প্রিন্স অ্যান্ড্রুর জীবনী: যৌন অপরাধী এপস্টিনের সঙ্গে বন্ধুত্ব, নানা বিতর্কে রাজপরিবারে ফেরার পথ বন্ধ

আর অল্প কিছুদিন পরেই প্রকাশিত হবে যুক্তরাজ্যের প্রিন্স অ্যান্ড্রুকে নিয়ে লেখা জীবনী 'এন্টাইটলড: দ্য রাইজ অ্যান্ড ফল অব দ্য হাউস অব ইয়র্ক'। তবে প্রকাশের আগেই এই বইটি নানা বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
এতে প্রিন্স অ্যান্ড্রুর ব্যক্তিজীবনের বিতর্ক এবং আর্থিক কেলেঙ্কারির বিভিন্ন তথ্য উঠে এসেছে। পাশাপাশি রাজপরিবারের পুরনো সমস্যাগুলো, বিশেষ করে যৌন ও আর্থিক কেলেঙ্কারির বিষয়গুলো নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
বইটিতে প্রিন্স অ্যান্ড্রুকে একজন অহংকারী ও স্বার্থপর ব্যক্তি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের কুখ্যাত নারী নিপীড়ক জেফরি এপস্টিনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে সত্য আড়াল করার চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
গোপন তথ্য প্রকাশ করে বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের খ্যাতি বদলে দেওয়ার জন্য পরিচিত বইটির লেখক অ্যান্ড্রু লাউনি। এর আগে তিনি ডিউক অব উইন্ডসরদের সাথে নাৎসিদের সখ্যতা নিয়ে একটি বইও লিখেছিলেন।
বইটি আলোচনায় আসার পর থেকে প্রিন্স অ্যান্ড্রুর সুনাম ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং তা পুনরুদ্ধার করা এখন প্রায় অসম্ভব বলে মনে করছেন অনেকেই।

প্রায় ৪৫০ পৃষ্ঠার এই বই লিখতে সময় লেগেছে প্রায় চার বছর। লেখক শত শত সাক্ষাৎকারও নিয়েছেন। অনেকেই হয়তো এই বইয়ের অনেক গল্পই আগেই শুনেছেন, কিন্তু বইটিতে এমন ছোট ছোট নতুন তথ্য আছে, যা পাঠকদের আগ্রহ আরও বাড়িয়ে দেবে।
যেমন, কমেডিয়ান বিলি কনলি ও সঙ্গীতশিল্পী স্যার এলটন জন প্রিন্স অ্যান্ড্রুর বিয়ের আগের পার্টিতে ছিলেন। এছাড়া ফিল্ম নির্মাতা উডি অ্যালেন ম্যানহাটনের জেফরি এপস্টিনের বাড়িতে প্রিন্স অ্যান্ড্রুর সঙ্গে একই ডিনারে উপস্থিত ছিলেন।
এই তথ্য সাম্প্রতিক সময়ে নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি প্রতিবেদনের সঙ্গেও মেলে, যেখানে উডি অ্যালেনের লেখা এক জন্মদিনের শুভেচ্ছায় বলা হয়েছে, 'এপস্টিনের ডিনারে এমনকি রাজপরিবারের সদস্যরাও ছিলেন।'
বইটিতে প্রিন্স অ্যান্ড্রুর ব্যক্তিগত কিছু মজার ঘটনাও উঠে এসেছে। তবে তার অশোভন আচরণ এবং স্ব-সচেতনতার তীব্র অভাবের নানা কাহিনী বইয়ে বেশি স্থান পেয়েছে।
বলা হয়, তিনি প্রায়ই কর্মচারীদের গালাগাল করতেন। একবার এক কর্মচারীকে 'মূর্খ' বলে ডেকে তিরস্কার করেছিলেন, কারণ তিনি রানী এলিজাবেথের পুরো উপাধি ব্যবহার করেননি। গলফ খেলায় তার গলফ বল তুলতে নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের পাঠানো হতো। আর ব্যক্তিগত জেট ব্যবহার করাকে তিনি রাতে উবার গাড়ি ভাড়া করার মতোই স্বাভাবিক মনে করতেন।
প্যারিসভিত্তিক সাংবাদিক পিটার অ্যালেন, যিনি বইটির একজন সূত্র, বলছেন, 'অ্যান্ড্রুর সমস্যাগুলো তার ত্রুটিপূর্ণ চরিত্র থেকেই আসে।'
তিনি বলেন, 'জীবনের প্রতিটি মুহূর্তেই তাকে নানা রকম সুবিধা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তিনি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিজের দুর্বল বিচারবুদ্ধি দেখিয়েছেন এবং বিভিন্ন সংকটজনক পরিস্থিতিতে জড়িয়ে পড়েছেন।'
শৈশবে 'বেবি গ্রাম্পলিং' নামে পরিচিত প্রিন্স অ্যান্ড্রু একবার একজনকে মানুষকে চাকরি থেকে সরিয়েছেন শুধু নাইলন টাই পরার কারণে, আরেকজনকে মুখে তিল থাকার জন্য!
তার বিভিন্ন ভুলের জন্য কূটনীতিকরা মজা করে তাকে 'হিজ বাফুন হাইনেস' উপাধি দিয়েছিলেন।

বইটিতে তার অর্থ উপার্জনের কাজে বিভিন্ন বিতর্কিত মানুষের সঙ্গে জড়ানোর দিকগুলোও উঠে এসেছে—লিবিয়ার অস্ত্র পাচারকারী, সন্ত্রাসীদের আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে একজন চীনা গুপ্তচর পর্যন্ত।
রাজপরামর্শক পলিন ম্যাকলারান মন্তব্য করেন, 'যদি অ্যান্ড্রু পুনরায় আনুষ্ঠানিকভাবে কর্মরত রাজপরিবারের সদস্য হওয়ার আশা করেন, তাহলে এই বইটি সেই আশা ভেঙে দিয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'এখন জনসাধারণের মধ্যে রাজপরিবারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট কোনো পদক্ষেপ দেখার আকাঙ্ক্ষা থাকবে—বিশেষ করে যখন অ্যান্ড্রুর এপস্টেইনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরায় আলোচনায় আসছে।'
বইয়ে এমনও ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, তিনি প্রায়শই একাকী ও বিচ্ছিন্ন ছিলেন, যৌনতার প্রতি আসক্ত কিন্তু সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুর্বল। নৌবাহিনীতে তার সহকর্মীরা তার আচরণকে একটি অসহায় এবং সামাজিকভাবে অনাড়ম্বর ব্যক্তিত্বের আড়ালে থাকা দুর্বলতা হিসেবে দেখতেন, যিনি শৈশবে পাওয়া শিক্ষা ও পরিবেশের কারণে মানুষ হিসেবে কিভাবে আচরণ করতে হয় তা শেখেননি।
যৌনতা নিয়ে তার আগ্রহের প্রসঙ্গে, এক সূত্র জানায়, অ্যান্ড্রু মাত্র ১১ বছর বয়সে নিজের কুমারিত্ব হারিয়েছিলেন, যা ওই সূত্র ধর্ষণের সাথে তুলনা করেছেন।
প্রিন্স অ্যান্ড্রুর একজন প্রাক্তন নৌসৈনিক সহকর্মী তাকে শুরুতে 'অপরিণত, সুবিধাভোগী' একজন হিসেবে দেখলেও, পরে তার চরিত্রকে 'একাকীত্ব ও অনিশ্চয়তায় ভরা' একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে সহানুভূতির সঙ্গে দেখেন, যিনি সাধারণ মানুষদের সঙ্গে মিশতে না পেরে শেষ পর্যন্ত 'ভুল বন্ধুদের' সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন।
এই তালিকার শীর্ষে অবশ্য আছেন জেফরিএপস্টিন। লাউনির বই প্রিন্স অ্যান্ড্রু ও এপস্টিনের সম্পর্কের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেছে।
বইটির দাবি অনুযায়ী, এপস্টিনের আর্থিক লোভ আর শোষণমূলক যৌন সম্পর্কের জগতটি আসলে এক ধরনের 'ব্ল্যাকমেইল অপারেশনে'র মতো, যা তাকে অনেক ক্ষমতাধর ব্যক্তির ওপর চাপ প্রয়োগ করার সুযোগ দিয়েছে।
বইটি এপস্টাইনের নিপীড়নে রভয়াবহ মাত্রা এবং তার পরের ধ্বংসযজ্ঞের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
লন্ডনে প্রিন্স অ্যান্ড্রু, ভার্জিনিয়া জিওফ্রি ও ঘিসলেইন ম্যাক্সওয়েলের সঙ্গে তোলা বিখ্যাত ছবি জেফরি এপস্টিনের নিজের তোলা। এদের মধ্যে প্রিন্স অ্যান্ড্রুইই একমাত্র যিনি এখনও জীবিত এবং কারাগারে নেই।
জেফ্রি এপস্টিন ও প্রিন্স অ্যান্ড্রুর বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তোলা ভার্জিনিয়া জিওফ্রি আত্মহত্যা করেছিলেন।

অন্যদিকে, লাউনির সূত্র সন্দেহ প্রকাশ করেছে যে এপস্টিন সত্যিই আত্মহত্যা করেছেন কিনা। তারা তার চিকিৎসা প্রতিবেদন ও কারাগারে তত্ত্বাবধানে থাকা সময়ে ঘটে যাওয়া নানা ত্রুটির বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
বিবিসির 'নিউজনাইট' অনুষ্ঠানে বিতর্কিত সাক্ষাৎকার ও ভার্জিনিয়া গিউফ্রের বিরুদ্ধে আদালতের মামলার পর প্রিন্স অ্যান্ড্রুকে জনজীবন থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি আর 'কর্মরত রাজপরিবারের' সদস্য নন।
ইতিহাসবিদ এড ওয়েন্স বলেন, ওই নিউজনাইট সাক্ষাৎকারের ছয় বছর পার হলেও প্রিন্স অ্যান্ড্রুর নাম এখনও বিভিন্ন খবরের শিরোনামে উঠে আসছে, তবে 'সব ভুল কারণে'।
বইটি ইতিমধ্যেই বেস্টসেলার তালিকায় শীর্ষে উঠে এসেছে। রাজপরিবার বিষয়ক বিশ্লেষক রিচার্ড পামার বলেন, এটি সময়োপযোগী কঠিন প্রশ্নও উত্থাপন করেছে।
পামারের ভাষ্য, 'ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন জেফরি এপস্টিনের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি, ঠিক তখনই এই বই প্রিন্স অ্যান্ড্রুকে আবার সেই কেলেঙ্কারির কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে।'
তিনি আরও বলেন, 'এটি এমন এক কেলেঙ্কারি যা রাজপরিবার থেকে যতই নিজেকে আলাদা করার চেষ্টা করা হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত মুছে দেয়া যায়নি।'