'মানবিক শহর' ফিলিস্তিনিদের জন্য কনসেনট্রেশন ক্যাম্প হবে: সাবেক ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী

ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট দ্য গার্ডিয়ান-কে বলেছেন, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী যেভাবে রাফার ধ্বংসাবশেষের ওপর একটি "মানবিক শহর" গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েছেন, তা আসলে একটি "কনসেনট্রেশন ক্যাম্প" হবে, এবং সেখানে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক পাঠানো মানেই জাতিগত নিধন।
২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ওলমার্ট বলেন, গাজা ও পশ্চিম তীরে ইসরায়েল ইতোমধ্যে যুদ্ধাপরাধ করছে, আর এই ধরনের শিবির নির্মাণ হলে তা হবে সেই অপরাধের আরও বড় পর্ব।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজের গত সপ্তাহের ঘোষিত পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "এটি একটি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প, দুঃখিত।"
বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী সোমবার সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় কাটজ বলেন, তিনি রাফাহ শহরের ধ্বংসাবশেষের উপর একটি "মানবিক শহর" গড়ে তুলতে চান, যেখানে প্রাথমিকভাবে প্রায় ৬ লাখ ফিলিস্তিনি থাকবে। পরে পুরো ২১ লাখ মানুষের গাজা জনগোষ্ঠীকেই সেখানে রাখা হবে।
তিনি বলেন, ভেতরে প্রবেশের আগে নিরাপত্তা যাচাই করে নিশ্চিত হতে হবে যে তারা হামাসের সাথে যুক্ত নয়। একবার ভেতরে ঢুকলে তাদের বাইরে যেতে দেওয়া হবে না।
তিনি আরও জানান, যদি পরিস্থিতি অনুকূল হয়, তাহলে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যে ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতির আলোচনা চলছে, সেই সময়েই শিবিরের নির্মাণকাজ শুরু হতে পারে।
এ নিয়ে ওলমার্ট বলেন, "যদি ফিলিস্তিনিদের জোর করে নতুন ওই মানবিক শহরে পাঠানো হয়, তাহলে একে জাতিগত নিধনের অংশ হিসেবেই ব্যাখ্যা করা যাবে। যদিও এখনো তা বাস্তবায়িত হয়নি।"
কয়েক লাখ মানুষকে নিয়ে এমন একটি শিবির গড়ে তোলার চেষ্টা করা হলে, তা "অবশ্যই জাতিগত নিধনের উদ্দেশ্য" বলেই ধরা হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ওলমার্ট মনে করেন না যে ইসরায়েলের চলমান অভিযান জাতিগত নিধনের শামিল। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় যুদ্ধ থেকে রক্ষা করতে বেসামরিকদের সরিয়ে নেওয়া বৈধ। এবং যেখানে সামরিক অভিযান শেষ হয়েছে, সেখানে ফিলিস্তিনিরা ফিরে গিয়েছেন।
"মানবিক শহর" প্রকল্পটির পেছনে রয়েছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তবে এই প্রকল্পের জন্য যে এলাকায় শরণার্থী শিবির গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছেন ইসরায়েলি মন্ত্রী কাটজ, সেই অঞ্চল থেকে ইসরায়েলের সরে না যাওয়ার সিদ্ধান্তই যুদ্ধবিরতির আলোচনায় অন্যতম বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে।
ওলমার্ট বলেন, কয়েক মাস ধরে চলা সহিংস বক্তব্য—যার মধ্যে গাজা "পরিষ্কার করে ফেলার" আহ্বান এবং সেখানে ইসরায়েলি বসতি গঠনের পরিকল্পনাও রয়েছে—এসবের পর সরকারের "মানবিক শহর" প্রকল্প ফিলিস্তিনিদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য বলে যে দাবি করা হচ্ছে, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
আরও পড়ুন: গাজাবাসীদের রাফার শিবিরে স্থানান্তরের পরিকল্পনা ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রীর
এহুদ ওলমার্ট বলেছেন, "যখন তারা এমন একটি শিবির গড়তে চায়, যেখানে গাজার অর্ধেকেরও বেশি এলাকা 'পরিষ্কার' করার পরিকল্পনা রয়েছে, তখন এটাকে 'ফিলিস্তিনিদের রক্ষার কৌশল' বলা যায় না। এর প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো তাদের তাড়িয়ে দেওয়া, বের করে দেওয়া, ছুঁড়ে ফেলা। আমি অন্তত এর অন্য কোনো ব্যাখ্যা দেখি না।"
ইসরায়েলের মানবাধিকার আইনজীবী ও গবেষকেরা এই পরিকল্পনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের ছক বলে বর্ণনা করেছেন। কেউ কেউ সতর্ক করে দিয়েছেন—বিশেষ কিছু শর্ত পূরণ হলে এটি গণহত্যার পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে।
তবে যেসব ইসরায়েলি নাগরিক "মানবিক শহর" পরিকল্পনাকে নাৎসি জার্মানির কনসেনট্রেশন ক্যাম্প-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন, তাদের সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের দাবি, এই শিবির ফিলিস্তিনিদের রক্ষার উদ্দেশ্যে গঠিত।
হলোকাস্ট স্মৃতিসংগ্রহ কেন্দ্র ইয়াদ ভাশেম এক সাংবাদিককে অভিযুক্ত করেছে হলোকাস্টের "অর্থকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন" করার জন্য।
গত দুই বছরে একের পর এক হামলার ফলে পশ্চিম তীরের একাধিক গ্রামের মানুষ নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
ওলমার্ট বলেন, এই হামলাগুলো যুদ্ধাপরাধ। তিনি বলেন, "এটা ক্ষমার অযোগ্য, কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটা ছিল পরিকল্পিত, সংগঠিত এবং বর্বর হামলা—যা চালিয়েছে একটি বড় গ্রুপ।"
এই হামলাকারীদের ইসরায়েলে অনেক সময় "হিলটপ ইয়ুথ" বলা হয়। অনেকে তাদের চরমপন্থি বলে থাকেন। তবে ওলমার্ট বলেন, "ওদের বলা উচিত 'হিলটপ অ্যাট্রোসিটিজ' (পাহাড়চূড়ার নৃশংসতা)। কারণ তারা যে সহিংসতা চালাচ্ছে, তা কোনো বিচার ছাড়াই চলতে পারছে।"
তিনি বলেন, "ওরা এভাবে ধারাবাহিক, বিস্তৃত ও শক্তিশালী হামলা চালাতে পারে কেবল এই কারণে যে, [অধিকৃত ফিলিস্তিনি] এলাকাগুলোতে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ তাদের সহায়তা ও নিরাপত্তা দিচ্ছে।"
ওলমার্ট আরও বলেন, গাজায় চরম মানবিক দুর্দশা আর পশ্চিম তীরে বসতিগুলোর নৃশংসতা—এই দুটি বিষয়ই এখন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক ক্ষোভ বাড়িয়ে তুলছে, যেটা কেবল "ইহুদিবিদ্বেষ" বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
তিনি বলেন, "যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ঘৃণার প্রকাশ দিন দিন বেড়েই চলেছে। আমরা নিজেদের সান্ত্বনা দিই এটা বলে যে 'ওরা ইহুদিবিদ্বেষী'। কিন্তু আমি মনে করি, তারা কেবল ইহুদিবিদ্বেষী নয়—অনেকেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে, কারণ তারা যা দেখছে টেলিভিশনে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।"
তিনি আরও বলেন, "এটা কষ্টকর, তবে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া—মানুষ বলছে, 'তোমরা সব সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছ।'"
ওলমার্ট মনে করেন, ইসরায়েলি জনগণের মনোভাব বদলাবে তখনই, যখন তারা আন্তর্জাতিক চাপকে নিজেদের ওপর অনুভব করবে। তিনি বলেন, দেশে যখন কার্যকর রাজনৈতিক বিরোধিতা নেই, তখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও সক্রিয় হওয়া উচিত।
তিনি ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমগুলোরও সমালোচনা করেন কারণ তারা ফিলিস্তিনিদের ওপর সহিংসতা নিয়ে সঠিক প্রতিবেদন দিচ্ছে না।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর সশস্ত্র সংগঠনটির বিরুদ্ধে প্রাথমিক অভিযানে সমর্থন দিয়েছিলেন এহুদ ওলমার্ট। কিন্তু চলতি বছরের বসন্তে, যখন ইসরায়েল সরকার "সবার সামনে এবং নির্মমভাবে" যুদ্ধ স্থায়ীভাবে বন্ধ করার আলোচনা বাতিল করে দেয়, তখন তিনি বুঝতে পারেন, তার দেশ যুদ্ধাপরাধ করছে।
তিনি বলেন, আত্মরক্ষার যুদ্ধে নামলেও তা এখন আর সেই জায়গায় নেই—এতে তিনি "লজ্জিত ও মর্মাহত"। তাই তিনি মুখ খুলেছেন।
ওলমার্ট বলেন, "আমি কীভাবে এই অবস্থার পরিবর্তন আনব? প্রথমত, এই অন্যায়গুলো স্বীকার না করে উপায় নেই, দ্বিতীয়ত, এগুলোর সমালোচনা করতেই হবে। আর আন্তর্জাতিক অঙ্গনকে জানাতে হবে যে, ইসরায়েলে আরও অনেক ভিন্নমত আছে।"
তিনি বলেন, এটি কোনও পরিকল্পিত বর্বরতা নয়, বরং দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এবং মৃত্যুর ভয়াবহ মাত্রাকে সহ্য করার মানসিকতা থেকেই যুদ্ধাপরাধ ঘটছে। "অভিযানের সময় কি সেনা কর্মকর্তারা এ ধরনের নির্দেশ দিয়েছেন? কখনো না," বলেন ওলমার্ট।
তবে তিনি মনে করেন, সেনাবাহিনী অনেক সময় ইচ্ছে করেই চেয়ে না দেখার ভান করেছে, যদিও তারা জানত এতে বহু নিরপরাধ মানুষ মারা পড়বে। তাই তিনি বলেন, "এই সরকারকে যুদ্ধাপরাধের দায় থেকে বাদ দেওয়া যায় না।"
গাজায় ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ সত্ত্বেও, ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে শান্তিচুক্তির চেষ্টা করা শেষ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ওলমার্ট এখনো বিশ্বাস করেন, দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান সম্ভব।
এই লক্ষ্যে তিনি সাবেক ফিলিস্তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী নাসের আল-কিদওয়ার সঙ্গে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করছেন। এমনকি তিনি মনে করেন, গাজায় যুদ্ধ শেষ করার বিনিময়ে সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার মাধ্যমে এক ঐতিহাসিক সমাধান পাওয়া সম্ভব—যদি নেতানিয়াহু সেটা চান বা সাহস করেন।
কিন্তু তার বদলে ওলমার্ট হতবাক হয়ে দেখেছেন, যিনি নিজেই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের যুদ্ধাপরাধের পরোয়ানার মুখোমুখি, সেই নেতানিয়াহু ডোনাল্ড ট্রাম্পকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দিচ্ছেন।