খুন না মস্তিষ্কবিকৃতি: এডগার অ্যালান পো-র মৃত্যু আসলে হয়েছিল কীভাবে?
'এডগার অ্যালান পো মারা গেছেন'—ঘোষণা করল নিউ-ইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউন। 'এই খবর অনেকেই চমকে উঠবেন, তবে দুঃখ পাওয়ার লোক খুব কমই থাকবে।'
মাত্র ৪০ বছর বয়সে, ১৮৪৯ সালের ৭ অক্টোবর বাল্টিমোর শহরে প্রাণ হারান এই কবি ও লেখক। 'দ্য র্যাভেন'-এর মতো ভুতুড়ে রহস্যগল্প ও কবিতা খ্যাতি এনে দিয়েছিল তাকে।
মৃত্যুর আগেই মহান আমেরিকান লেখক হিসেবে পো-র খ্যাতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার নাটকীয় মৃত্যু ঘিরে রয়ে গেছে অপার রহস্যের কুয়াশা। মৃত্যুকালে কেন কবির পরনে অন্যের পোশাক ছিল? নিউ ইয়র্কের লেখক তখন বাল্টিমোরে কী করছিলেন? আর মৃত্যু-পূর্ব যে প্রলাপ আর বিভ্রমের (হ্যালুসিনেশন) মধ্যে তিনি ডুবে যাচ্ছিলেন, তার কারণই বা কী?
'ব্যাপারটা খুবই কৌতূহলোদ্দীপক,' বলেন ফ্রস্টবার্গ স্টেট ইউনিভার্সিটির ইংরেজির অধ্যাপক এবং পো স্টাডিজ অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যামি ব্রানাম আর্মিয়েন্তো।
কিন্তু এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে বিস্ময়, হতাশা আর নানা তত্ত্বের জন্ম দিলেও পো-র মৃত্যুরহস্য আজও অমীমাংসিত।
পো-র মৃত্যু সম্পর্কে আমরা যা জানি
পো-র জীবনের শেষ দিনগুলোর বিবরণ বেশ অস্পষ্ট। তখন কবি নিউইয়র্কে থাকতেন, জীবনে চলছিল দীর্ঘ এক ব্যক্তিগত আর আর্থিক টানাপোড়েনের শেষ পর্ব। ১৮৪২ সালে দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার পরেও তিনি নগদ অর্থসংকটে ছিলেন তিনি। ১৮৪৭ সালে স্ত্রী ভার্জিনিয়া যক্ষ্মায় মারা যাবার পর কবি আরও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। জীবনের শেষ বছরটায় পো-র আচরণ ক্রমশ হয়ে ওঠে বেপরোয়া ও সন্দেহবাতিকগ্রস্ত।
তার বন্ধু জন সার্টেইন পরে স্মরণ করেছিলেন, ১৮৪৯ সালের জুলাই মাসে হঠাৎ একদিন পো এসে হাজির হন তার কাছে—'ফ্যাকাশে, শীর্ণ চেহারা; চোখে ছিল উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি।' কবি তখন স্পষ্টতই হ্যালুসিনেশনে ভুগছিলেন। বারবার বলছিলেন, কেউ তাকে মেরে ফেলতে চাইছে। পরিচয় গোপন রাখার জন্য তিনি বন্ধু সার্টেইনকে অনুরোধ করেছিলেন তার গোঁফ কেটে দিতে।
তবে ১৮৪৯ সালের শরৎ নাগাদ পরিস্থিতি ভালোর দিকে যাচ্ছিল। পো একটি নতুন ম্যাগাজিন থেকে বেশ ভালো অঙ্কের টাকা পান। এছাড়া আবারও সম্পর্কে জড়ান পুরনো প্রেমিকা, সম্পদশালী বিধবা এলমিরা শেল্টনের সঙ্গে।
কিন্তু এরপরই ৩ অক্টোবরের রাতে, পো হাজির হন বাল্টিমোরের 'গানারস হল'-এ। এই পানশালা তখন ভোটকেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হতো।
আর্মিয়েন্তো বলেন, 'তিনি বাল্টিমোরে কেন গিয়েছিলেন, তা আমরা জানি না।' লেখক রিচমন্ড থেকে নিউইয়র্ক যাচ্ছিলেন এবং সম্ভবত মাঝপথে থেমেই সেখানে গিয়েছিলেন।
সেদিন ছিল ভোটের রাত, তাই পানশালাটি ছিল লোকে লোকারণ্য। সেই সন্ধ্যায়ই, আরেকটু পরে, একটা চিরকুট পেলেন জোসেফ ইভান্স স্নডগ্রাস। ওই চিরকুটে তাকে গানারস হলে এসে তার বন্ধু পো-কে সাহায্য করার অনুরোধ করা হয়েছে। ওই চিঠিতে পো সম্পর্কে লেখা ছিল: 'একজন ভদ্রলোক, যার অবস্থা বেশ খারাপ…তাকে অত্যন্ত দুর্দশাগ্রস্ত মনে হচ্ছে।'
স্নডগ্রাস এসে হতবাক হয়ে যান। পো তখন প্রায় সংজ্ঞাহীন, গায়ে অন্য কারও পোশাক। আর তার চেহারায় ছিল 'এমন এক ফাঁকা, নির্বোধ চাহনি যা দেখে আমি শিউরে উঠেছিলাম'। স্নডগ্রাস অবশেষে তাকে স্থানীয় এক হাসপাতালে নিয়ে যান।
সেখানে কবির কাঁপুনি ও প্রলাপ শুরু হয়। তিনি বারবার 'রেনল্ডস' নামে এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে ডাকছিলেন। তিন দিন পর ওয়াশিংটন কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। এক পর্যায়ে পো তার চিকিৎসককে অনুরোধ করেছিলেন, যেন তার কষ্টের অবসান ঘটানো হয়। চিকিৎসক মৃত্যুর কারণ হিসেবে 'ডিলিরিয়াম ট্রেমেন্স' (অ্যালকোহলজনিত প্রলাপ) উল্লেখ করেন। কিন্তু কোনো ময়নাতদন্ত হয়নি, আর তার কোনো ডেথ সার্টিফিকেটও টিকে নেই। একটি স্থানীয় পত্রিকা মৃত্যুর কারণ লিখেছিল, 'মস্তিষ্কে রক্তজমাট'।
পো-র মৃত্যু কি অ্যালকোহল বা মাদকাসক্তির কারণে হয়েছিল?
পো অ্যালকোহল সহ্য করতে পারতেন না। সামান্য পরিমাণে মদ পান করলেই তিনি ভয়ানক মাতাল হয়ে যেতেন। অনেক বন্ধু ও পরিচিতজনের ধারণা ছিল, পো-র মৃত্যু এবং মৃত্যুর আগে তার অসংলগ্ন আচরণের পেছনে মদ্যপানের ভূমিকা ছিল।
কিন্তু আধুনিক ইতিহাসবিদরা এই ধারণার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তাদের মতে, মদ্যপানের সময় পো-র হ্যালুসিনেশন ও অন্যান্য অস্বাভাবিক আচরণ অ্যালকোহলিজম বা মাদকাসক্তির সঙ্গে ঠিক মেলে না। কবি মদ পান করতেন ঠিকই, কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে একফোঁটা মদ পান না করেও থাকতেন না। তাছাড়া মৃত্যুর সময় তিনি মদবিরোধিতার সোচ্চার সমর্থক ছিলেন। মৃত্যুর কদিন আগে পো একটি স্থানীয় মদপান নিবারণী সমিতিতেও যোগ দিয়েছিলেন। ওই সংগঠনের হয়ে মদ্যপানের বিরোধিতায় কয়েকটি সফল বক্তৃতাও দিয়েছিলেন।
পো-র এই মদবিরোধী বন্ধু-পরিচিতরাই সম্ভবত তার মৃত্যুর জন্য মদ্যপানকে দায়ী করে ঘটনাটিকে অতিরঞ্জিত করেছিলেন। আবার এমনও হতে পারে, পো-র প্রতিদ্বন্দ্বীরা ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে 'মদ্যপ' বলে কলঙ্কিত করতে চেয়েছিলেন। একটি মদবিরোধী সংবাদপত্র দাবি করেছিল, পো তার প্রতিজ্ঞা ভেঙে মদ্যপানে লিপ্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন—কিন্তু এ তত্ত্ব কখনও প্রমাণিত হয়নি। তিনি আফিমের মতো মাদক ব্যবহার করতেন, এমন কোনো প্রমাণও নেই।
পো-কে কি 'কুপ' করে বা পিটিয়ে মারা হয়েছিল?
আরেকটি তত্ত্ব হচ্ছে 'কুপিং' (cooping)। এটি ছিল এমন এক প্রক্রিয়া, যেখানে কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্যরা কোনো ভোটারকে অপহরণ করে ভিন্ন ভিন্ন নাম ও পরিচয়ে জাল ভোট দিতে বাধ্য করত। পো-র মৃত্যুর এক দশকেরও বেশি সময় পর তার ভক্ত ও বাল্টিমোরের বাসিন্দা হ্যান্ড ব্রাউন লেখকের জীবনীকারকে বলেছিলেন, 'এখানকার মানুষের বিশ্বাস, পো ওরকমই কোনো গ্যাংয়ের হাতে ধরা পড়েছিলেন... তাকে "কুপ" করে মদ খাইয়ে মাতাল করে দেওয়া হয়, তারপর টেনেহিঁচড়ে বের করে ভোট দেওয়ানো হয়। শেষে মরার জন্য রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া হয়।'
এ তত্ত্বটি পো-র অদ্ভুত পোশাকের রহস্যেরও ব্যাখ্যা দেয়—সেদিন পরনের এলোমেলো, জীর্ণ পোশাক তার পরিপাটি রুচির একেবারেই বিপরীত ছিল। আর সে সময় বাল্টিমোরে ভোট জালিয়াতি ছিল খুব সাধারণ ঘটনা।
অথবা এমনও হতে পারে যে, বাল্টিমোরে যাওয়ার পথে পো কোথাও আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন, যার কারণে তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে সেকেলে 'মস্তিষ্কে রক্তজমাট' বাঁধা বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। এই রোগ নির্ণয়টি তিরিক্ষি মেজাজ থেকে শুরু করে মাথাব্যথা, মস্তিষ্কের আঘাত বা খিঁচুনি পর্যন্ত যেকোনো কিছু নির্দেশ করতে পারে।
পো-কে কি বিষ দিয়ে মারা হয়েছিল?
অন্যান্য তত্ত্বের মতে, পো-কে বিষ দেওয়া হয়েছিল—হয় ওষুধের মাধ্যমে, অথবা গ্যাসবাতির কার্বন মনোক্সাইড কিংবা অন্য কোনো বিষের মাধ্যমে। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান এসব দাবির প্রায় সবটাই খারিজ করে দিয়েছে।
পো-র দেহাবশেষ বেশ কয়েকবার কবর থেকে তোলা হয়েছিল। ২০০০ সালের দিকে গবেষকরা পো আর তার স্ত্রী ভার্জিনিয়ার চুলের নমুনা বিশ্লেষণ করেন। পো-র চুলে আর্সেনিক, সিসা, পারদ, নিকেল ও ইউরেনিয়ামের পরিমাণ আধুনিক মাত্রার তুলনায় কিছুটা বেশি পাওয়া গেলেও কোনোটাই এত বেশি ছিল না যা থেকে বোঝা যায় তাকে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছিল।
রোগ, বিষণ্ণতা এবং অন্যান্য আরও তত্ত্ব
কেউ কেউ পো-র মৃত্যুকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে মনে করেন। ইতিহাসবিদ জন ইভাঞ্জেলিস্ট ওয়ালশ তার 'মিডনাইট ড্রিয়ারি' বইয়ে দাবি করেছেন, এলমিরা শেল্টনের ভাইয়েরা তাদের ধনী বোনের সঙ্গে পো-র বিয়ের পরিকল্পনায় ক্ষুব্ধ ছিলেন। তারা কবিকে রিচমন্ড থেকে বের করে দেন, তাকে হেয় করার জন্য অতিরিক্ত মদ পান করান। শেষমেশ মদ্যপানজনিত বিষক্রিয়ায় কবির মৃত্যু হয়।
আধুনিক অন্যান্য তত্ত্বগুলোর মধ্যে রয়েছে জলাতঙ্ক, মেনিনজাইটিস, এমনকি ব্রেন টিউমারও। টিউমারের তত্ত্বটি এসেছে একজন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে—যিনি বলেছিলেন, পো-র দেহাবশেষ কবর থেকে তোলার সময় তার প্রায়-খালি খুলির ভেতরে পচন না ধরা একটি বড় মাংসপিণ্ড দৃশ্যত নড়াচড়া করছিল। (যেহেতু মস্তিষ্ক শরীরের প্রথম পচনশীল অঙ্গগুলোর একটি, তাই লেখক ম্যাথিউ পার্ল বিশ্বাস করেন, এটি আসলে ক্যালসিফায়েড টিউমার ছিল।)
তবে আরেকটি সাধারণ ব্যাখ্যা সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য। আর্মিয়েন্তো বলেন, অধিকাংশ পো-বিশেষজ্ঞ সবচেয়ে সম্ভাব্য কারণ হিসেবে মনে করেন, কবির মৃত্যু হয়েছিল যক্ষ্মার কারণে, যা দীর্ঘদিন ধরে তার শরীরে বাসা বেঁধে ছিল এবং দুর্বল অবস্থায় পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতায় সেটি আরও গুরুতর হয়ে ওঠে। পো-র স্ত্রী ভার্জিনিয়াও যক্ষ্মায় মারা যান। পো নিজেও জীবদ্দশায় বহুবার এই রোগের সংস্পর্শে আসেন।
কিন্তু এই বিষণ্ণ কবিকে মৃত্যুর দিকে যা-ই ঠেলে দিক না কেন, পো কেন মারা গিয়েছিলেন তার কোনো অকাট্য প্রমাণ নেই। 'আমরা কখনোই জানতে পারব না,' বলেন আর্মিয়েন্তো।
আর্মিয়েন্তো বলেন, নিয়তির নির্মম পরিহাস, পো-র মৃত্যুকে ঘিরে থাকা রহস্যই সম্ভবত তার উত্তরকালীন খ্যাতি বা কিংবদন্তির পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে।
ভয়ের গল্পের এই পথিকৃতের অদ্ভুত মৃত্যু সম্ভবত ভবিষ্যতেও গবেষক ও বিজ্ঞানীদের আগ্রহী করে তুলবে। এখনও যেহেতু স্পষ্ট কোনো তথ্য নেই, তাই ভবিষ্যতেও এ রহস্যের সমাধান খুঁজতে সবাই আগ্রহী থাকবেন। 'আমরা পো-কে নিয়ে নিজস্ব কল্পনা গড়ে তুলি, তাকে যেভাবে চাই—সেভাবেই দেখতে চাই,' বলেন আর্মিয়েন্তো।
