গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পেরিয়ে গেলেও অবহেলিত, শিল্পকর্ম সংরক্ষণের প্রচেষ্টায় শিল্পকলা একাডেমি

ঢাকার শীর্ষ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান শিল্পকলা একাডেমির বারান্দায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো সাঁজোয়া যান। গত মে মাসে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চারুকলা বিভাগের নিচতলায় গ্যালারিগুলো দখল করে শুয়ে আছেন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা। ভাস্কর্য উদ্যানের ব্রোঞ্জ ও প্রস্তরের শিল্পকর্মগুলোও পড়ে রয়েছে অযত্নে।
এ চিত্র নতুন নয়। গত বছরের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময় থেকেই একাডেমি চত্বরে সেনা অবস্থান শুরু হয়। ওই বছরে যখন রাজধানীজুড়ে কোটা বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেনা মোতায়েনের নির্দেশ দেন। এরপর থেকেই শিল্পকলা একাডেমিকে সামরিক ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
গণঅভ্যুত্থান ও শেখ হাসিনা সরকারের পতনের এক বছর পার হলেও শিল্পকলা একাডেমি চত্বর এখনো সেনাবাহিনীর দখলে।
একই ভবনে সেনাসদস্যদের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন একাডেমির কর্মীরা, শিল্পী এবং জাদুঘরের রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত কর্মকর্তারা—যারা দেশের শিল্পাঙ্গন পুনরুজ্জীবনের দায়িত্বে রয়েছেন।
অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিবেশের মাঝেই তারা আবিষ্কার করছেন বিশ শতকের বহু অজানা শিল্পকর্মের একের পর এক দুর্লভ ভাণ্ডার।
তৎকালীন পরিচালক মোস্তাফা জামান শিল্পকলা একাডেমির বেজমেন্টের সংগ্রহশালা ঘুরিয়ে দেখান। এক কক্ষে ট্রলিতে রাখা অনন্য ও কম পরিচিত বৈশ্বিক আধুনিকতাবাদের কিছু চিত্রকর্ম প্রদর্শন করেন।

সেখানে মুর্তজা বশীরের কিছু বিমূর্ত চিত্রকর্ম ছিল, যিনি ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের আগমুহূর্তে উত্তাল ঢাকা শহরের রাজনৈতিক আবহে শিল্পীসত্তার বিকাশ ঘটান।
আরও দেখা যায় এসএম সুলতানের কিছু বিশালাকৃতির ক্যানভাস—যার বিবর্ণ রঙে ফুটে উঠেছে বাংলার গ্রামীণ জীবনের প্রতীকধর্মী ও শৈল্পিক রূপ।
সবশেষে ছিল জয়নুল আবেদিনের একাধিক সাদা-কালো কালি-আঁকা চিত্রকর্ম—যেগুলো ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের দুর্দশা তুলে ধরে।
তবে আবিষ্কৃত এসব শিল্পকর্মের অবস্থা ছিল ভয়াবহ। কখনো প্রদর্শিত না হওয়ায় বহু গুরুত্বপূর্ণ চিত্র দীর্ঘদিন ধরে অবহেলায় ম্লান হয়ে গেছে সরকারি সংগ্রহশালার গুদামে।
চলচ্চিত্র নির্মাতা ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীপর বলেন, 'আমাদের শিল্পগুরুদের কাজগুলো শুধু গুদামে ফেলে রাখা হয়েছে, কারণ আমাদের সংস্কৃতিমন্ত্রীরা কখনো জানতেন না তাদের কাজ কী—তারা কখনোই গুরুত্ব দেননি। তারা জানতেন না কীভাবে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও রক্ষা করতে হয়।'
মোস্তাফা জামান একমত পোষণ করেন: 'এই লোকগুলো শুধু জাতীয় নেতাকে খুশি করতেই ব্যস্ত ছিল।'
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা তার ১৫ বছরের শাসনামলে পরিবারকেন্দ্রিক ব্যক্তিপূজার একটি সংস্কৃতি গড়ে তোলেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে শেখ মুজিবুর রহমান—স্বাধীনতার স্থপতি ও হাসিনার পিতা—এর ভাস্কর্য ও বিলবোর্ড তৈরিতে শত শত কোটি টাকা ব্যয় হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

এই সময়ে চারুকলা খাত বছরের পর বছর বাজেট বঞ্চনার শিকার হয়, জানান জামান। আরেকটি গুদাম ঘরে দেখা যায় শেখ হাসিনা ও তার আত্মীয়দের পরিত্যক্ত কিছু প্রতিকৃতি—ধুলোমাখা অবস্থায় পড়ে আছে, যেন পতন ঘটেছে কোনো স্বৈরশাসকের 'টেরাকোটা বাহিনী'র।
অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় জাদুঘরের পরিচালনা পর্ষদের দায়িত্ব দিয়েছে স্থপতি মারিনা তাবাসসুমকে। 'আমরা তাকে একটি পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছি সংস্কার পরিকল্পনা তৈরি করার জন্য,' বলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী ফারুকী, যিনি আগামী এপ্রিলের নির্বাচনের আগ পর্যন্ত দায়িত্বে থাকবেন। 'এটি বাস্তবায়নে বছর লেগে গেলেও, আমাদের পর যে-ই ক্ষমতায় আসুক, তাকে এই কাজ শেষ করতেই হবে।'
তাবাসসুম এর আগে গঙ্গা বদ্বীপের দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চলে জরুরি আবাসন তৈরির মতো একাধিক সামাজিক সচেতন প্রকল্পে কাজ করেছেন। চলতি বছর তিনি লন্ডনের কেনসিংটন গার্ডেনে 'সারপেন্টাইন প্যাভিলিয়ন' ডিজাইন করেন, যেখানে তিনি বাংলার ঐতিহ্যবাহী ছাউনির অনুপ্রেরণা ব্যবহার করেন।
বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তনের কথা জানান তিনি। 'আমাদের প্রধান লক্ষ্য হলো—শিল্প কর্মগুলো কীভাবে সংরক্ষিত হচ্ছে, তা দেখা,' বলেন তাবাসসুম। 'আমাদের জাদুঘরে এত সমৃদ্ধ সংগ্রহ রয়েছে, অথচ এগুলো জনসাধারণের চোখের আড়ালে—৯০ শতাংশই সংরক্ষণে রাখা।'
এই শিল্পকর্মগুলো স্থায়ী প্রদর্শনীর আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে তার। তবে সে পথে এগোতে হলে আগে সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, বলেন তিনি।
এটা এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। সরকারের মালিকানাধীন চিত্রকর্মের কোনো পূর্ণাঙ্গ তালিকা আজও তৈরি হয়নি। নেই কোনো পেশাদার সংরক্ষণ ব্যবস্থাও। বাংলাদেশের শিল্পসংগ্রাহক দুর্জয় রহমান বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, 'এই চিত্রগুলোর আদৌ অস্তিত্বে আছে তো? নাকি হারিয়ে গেছে, কিংবা একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে?'
বেশ কয়েকজন শিল্পকর্ম সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি জানান, দীর্ঘদিন ধরে ঢাকার আর্দ্র পরিবেশে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই সংরক্ষিত এসব কাজের অনেকগুলো হয়তো এখন আর উদ্ধারযোগ্য নয়—এতটাই ক্ষয়প্রাপ্ত।
অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পের চাহিদা বাড়ছে বলে জানান সথেবিস নিউ ইয়র্ক-এর ভারত ও দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান মঞ্জরী সিহারে-সুতিন। তিনি বলেন, 'বাংলাদেশি আধুনিক শিল্পের বাজারে এখন গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে।'

গত বছর সথেবিস নিলামে জয়নুল আবেদিনের একটি কালি-আঁকা একটি শিল্পকর্ম বিক্রি হয় পাঁচ লাখ পাউন্ডেরওবেশি দামে—শিল্পকলা একাডেমিতে দেখা সেই একই সিরিজের একটি কাজ। গত কয়েক বছরে তার একাধিক চিত্রকর্ম ছয় অঙ্কের দামে বিক্রি হয়েছে।
এ ধরনের উচ্চমূল্য হয়তো ঢাকার ধূলিধূসরিত গুদামঘরগুলোর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিতে পারে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী শিল্পী জয়নুল আবেদিনের জন্ম ১৯১৪ সালে, ঢাকার কাছাকাছি। তার সবচেয়ে খ্যাতনামা কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে ১৯৪৩ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষ নিয়ে আঁকা কালি-চিত্র—যেখানে তিনি প্রতিদিন কর্মস্থলে যাওয়ার পথে দেখা অনাহারগ্রস্ত মানুষের ছবি একেছেন।
ভারতভাগের পর ১৯৪৭ সালে তিনি ঢাকায় যে চারুকলা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন, তা নানা আন্তর্জাতিক প্রভাব গ্রহণ করে—যার মধ্যে ছিল কিউবিজম-প্রভাবিত সমাজবাস্তবতা, উদীয়মান বিমূর্ত অভিব্যক্তিবাদ এবং জাপানি ছাপচিত্রকলার ছায়া।
আজ বাংলাদেশি ব্যাংকনোটেও স্থান পেয়েছে আবেদিনের শিল্পকর্ম। অথচ ঢাকায় জনসাধারণের সামনে তার চিত্র মাত্র একটি কক্ষে প্রদর্শিত হয়। সমাজসচেতন এই শিল্পভাষা সাবেক প্রধানমন্ত্রী হাসিনার জাতীয়তাবাদী ও বংশকেন্দ্রিক রাজনৈতিক বর্ণনার সঙ্গে সহজে মেলে না।
'আমরা সবসময় আশঙ্কা করতাম, আমার বাবার কাজ নিয়ে ওনার দৃষ্টিভঙ্গি কী,' বলেন জয়নুল আবেদিনের পুত্র মঈনুল আবেদিন, যিনি এখনও তার বাবার পুরনো বাড়িতে বসবাস করেন—যার দেয়ালজুড়ে টাঙানো রয়েছে অর্ধশতাব্দী আগের ক্যানভাস।
তাবাসসুম বলেন, অবশেষে আধুনিক শিল্প প্রদর্শনের পক্ষে রাজনৈতিক সদিচ্ছা তৈরি হওয়ায় তার কাজ এখন কিছুটা সহজ হয়েছে। তবে এই সদিচ্ছা কতদিন টিকবে, তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না।
সরকারি দপ্তরের দেয়ালে এখনো দেখা যায় বিবর্ণ দাগ—যেখানে এক সময় ঝুলত শেখ হাসিনা ও তার পিতার প্রতিকৃতি, গত বছরের গণবিক্ষোভে যেগুলো সরিয়ে ফেলা হয়।
তবু দৃঢ় অবস্থানে রয়েছেন তাবাসসুম। তার কথায়, 'এটা আমাদের পরিচয়, আর হারিয়ে যাওয়ার আগেই আমাদের এটাকে সংরক্ষণ করতে হবে।'