২০ দিনে কার্যকর হবে ট্রাম্পের ৫০% শুল্ক, এড়াতে যেসব বিকল্প আছে ভারতের

ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়ার ওপর চাপ বাড়াতে হঠাৎ করেই ভারতকে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তু হিসেবে চিহ্নিত করেছে ওয়াশিংটন। খবর বিবিসি'র।
বুধবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের ওপর আরোপিত শুল্ক দ্বিগুণ করে ২৫ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ করেছেন। ভারত রাশিয়া থেকে তেল কেনার কারণে এই শাস্তিমূলক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, যা ভারত 'অন্যায়' এবং 'অযৌক্তিক' বলে অভিহিত করেছে।
এই নতুন শুল্কের উদ্দেশ্য রাশিয়ার তেলের রপ্তানি থেকে আয় কমিয়ে দেওয়া এবং প্রেসিডেন্ট পুতিনকে যুদ্ধবিরতির পথে ঠেলে দেওয়া। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামী ২১ দিনের মধ্যে অর্থাৎ ২৭ আগস্ট থেকে শুল্ক কার্যকর হবে।
এর ফলে ভারত এখন এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি শুল্কের আওতায় পড়া মার্কিন বাণিজ্য অংশীদার। একইসঙ্গে ব্রাজিলকেও একই ধরনের কড়াকড়ির মুখোমুখি হতে হচ্ছে, যাদের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক বর্তমানে বেশ উত্তপ্ত।
ভারত বলছে, তাদের আমদানি নির্ভরতা মূলত দেশটির বাজার চাহিদা ও জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই। তবে নতুন শুল্কের কারণে ভারতের রপ্তানি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বড় ধাক্কা খেতে পারে।
প্রতি বছর ভারত যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৮৬.৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। এই পণ্যের ওপর এত উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ বাণিজ্যের দিক থেকে একে অলাভজনক করে তুলতে পারে।
ভারতের অধিকাংশ রপ্তানিকারকই বলছেন, ১০ থেকে ১৫ শতাংশ শুল্ক বাড়লে তা মেনে নেওয়া সম্ভব; কিন্তু ৫০ শতাংশ শুল্ক বহন একেবারেই অসম্ভব।
জাপানের বিনিয়োগ ব্যাংক নোমুরা জানিয়েছে, এই শুল্ক কার্যকর হলে তা কার্যত এক ধরনের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার মতো কাজ করবে। এর ফলে ভারতীয় পণ্যের সরবরাহ হঠাৎ থমকে যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে ভারতের সবচেয়ে বড় রপ্তানি গন্তব্য। ভারতের মোট রপ্তানির ১৮ শতাংশ এবং জিডিপির ২.২ শতাংশ আয় আসে এ মার্কেট থেকেই।
২৫ শতাংশ বাড়তি শুল্ক ভারতের জিডিপি ০.২ থেকে ০.৪ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে। এতে দেশের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের নিচে নেমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
সিঙ্গাপুরভিত্তিক গবেষণা সংস্থা এশিয়া ডিকোড-এর বিশ্লেষক প্রিয়াঙ্কা কিশোর বিবিসিকে বলেন, ভারতের ইলেকট্রনিক্স ও ওষুধ রপ্তানি আপাতত অতিরিক্ত শুল্কের বাইরে থাকলেও দেশীয় অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে শ্রমনির্ভর খাত—যেমন পোশাকশিল্প, রত্ন ও গয়না রপ্তানি—বড় ধাক্কা খেতে পারে।
ভারতের টেক্সটাইল খাতের শীর্ষ সংগঠন 'কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি'র রাকেশ মেহরা বলেন, এই শুল্ক ভারতের পোশাক খাতের জন্য 'বিশাল ধাক্কা' হিসেবে এসেছে। এতে মার্কিন বাজারে ভারতের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

চলমান উত্তেজনার মধ্যে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্ত একপ্রকার বড় জুয়া খেলা। কারণ, ভারতই একমাত্র রাশিয়ার তেলগ্রাহক নয়—চীন ও তুরস্কও রুশ তেল কিনছে। তবুও ওয়াশিংটনের লক্ষ্যবস্তু মূলত ভারত, যাকে এখনও মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে—এই হঠাৎ পরিবর্তনের পেছনে কারণ কী? আর এর পরিণতি কী হতে পারে?
ভারতের সাবেক রিজার্ভ ব্যাংক গভর্নর উর্জিত প্যাটেল বলেছেন, ট্রাম্পের ঘোষণার মাধ্যমে ভারতের 'সবচেয়ে ভয়ংকর আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে'। লিংকডইনে এক পোস্টে তিনি লেখেন, 'আশা করি এটি স্বল্পমেয়াদি হবে এবং চলতি মাসে যে বাণিজ্য আলোচনা এগিয়ে নেওয়ার কথা ছিল, তা অব্যাহত থাকবে। তা না হলে এক অনাবশ্যক বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হবে, যার গতিপথ এখনই বলা কঠিন।'
বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন, এই শুল্ক দীর্ঘস্থায়ী হবে না, কারণ এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রও বাণিজ্যিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ২৭ আগস্ট থেকে নতুন শুল্ক কার্যকর হবে, তাই পরবর্তী ২০ দিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ের মধ্যে ভারতের প্রতিক্রিয়ার দিকে বিশ্ববাজারের নজর থাকবে।
মূল প্রশ্ন এখন—প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার কি যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য সীমিত করবে, নাকি ওয়াশিংটনের সঙ্গে টক্করে যাবে?
লন্ডনভিত্তিক চ্যাথাম হাউসের গবেষক ড. চিতিজ বাজপেয়ী বলছেন, ভারত আগেই রুশ অস্ত্রের ওপর নির্ভরতা কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে এবং জ্বালানি আমদানির উৎসে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টাও করছে। তাই ট্রাম্প প্রশাসনের চাপ ছাড়াই দিল্লি কিছু সমঝোতার বার্তা দিতে পারে, যা তাদের বর্তমান পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
তার মতে, রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এখন 'পরিকল্পিত দুর্বলতার' দিকে এগোচ্ছে। স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী যুগে যেটি কৌশলগত গুরুত্ব হারাচ্ছে। তারপরও অদূর ভবিষ্যতে রাশিয়া ভারতের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে থেকে যাবে।
তবে কিছু বিশ্লেষকের মতে, সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ভারতের জন্য কৌশলগত সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ তৈরি করেছে।
দিল্লিভিত্তিক থিংকট্যাংক গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ (জিটিআরআই)-এর অজয় শ্রীবাস্তব বলেছেন, 'যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ ভারতকে কৌশলগত অবস্থান পুনর্বিবেচনায় বাধ্য করতে পারে। এর ফলে রাশিয়া ও চীনের মতো দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হতে পারে।'
এদিকে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শিগগিরই চীন সফরে যাচ্ছেন। তিনি সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেবেন। ২০২০ সালের গালওয়ান সীমান্ত সংঘর্ষের পর এটি হবে তার প্রথম চীন সফর। অনেকেই মনে করছেন, এ সফর ঘিরে ভারত-রাশিয়া-চীন ত্রিপাক্ষিক আলোচনা ফের শুরু হওয়ার সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে।
তবে এখন নজর আগামী আগস্টের বাণিজ্য আলোচনার দিকে। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিনিধি দল ভারত সফর করবে। যদিও এর আগের আলোচনায় কৃষি ও ডেইরি খাতে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র ওই খাতে আরও বাজার চাইলেও, ভারত ছিল কঠোর অবস্থানে।
প্রশ্ন উঠছে—এইবার কি ভারত এসব স্পর্শকাতর খাতে ছাড় দেবে, নাকি রাজনৈতিক মূল্য এত বেশি যে আপসের কোনো সুযোগ নেই?
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো—চীনের ওপর নির্ভরতা কমাতে আগ্রহী যেসব দেশ ও বহুজাতিক কোম্পানি ভারতকে বিকল্প গন্তব্য হিসেবে বিবেচনা করছে, সেই আকর্ষণ কি বজায় থাকবে?

বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্রাম্পের এই নতুন শুল্ক আরোপে সেই গতি কিছুটা শ্লথ হতে পারে। কারণ ভিয়েতনামের মতো দেশ তুলনামূলক কম শুল্ক সুবিধা দিচ্ছে। তবু বিনিয়োগকারীদের মানসিকতায় বড় ধাক্কা লাগবে না বলেই তারা মনে করেন।
এখনও ভারত অ্যাপলের মতো বড় কোম্পানিগুলোর মন জয়ের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অ্যাপল ইতিমধ্যে ভারতে মোবাইল উৎপাদন বাড়িয়েছে। তাছাড়া, নতুন শুল্কে সেমিকন্ডাক্টরের মতো পণ্য এর আওতায় না পড়ায় কিছুটা সুরক্ষা পাবে ভারত।
বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টি এখন ভারতের সম্ভাব্য রপ্তানি সহায়তা প্যাকেজের দিকে।
নোমুরা বলছে, 'ভারত সরকার এখন পর্যন্ত রপ্তানিকারকদের সরাসরি ভর্তুকি দিতে রাজি নয়। তবে বর্তমান যে সহায়তামূলক বাণিজ্য ঋণ ও রপ্তানি প্রণোদনা চালু রয়েছে, তা যুক্তরাষ্ট্রের এত বড় শুল্ক ব্যবধান সামাল দিতে যথেষ্ট নাও হতে পারে।'
পরিস্থিতি এখন অত্যন্ত জটিল। বাণিজ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, কয়েক সপ্তাহ আগেও যে বাণিজ্য চুক্তি হাতের নাগালে মনে হচ্ছিল, তা পুনরুজ্জীবিত করতে হলে এখন উচ্চপর্যায়ের কূটনৈতিক উদ্যোগ প্রয়োজন।
ভারত সরকার আপাতত দৃঢ় অবস্থানে আছে। তারা বলেছে, 'জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপই নেওয়া হবে।'
এদিকে, বিরোধী দল কংগ্রেস এই ইস্যুতে কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। দলের শীর্ষ নেতা রাহুল গান্ধী ট্রাম্পের ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপকে 'অর্থনৈতিক ব্ল্যাকমেইল' এবং 'ভারতকে একপাক্ষিক ও অন্যায্য চুক্তিতে বাধ্য করার চেষ্টা' বলে মন্তব্য করেছেন।
এখন বড় প্রশ্ন হচ্ছে—মোদি সরকারের যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বহুলপ্রচারিত 'মেগা অংশীদারিত্ব' কি তার সবচেয়ে বড় পররাষ্ট্রনীতির চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে? আর ভারত কি এর পাল্টা জবাব দেবে?
বার্কলেস রিসার্চ বলছে, ভারতের পক্ষ থেকে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার সম্ভাবনা কম, তবে তা একেবারেই অস্বাভাবিক হবে না। অতীতে এমন উদাহরণ রয়েছে।
বার্কলেস এক গবেষণা নোটে বলেছে, '২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামে শুল্ক আরোপের জবাবে ভারত ২৮টি মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক বসায়—এর মধ্যে ছিল অ্যাপল ও বাদাম। পরে ২০২৩ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বিরোধ নিষ্পত্তির পর কিছু শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়।'