অ্যাপল যেখানে ব্যর্থ সেখানেই নিজের নাম লেখালো চীনের শাওমি

২০১০ সালে শাওমি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী লেই জুন একের পর এক চমক দেখিয়ে যাচ্ছেন। আজ থেকে এক দশক আগে, মাত্র ২৪ ঘণ্টায় অনলাইনে ২১ লাখ স্মার্টফোন বিক্রি করে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড গড়েছিলেন তিনি। তবে এখন আর কেবল সস্তা ফোন নয়, গত মাসেই শাওমির তৈরি প্রথম ইলেকট্রিক এসইউভি 'ওয়াইইউ ৭' বাজারে আসার তিন মিনিটের মধ্যেই বিক্রি হয়েছে দুই লাখের বেশি গাড়ি।
গত কয়েক বছরে শাওমির উত্থান রীতিমতো চোখ ধাঁধানো। এখন বিশ্বের স্মার্টফোন বাজারে অ্যাপল ও স্যামসাংয়ের পরেই শাওমির অবস্থান। শুধু ফোন নয়, ফোন-সংযুক্ত অসংখ্য পণ্য যেমন এয়ার কন্ডিশনার, রোবট ভ্যাকুয়াম, স্কুটার, টেলিভিশন সবই পাওয়া যাচ্ছে শাওমির ব্যানারে। ২০২২ সালে চীনের ভোক্তা প্রযুক্তি বাজারে 'হাড়ভাঙা প্রতিযোগিতা'র কারণে কিছুটা পিছিয়ে পড়লেও, গত বছর শাওমি আবার ঘুরে দাঁড়ায়। রাজস্ব বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। ২০২৪ সালের শুরু থেকে এর শেয়ারমূল্য প্রায় চার গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১.৫ ট্রিলিয়ন হংকং ডলার (১৯০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)।
ইভি (ইলেকট্রিক ভেহিকেল) বা ইলেকট্রিক গাড়ির বাজারেও শাওমি এখন আলোচনায়। মার্চ ২০২৩ সালে প্রথম স্পোর্টস সেডান 'এসইউ ৭' বাজারে আনার পর এবার দ্বিতীয় মডেল 'ওয়াইইউ৭' এনেছে তারা। আর এখানেই অ্যাপলের চেয়ে এগিয়ে গেছে শাওমি। অ্যাপল এক দশক ধরে বিপুল বিনিয়োগ করেও নিজস্ব ইভি বাজারে আনতে না পেরে শেষ পর্যন্ত সেই পরিকল্পনা বাতিল করতে বাধ্য হয়। অথচ শাওমি মাত্র ২০২১ সালে গাড়ি তৈরির ঘোষণা দিয়ে গত ১৫ মাসেই ৩ লাখের বেশি গাড়ি চীনের রাস্তায় নামিয়ে ফেলেছে। বর্তমানে যেসব অর্ডার আছে, সেগুলো পূরণ করতেই এক বছরের বেশি সময় লাগবে বলেও জানিয়েছে তারা।
যদিও শাওমির গাড়ি বিভাগ এখনো খুব বেশি লাভে যেতে পারেনি, তবে লেই জুন আশা প্রকাশ করেছেন চলতি বছরের মধ্যেই এটি লাভজনক হয়ে উঠবে। চীনের মতো প্রতিযোগিতামূলক গাড়ি বাজারে এটি যে কোনো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের জন্যই বিশাল সাফল্য।
শাওমির এখন লক্ষ্য বিশ্বব্যাপী আধিপত্য। আগামী কয়েক বছরে তারা বিদেশে ১০ হাজার শপ খুলতে চায়, যা গত বছর ছিল কয়েকশোর মতো। এই দোকানগুলোতে তারা শুধু স্মার্টফোন বা ইলেকট্রনিক্স নয়, নতুন ডিজাইনের গাড়িও নিয়ে আসবে।
শাওমির ইলেকট্রিক গাড়িতে সফলতার কারণের একটা বড় অংশ হলো সঠিক সময়ে সঠিক কাজ। আজকের চীনে যাদের গাড়ি তৈরি করার অভিজ্ঞতা সবচেয়ে বেশি লেই জুন দেশের সেসব শীর্ষ দক্ষজনদের কাজে নিয়োগ দিয়েছেন। যন্ত্রাংশ ও মেশিনের দামও কমে গেছে, কারণ সাপ্লাই বেশি। এবং ফ্যাক্টরি অনুমোদন ও নির্মাণ চীনে অনেক দ্রুত হয়ে যায়।
তবে লেই জুনের নিজস্ব কৃতিত্বও কম নয়। অনেকেই মনে করেন, অ্যাপলের টিম কুকের মতো শুধু ব্যবস্থাপনায় না থেকে, তিনি নিজেই গাড়ি প্রজেক্টের পুরো নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়েছিলেন। এই সফলতার জন্য কোম্পানির কাজের ধরন বদলানো প্রয়োজন ছিল। শাওমির আগে নিজস্ব কারখানা ছিল না; অ্যাপলের মতো তারা ফোন ও অন্যান্য ডিভাইসের উৎপাদন বাইরে করাত। কিন্তু এবার তারা বেইজিংয়ে নিজেদের কারখানা বানিয়েছে। একই নীতিতে তারা বাকি ব্যবসায়ও এগিয়ে নিচ্ছে—গত বছর বেইজিংয়ে নিজেদের স্মার্টফোন কারখানা চালু করেছে এবং উহানে একটি নতুন কারখানা তৈরি করছে, যেখানে এয়ার কন্ডিশনার তৈরি হবে।
লেই জুনের বিশাল ফ্যান ফলোয়ার থাকাও শাওমির মার্কেটিংকে শক্তিশালী করেছে। যেমন স্টিভ জবসের প্রতি ভালোবাসা অ্যাপলকে প্রথমদিকে আইফোন বিক্রিতে সাহায্য করেছিল, তেমনি চীনের লেই জুনেরও রয়েছে একইরকম অনুসারী। এই অনুসারীরা 'এমআই ফ্যানস' নামে পরিচিত, যারা শাওমির সব পণ্যে আগ্রহ দেখায়।
মার্চে একটি ভয়াবহ দুর্ঘটনায় তিনজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র 'এসইউ ৭' গাড়ি চালানোর সময় মারা যায়। সেসময় শাওমির সুরক্ষা মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। শেয়ারের দামও সাময়িকভাবে কমেছিল। কিন্তু এর পরও, তিন মাস পর নতুন 'ওয়াইইউ ৭' গাড়ি বাজারে আনার সময় বিক্রির আগ্রহ কমতে দেখা যায়নি।

শাওমির বিশাল গ্রাহক ভিত্তি আছে, যাদের কাছে নতুন পণ্য বিক্রি করা অনেক সহজ। গত বছরের শেষে তারা জানিয়েছিল, বিশ্বজুড়ে তাদের ৭০০ মিলিয়ন মাসিক ব্যবহারকারী আছে, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১০% বেশি। এদের মধ্যে অনেকেই শাওমির অ্যাপ স্টোর থেকে গেমস কেনেন এবং কোম্পানির বিজ্ঞাপন দেখেন। ব্যবহারকারীদের একটা বড় অংশ সরাসরি শাওমির অ্যাপ থেকে পণ্য কেনেন। কোম্পানি অনেক আগে থেকেই তাদের গ্রাহকদের দামি ফোন কেনার জন্য প্রভাবিত করতে সক্ষম। এই গ্রাহকদের মাত্র সামান্য শতাংশ গ্রাহক যদি গাড়ি কিনে, তাতেই বড় সাফল্য হবে শাওমির জন্য। যারা দশ বছর আগে শাওমির প্রথম স্মার্টফোনগুলো কিনেছিল, তাদের বয়স এখন ৩৫-এর কাছাকাছি, আর এরা শাওমির গাড়ির মূল লক্ষ্য গ্রাহক।
লেই জুন শুধু চীনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নন। স্মার্টফোন ও অন্যান্য ডিভাইস থেকে প্রাপ্ত আয় প্রায় অর্ধেকই আসে বিদেশ থেকে, বিশেষ করে ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশ ও ইন্দোনেশিয়া থেকে। ২০২৭ সালের মধ্যে বিদেশে ইলেক্ট্রনিক যানবাহন বিক্রি শুরু করার পরিকল্পনা শাওমির। তবে বিদেশে শাওমির প্রতি মানুষের এতটা ভালোবাসা বা পরিচিতি নেই, তাই সেখানকার বাজার সহজ হবে না। এ কারণেই তারা বিদেশে হাজার হাজার শোরুম খোলার জন্য বড় বিনিয়োগ করছে, যা ব্র্যান্ডের পরিচিতি বাড়াতে সাহায্য করবে।
একই সঙ্গে শাওমি নতুন নতুন ব্যবসার ক্ষেত্রেও প্রবেশ করতে চায়। তারা তৈরি করেছে নিজস্ব হিউম্যানয়েড রোবট 'সাইবারওয়ান', আর মে মাসে তারা তাদের নিজস্ব উন্নত তিন-ন্যানোমিটার চিপ উন্মোচন করেছে। মোট কর্মীর অর্ধেকই গবেষণা ও উন্নয়নে কাজ করে, আর গত বছর এই খাতে ব্যয় বেড়েছে ২৬%। এটি ৩.৪ বিলিয়ন ডলার যা কোম্পানির নেট লাভের থেকেও বেশি। নতুন প্রযুক্তি নিজের থেকে তৈরি করলে খরচ কমানো যায় ও প্রতিযোগীদের থেকে এগিয়ে থাকা সম্ভব হয়-এই ধারণা থেকেই তারা কাজ করে থাকে।
শাওমির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো অনেক জায়গায় একসঙ্গে লড়াই করা। চীনের ইলেক্ট্রিক গাড়ির কোম্পানিগুলোর মধ্যে দাম কমানোর প্রতিযোগিতা তীব্র হচ্ছে, আর শাওমি এখনও ছোটখাটো খেলোয়াড় মাত্র। এখন মাসে প্রায় ২০ হাজার গাড়ি বিক্রি করে, যেখানে বাজারে শীর্ষে থাকা বিওয়াইডি এর বিক্রি তার দশ গুণেরও বেশি। স্মার্টফোন ক্ষেত্রেও প্রতিযোগিতা বেড়েছে। চীনা কোম্পানি হুয়াওয়ে ২০১৯ সালে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, ধীরে ধীরে তারা আবার ফিরে এসেছে। তবে, লেই জুনের বিক্রয় দক্ষতা কখনো ছোট করে দেখা সম্ভব নয়, এখন পরিবর্তন শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র। ■
অনুবাদ : নাফিসা ইসলাম মেঘা