ট্রাম্পের শুল্কে বড় ধরনের ধাক্কা আসবে ভারতের রপ্তানি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্কারোপের ঘোষণা দিয়েছেন, যা দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও রপ্তানি সম্ভাবনার ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা। খবর বিবিসির।
ট্রাম্পের ঘোষণায় আরও একটি অনির্ধারিত 'জরিমানার' কথাও উল্লেখ করা হয়েছে, যা এই ২৫ শতাংশ শুল্কের অতিরিক্ত—এর ফলে প্রভাব কতটা গভীর হবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়।
নিজের সামাজিক মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে দেওয়া এক পোস্টে ট্রাম্প জানিয়েছেন, আগামী ১ আগস্ট থেকে এই শুল্ক ও জরিমানা কার্যকর হবে, কারণ ভারত "রাশিয়া থেকে তেল ও অস্ত্র কিনছে এমন এক সময়ে, যখন বিশ্ব চায় রাশিয়া যেন ইউক্রেনে 'হত্যা বন্ধ' করে।"
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই জরিমানার বিস্তারিত জানা ছাড়া প্রকৃত অর্থনৈতিক প্রভাব নির্ধারণ করা এই মুহূর্তে বেশ কঠিন।
শুল্কে ভারতের প্রবৃদ্ধিতে হোঁচট
ঋণমান যাচাইকারী সংস্থা– ইক্রার প্রধান অর্থনীতিবিদ অদিতি নায়ার বলেন, "যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে শুল্ক ও জরিমানা আরোপ করেছে, তা আমাদের আগের অনুমানের চেয়েও বেশি, এবং এটি নিঃসন্দেহে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করবে। এর প্রকৃত মাত্রা নির্ভর করবে কতটা জরিমানা আরোপ করা হয় তার ওপর।"
ইক্রা এরই মধ্যে চলতি অর্থবছরের জন্য ভারতের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ৬.৫% থেকে কমিয়ে ৬.২% করেছে।
আন্তর্জাতিক ব্রোকারেজ সংস্থা–নোমুরা জানিয়েছে, এই শুল্ক ভারতের প্রবৃদ্ধির জন্য "নেতিবাচক" এবং এর ফলে ভারতের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি প্রায় ০.২% কমে যেতে পারে।
ট্রাম্পের এমন ঘোষণার পর ভারতের শেয়ারবাজারেও নেতিবাচক প্রভাব দেখা দেয়। দিনের শুরুতেই সূচক পড়ে যায়।
"পুঁজিবাজারে ধারণা ছিল যে, যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের কৌশলগত সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে একটি শুল্ক চুক্তি হবে," বলেন ফান্ড ম্যানেজার নিলেশ শাহ।
ভারতের জন্য নতুন চাপ তৈরি করলো রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক
যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত গত কয়েক মাসে বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে দফায় দফায় আলোচনা করেছে। ভারত যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করতে বার্বন হুইস্কি ও মোটরসাইকেলের ওপর শুল্কও কমায়। তবে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটতি ৪৫ বিলিয়ন ডলার, যা ট্রাম্প কমিয়ে আনতে চান।
কিন্তু, এজন্য ২৫ শতাংশ শুল্কের সঙ্গে অতিরিক্ত জরিমানা দিতে হলে, তা ভারতকে ভিয়েতনাম ও চীনের মতো অন্যান্য এশীয় অর্থনীতির তুলনায় পিছিয়ে দেবে বলে মন্তব্য করেছেন ফাউন্ডেশন ফর ইকোনমিক ডেভেলপমেন্টের রাহুল আহলুওয়ালিয়া। তাঁর মতে, "এই দেশগুলোর সঙ্গে আমরা বিনিয়োগ ও শিল্পায়নের প্রতিযোগিতায় আছি।"
উল্লেখযোগ্যভাবে, চীনের ক্ষেত্রে মার্কিন শুল্ক হার ১৪৫ শতাংশ থেকে কমে ৩০ শতাংশ হয়েছে জেনেভা ও লন্ডনে হওয়া দ্বিপাক্ষিক আলোচনার পর। ভিয়েতনামের সঙ্গে ট্রাম্প জুলাইয়ের শুরুতে ২০ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপের বিষয়ে সম্মতি দিয়েছেন, যেখানে আগে ৪৬ শতাংশ হারে শুল্কারোপের প্রস্তাব ছিল।
ফলে এখন ভারতের পোশাক, ফার্মা, চামড়া, সামুদ্রিক পণ্য ও গাড়িশিল্পে আমেরিকার বাজার ধরার সম্ভাবনা ঝুঁকিতে পড়েছে।
()
বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ, দেশে বিরোধীদের তোপ
ইওয়াই ইন্ডিয়ার বাণিজ্যনীতি বিশেষজ্ঞ অগ্নেশ্বর সেন বলেন, "যদি এই শুল্ক বহাল থাকে, তবে এতে উল্লেখযোগ্যভাবে ভারতের রপ্তানি-নির্ভর শিল্প খাতে আঘাত আসবে।"
এই ঘোষণায় ভারতের ব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারক মহলে ব্যাপক উদ্বেগ ও হতাশা তৈরি হয়েছে।
ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি হর্ষবর্ধন আগারওয়াল বলেন, "এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক সিদ্ধান্ত, যার সুস্পষ্ট প্রভাব আমাদের রপ্তানিতে পড়বে। আমরা আশা করি (প্রথমে) এটি অস্থায়ী, এবং তারপর দ্রুত একটি স্থায়ী বাণিজ্য চুক্তি হবে।"
ভারতীয় রপ্তানিকারকদের সংগঠনের প্রধান ড. অজয় সাহাই বলেন, "২৫ শতাংশ শুল্ক বৃদ্ধির ফলে ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে নতুন করে দরদাম হবে। রপ্তানিকারকরা কতটা শুল্ক নিজে বহন করবেন, তা এখন আলোচনার বিষয়।"
শুল্ক মূলত আমদানিকৃত পণ্যের ওপর আরোপিত কর। এতে পণ্যের মূল্য বাড়ে, ফলে মার্কিন ক্রেতাদের চাহিদা কমে যায়। এতে ভারতীয় রপ্তানিকারকদের দাম কমাতে হয় এবং মুনাফার মার্জিন কমে যায়।
ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা ট্রাম্পের ঘোষণার "প্রভাব বিশ্লেষণ করছে।"
এদিকে নয়াদিল্লি জানিয়েছে, তারা পারস্পরিক সুবিধাসম্পন্ন চুক্তিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকলেও কৃষক, উদ্যোক্তা ও ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পের কল্যাণের প্রশ্নে আপস করবে না—যা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৃষিপণ্য ও দুগ্ধ খাতের মতো রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর খাতে আলোচনার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র তার কৃষিপণ্যের জন্যও প্রবেশাধিকার চাইছে ভারতের বাজারে।
এই ইস্যুতে ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছে।
এক্স (সাবেক টুইটার)-এ দেওয়া পোস্টে কংগ্রেস বলেছে, "প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৯ সালে ট্রাম্পের পক্ষে নির্বাচনি প্রচার করেছিলেন, তাঁকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। আর ট্রাম্প এখন ভারতের ওপর এমন নিষ্ঠুর শুল্ক বসালেন—এটা পররাষ্ট্রনীতির চরম ব্যর্থতা।"
রাশিয়া ইস্যু চুক্তিকে জটিল করে তুলেছে
এই পরিস্থিতিতে মার্ক লিনস্কট, যিনি ইউএস ইন্ডিয়া স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ ফোরামের সঙ্গে যুক্ত এবং একজন সাবেক মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি, বলেন—"রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে বাণিজ্যচুক্তির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে ট্রাম্প আসলে পুরো আলোচনাই জটিল করে তুলেছেন।"
তিনি আরও বলেন, "ট্রাম্প প্রতিটি চুক্তিতে তাঁর ব্যক্তিগত ছাপ রাখতে চান। ভারতের ক্ষেত্রেও জ্বালানি ও সামরিক খাতে ক্রয়-প্রতিশ্রুতি, বা যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগসহ—মোদিকে সরাসরি যুক্ত হয়ে আলোচনার শেষধাপ পরিচালনা করতে হতো। সেটা করা হয়নি।"
যদিও ট্রাম্প তাঁর সিদ্ধান্ত ঘোষণার সময় ভারতকে "ভালো বন্ধু" বলেছেন, তবে সেখানে ভারতের উচ্চ শুল্ক হারের সমালোচনাও করেছেন।
বৃহস্পতিবার ট্রুথ সোশ্যালে ট্রাম্প লিখেছেন, "ভারত রাশিয়ার সঙ্গে কী করছে, তাতে কিছু যায় আসে না। তারা চাইলে একসাথে ডুবুক, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমরা ভারতের সঙ্গে খুব সামান্য বাণিজ্য করি—ওদের শুল্ক বিশ্বের মধ্যে অন্যতম উচ্চ।"
চূড়ান্ত চুক্তির আশা টিকে আছে
তবে উত্তেজনা সত্ত্বেও আগস্ট মাসজুড়ে আলোচনা চলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মার্কিন একটি প্রতিনিধি দল আগামী মাসে ভারত সফর করবে বলেও জানানো হয়েছে।
উভয় দেশই চূড়ান্ত চুক্তি করার লক্ষ্য ঠিক করেছে। আগস্টে আরও আলোচনার সম্ভাবনায় অনেকেই আশা করছেন, শুল্ক কমিয়ে আনা হবে এবং ২৫ শতাংশ হারটা সাময়িকই থাকবে।
তবে সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতিতেও শুল্ক হার ১৫-২০ শতাংশের রেঞ্জে থাকবে বলে ধারণা করছে নোমুরা—যা ভারতের আলোচনার অগ্রগতির প্রেক্ষাপটে হতাশাজনক।
নোমুরা আরও বলেছে, ভারতের অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে বেশি অভ্যন্তরীণ চাহিদাভিত্তিক এবং পণ্য রপ্তানিতে কম নির্ভরশীল হলেও, ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের কারণে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) সুদহার কমাতে পারে, যাতে প্রবৃদ্ধির ওপর প্রভাব ঠেকানো যায়।