিয়ে 'অবৈধভাবে সেনাবাহিনীতে যুক্ত' করার চেষ্টা করা হয় বলে তদন্তকারীরা জানান। শেষ পর্যন্ত হামলার অভিযোগ এড়াতে ওই কর্মকর্তারা নিজেরাই ফ্রন্টলাইনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
গত ১ আগস্ট, মধ্যাঞ্চলের ভিনিৎসিয়া শহরে প্রায় ১০০ জনকে 'অবৈধভাবে আটক' করার অভিযোগে জনতা একটি নিয়োগ কার্যালয়ে হামলার চেষ্টা করলে পুলিশ টিয়ারগ্যাস ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে।
এদিকে, বিশেষ সুবিধাভোগী কিছু ব্যক্তি নিজেদের অবস্থান ব্যবহার করে সেনা নিয়োগ এড়াচ্ছেন।
২০২৪ সালের অক্টোবরে কয়েকজন সরকারি কৌঁসুলি জাল প্রতিবন্ধিতার সনদ সংগ্রহ করে—যার মাধ্যমে তারা বড় অঙ্কের 'পেনশন' পাওয়ারও যোগ্যতা অর্জন করেন—এমন ঘটনায় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি অ্যাটর্নি জেনারেলকে বরখাস্ত করেন।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ওলেহ দ্রুজকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি যে কোনো সেনা নিয়োগপ্রার্থীকে 'অযোগ্য' ঘোষণা করতে পারতেন। তার বিরুদ্ধে 'অবৈধ সম্পদ অর্জনের' অভিযোগ আনা হয়েছে, যা প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।
রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন শুরুর পর থেকে দ্রুজ একাধিক বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট, দুটি জমির খণ্ড, কয়েকটি বিএমডব্লিউ গাড়ি কিনেছেন এবং বাড়িতে ১ লাখ ৫২ হাজার ডলার ও ৩৪ হাজার ইউরো (প্রায় ৪০ হাজার ডলার) নগদ মজুত রেখেছিলেন বলে অভিযোগ আনা হয়েছে।
গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে সেনা নিয়োগ প্যাট্রোল দল ইউক্রেনজুড়ে জনসমক্ষে, মেট্রো স্টেশনে, নাইটক্লাবে, এমনকি বিয়ের অনুষ্ঠানে হানা দিয়ে ২৫ থেকে ৬০ বছর বয়সী পুরুষদের খুঁজে বেড়াচ্ছে—এমন অভিযোগ করেছেন দেশজুড়ে এক ডজনেরও বেশি প্রত্যক্ষদর্শী।
এ দলগুলো প্রায়ই নিজেদের নির্ধারিত এলাকার বাইরে অভিযান চালায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, অনেক সময় মোটা দেহের ইউনিফর্ম পরিহিত সদস্যদের নিয়ে গঠিত 'ভুয়া প্যাট্রোল' আটক করা ব্যক্তিদের ব্ল্যাকমেইল করে। মুক্তির বিনিময়ে কমপক্ষে ৪০০ ডলার দাবি করা হয়; না দিলে তাদের প্রকৃত সেনা নিয়োগ কার্যালয়ে তুলে দেওয়া হয়।
কিছু নিয়োগ কর্মকর্তা সাবেক সেনাসদস্য, যারা প্রায়ই পিটিএসডিতে ভোগেন এবং নিয়োগ এড়ানো ব্যক্তিদের প্রতি ঘৃণা পোষণ করেন। তাদের অপমান, নির্যাতন ও মারধরে দ্বিধা নেই বলেও জানান সাক্ষীরা।
ধারণা করা হয়, কয়েক লাখ পুরুষ আত্মগোপনে আছেন, যা কর্মক্ষেত্রে তীব্র সংকট তৈরি করেছে। দেশজুড়ে নির্মাণশ্রমিক, কৃষিশ্রমিক, রাঁধুনি ও ট্যাক্সিচালকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।
যাদের সেনা-সংক্রান্ত কাগজপত্র ঠিক আছে, তারা চলাফেরার সময় সঙ্গে একজন সাক্ষী রাখতেই পছন্দ করেন—যিনি প্রয়োজনে সেনা নিয়োগ প্যাট্রোলের সঙ্গে যেকোনো পরিস্থিতি ভিডিও করতে পারেন।
'আমি মায়ের সঙ্গে গাড়ি চালিয়ে যাতায়াত করি, কারণ যেখানে যাই সেখানেই অনেক চেকপোস্ট,' উঝহোরোদে বসবাসরত হাঙ্গেরীয় ট্যাক্সিচালক ফেরেঞ্জ।
এদিকে, ইউক্রেনীয় সমাজে বিভাজন বাড়ছে।
বর্তমান বা সাবেক ইউক্রেনীয় সেনাসদস্য এবং তাদের পরিবার ক্রমেই ক্ষুব্ধ হচ্ছেন, কীভাবে নিয়োগ এড়ানো ব্যক্তিরা যুদ্ধ থেকে বিরত থাকার পক্ষে যুক্তি দেন তা দেখে।
'আমি অনেক বান্ধবীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছি, কারণ তারা তাদের স্বামী বা প্রেমিকের যুদ্ধ না করার অধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়েছে,' হান্না কোভালেভা, যার স্বামী আলবার্ট ২০২২ সালে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যুদ্ধে যোগ দেন। 'এমন মনমানসিকতা জঘন্য—আমি আমার স্ত্রীর আঁচলের আড়ালে লুকাব, আর অন্য কেউ যুদ্ধে গিয়ে মরুক।'
১৭ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই দেশ ছাড়ছে বোহদান, তবে ভালো জীবনযাপনের খোঁজে নয়। কিয়েভে বাবা-মায়ের সঙ্গে তিন শোবার ঘরের অ্যাপার্টমেন্টে থাকে সে। বেসরকারি স্কুলে পড়ে এবং সপ্তাহান্ত কাটায় কান্ট্রি হাউসে।
কিন্তু তার বাবা-মা চান না, ভবিষ্যতে তাকে সেনাবাহিনীতে নেওয়া হোক।
'ফ্রন্টলাইনের এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে অফিসারের ভুলে নিজের সন্তানকে মরতে দিতে চান না কেউ,' তার বাবা দিমিত্রি।
আগামী ১ সেপ্টেম্বর বোহদান প্রাগের একটি স্কুলে পড়া শুরু করবে, যেখানে তার খালা থাকেন।
প্রেমিকাকে রেখে দেশ ছাড়তে হচ্ছে—তাও মাত্র সম্পর্কের শুরুতে—এতে ভীষণ ভেঙে পড়েছে বোহদান। তবে তার দাবি, আর কোনো উপায় নেই।
'জানি, আমার কথা খুব দেশদ্রোহী শোনাচ্ছে। কিন্তু আমি কোনো গর্তে পচে মরতে চাই না,' বলেন তিনি।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন কিয়েভকে সেনা নিয়োগের ন্যূনতম বয়স ২৫ থেকে কমিয়ে ১৮ করার আহ্বান জানায়—যা পূর্ববর্তী প্রশাসনও বলেছিল।
গত তিন বছরে ইউক্রেনীয় সেনাদের গড় বয়স ৪২ থেকে বেড়ে ৪৫ হওয়ায়, সেনাবাহিনীতে অভিজ্ঞতা থাকা অনেক ইউক্রেনীয়ই এ প্রস্তাবের পক্ষে মত দিয়েছেন।
বিকল্পভাবে, ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী পুরুষদের একটি 'শ্রম সেনা'তে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে—যা ড্রোন ও যুদ্ধ-সম্পর্কিত অন্যান্য সামগ্রী তৈরি করবে বলে মত দেন ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক উপপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইহোর রোমানেঙ্কো।
তার মতে, যুদ্ধোপযোগী সব পুরুষকে সেনা নিয়োগের আওতায় আনতে হবে এবং ইউক্রেনের অর্থনীতিকে এমনভাবে 'পুনর্গঠন' করতে হবে যাতে তা মূলত সেনাবাহিনীর চাহিদা মেটায়।
'অপ্রিয় হলেও যদি দেশে কৌশলগত সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন না হয়, পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। আমাদের হয়ে কোনো বিদেশি এসে লড়বে না,' বলেন রোমানেঙ্কো।