ইয়েলোস্টোন নয়, বিশ্বের প্রথম জাতীয় উদ্যান মঙ্গোলিয়ার এই পাহাড়ী অঞ্চল

আমেরিকার স্কুলপড়ুয়া শিশুদের অনেকেই ছোটবেলা থেকেই শিখে যে, ইয়েলোস্টোন বিশ্বের প্রথম জাতীয় উদ্যান। অথচ বিশ্বের আরেক প্রান্তে, মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলানবাতরের ঠিক পাশেই এক পাহাড়ও একই মর্যাদার দাবিদার।
মঙ্গোলিয়ার প্রায় সব কিছুর সঙ্গেই কোনো না কোনোভাবে যুক্ত আছেন চেঙ্গিস খান—মঙ্গোল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা, যার নাম ও প্রতিকৃতি আজকের মঙ্গোলিয়ায় সর্বত্র। তার পিতার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও মিত্র তোঘরুলখান (বা ওং খান নামে পরিচিত) বোগদ খান উল পাহাড়ের রক্ষার দায়িত্বে ছিলেন। মঙ্গোলিয়ার সবচেয়ে প্রাচীন বই 'দ্য সিক্রেট হিস্ট্রি অব দ্য মঙ্গোলস'-এ উল্লেখ রয়েছে, ১৩শ শতকের গোড়াতেই তোঘরুল এই পাহাড়ে শিকার, কাঠ কাটা ও অন্যান্য ক্ষতিকর কাজ নিষিদ্ধ করেন।
১৯৯৬ সালে ইউনেস্কো বোগদ খান উলকে জীবমণ্ডল সংরক্ষণ এলাকা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। পার্কে প্রবেশ করলেই বদলে যায় দৃশ্যপট—উলানবাতারের কোলাহল, ধুলাবালি, ধোঁয়া যেন দূর অতীত। পাইন, বার্চ ও অ্যাসপেন গাছে ঘেরা বনে তরেলজ নদী এঁকে বেঁকে বয়ে চলে। প্রজাপতির ঝাঁক আকাশে ঘোরে, দূরে দেখা মেলে ঈগল কিংবা শকুনের।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই অঞ্চলের পবিত্র মর্যাদা বজায় থাকায়, এখানে গড়ে উঠেছে এক অনন্য জীববৈচিত্র্য। শিকার ও চাষাবাদের নিষেধাজ্ঞার ফলে আজও টিকে আছে নানা বিরল প্রজাতি—যেমন গজদন্তবিশিষ্ট মাস্ক হরিণ কিংবা বরফালি আর্কটিক খরগোশ। ভাগ্য ভালো হলে চোখে পড়তে পারে ঈগল, শকুন, মারমোট বা বন্য শুকরও।
বোগদ খান উল: মঙ্গোলদের পবিত্র পর্বত
মঙ্গোলদের কাছে বোগদ খান উল শুধুই একটি পাহাড় নয়—এটি এক প্রতীক, এক পবিত্র স্থান। উলানবাতারে জন্ম নেওয়া, বর্তমানে ওয়াশিংটনের কংগ্রেস গ্রন্থাগারে কর্মরত মঙ্গোলিয়া-বিষয়ক গবেষক সারুল-এর্ডেন মিয়াগমার বলেন, 'বোগদ খান উল সব মঙ্গোলদের জন্যই এক পবিত্র প্রতীক।'
'বোগদ' শব্দটি মঙ্গোল ভাষায় 'সাধু', 'উল' মানে 'পাহাড়', আর 'খান' হলো এক রাজকীয় উপাধি। অনেকেই একে অনুবাদ করেন 'সাধুর পাহাড়' বা 'খানের সাধুর পাহাড়' হিসেবে।
তবে এই পাহাড়টি কি সত্যিই ইয়েলোস্টোনেরও আগে থেকে সংরক্ষিত?
১৭৭৮ সালে, মঙ্গোল অভিজাতরা তৎকালীন মানচু সাম্রাজ্যের সম্রাটকে চিঠি লিখে অনুরোধ করেন—বোগদ খান উলকে আনুষ্ঠানিকভাবে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা দিতে। সম্রাট সেই অনুরোধে সাড়া দেন।
তুলনায়, ইয়েলোস্টোন পার্ক, যা ওয়াইয়োমিং, আইডাহো ও মন্টানা—এই তিনটি রাজ্যে বিস্তৃত, গঠিত হয় অনেক পরে, ১৮৭২ সালে। অস্ট্রেলিয়ার প্রথম জাতীয় উদ্যান আসে ১৮৭৯ সালে, কানাডার ১৮৮৫ সালে, ফ্রান্সের ১৯৬৩ সালে, আর মিসরের ১৯৮৩ সালে।
তবে প্রতিযোগিতার তালিকায় আরেকটি নাম উঠে আসে—ক্যারিবীয় অঞ্চলের টোবাগো মেইন রিজ ফরেস্ট রিজার্ভ, যার সূচনা ১৭৭৬ সালে। এটিও অনেকটা পুরনো এবং সংরক্ষণের দাবিদার।

তবুও মঙ্গোলদের অনেকেই ১৭৭৮ সালের তারিখকে তেমন গুরুত্ব দেন না। তাদের মতে, পাহাড়টির 'সংরক্ষিত অবস্থান' শুরু হয়েছিল বহু আগেই—১৩শ শতাব্দীতে—যখন তোঘরুল খান পাহাড়টিকে পবিত্র ঘোষণা করে শিকার, কাঠ কাটা ও অন্য কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করেন। এই যুক্তিতে, বোগদ খান উল পার্কের বয়স প্রতিযোগীদের চেয়ে কয়েকশ বছর এগিয়ে।
অজানা, অথচ অতুলনীয় এক গন্তব্য
ইয়েলোস্টোন বা অন্যান্য বিখ্যাত উদ্যানের তুলনায় বোগদ খান উল আজও বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষের কাছেই অজানা। এর বড় একটি কারণ হলো মঙ্গোলিয়ার ভৌগোলিক অবস্থান—চীন ও রাশিয়ার মাঝে অবস্থিত শীতল, স্থলবেষ্টিত দেশটিতে বিদেশি পর্যটকের আনাগোনা বরাবরই সীমিত ছিল। এমনকি পার্কটির ইতিহাস ও তথ্য বেশিরভাগই কেবল মঙ্গোল ভাষায় পাওয়া যায়।
তবে পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। পর্যটনকে ঘিরে মঙ্গোলিয়া বড় পরিকল্পনা নিচ্ছে—২০৩০ সালের মধ্যে অর্থনীতিতে এর অবদান ১০ শতাংশে নিয়ে যেতে চায় দেশটি। ইতিমধ্যে ২০২৪ সালে ৮ লাখ ৮ হাজার বিদেশি পর্যটক দেশটি সফর করেছেন, যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ।
তবে মঙ্গোলদের কাছে এই পার্কের গুরুত্ব শুধু প্রাচীনত্বের দাবিতে আটকে নেই।
মিয়াগমার বলেন, 'বৌদ্ধধর্ম আসার অনেক আগে থেকেই এখানে শামানিক বিশ্বাস ছিল। সে প্রাচীন বিশ্বাসে বলা হয়, প্রতিটি পাহাড়, নদীর একেকজন আত্মা বা রক্ষক থাকে—এক ধরনের প্রেতাত্মা যেন। বোগদ উলের রক্ষক এক শুভ্রকেশী বৃদ্ধ। তাঁকে অসম্মান করলে নানা দুর্ভাগ্য নেমে আসে।'
আজও পার্কে সেই আধ্যাত্মিকতার ছাপ স্পষ্ট। চারদিকে ছড়িয়ে আছে 'ওভো'—পাথর, কাঠ আর রঙিন কাপড়ে গড়া পবিত্র স্তূপ। এসব স্তূপে হস্তক্ষেপ করা, যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলা বা অনুমোদিত জায়গার বাইরে প্রাকৃতিক কাজ সাড়া শুধু অসৌজন্য নয়, অনেকের বিশ্বাসে তা সরাসরি দুর্ভাগ্যের কারণ।
হাইকিং ও গের ক্যাম্প
উলানবাতারের শহরকেন্দ্রে অবস্থানরত অনেক পর্যটক বোগদ খান উল ঘুরতে যাওয়ার আগে একটি স্টপ নেন জাইসান হিলে। এই পাহাড়চূড়ায় রয়েছে এক স্মৃতিস্তম্ভ—সোভিয়েত ও মঙ্গোল সেনাদের প্রতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অবদানের জন্য নির্মিত। কঠিন ও মোটা কংক্রিটের গায়ে আঁকা বর্ণিল দেয়ালচিত্র যেন ইতিহাসকে ছুঁয়ে দেয় চোখের সামনে।
জাইসানের চূড়া থেকে শহরের বেশ ভালো একটি অংশ দেখা যায়, তবে সেটি নির্ভর করে দিনের আকাশ কতটা পরিষ্কার তার ওপর—কারণ 'ইউবি' নামে পরিচিত উলানবাতারে ধোঁয়াটে পরিবেশ নতুন কিছু নয়।
এই স্মৃতিস্তম্ভ থেকে পার্কের উত্তর প্রবেশপথ একদম কাছে। এখানে রয়েছে বিভিন্ন মাত্রার হাঁটার ট্রেইল—কেউ চাইলে হালকা ট্রেইলে হাঁটতে পারেন, আবার চাইলে চ্যালেঞ্জ নিতে পারেন কঠিন রুটে। সবগুলো পথই বেশ পরিষ্কারভাবে চিহ্নিত।
যারা পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছে যান, তাদের অবশ্যই দেখে আসা উচিত মানজুশির মঠের ধ্বংসাবশেষ। এক সময় এটি ছিল বৌদ্ধ ধর্মের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র, যেখানে বহু সন্ন্যাসী বাস করতেন। ১৯৩৭ সালে সোভিয়েত-সমর্থিত স্থানীয় কমিউনিস্টদের হাতে মঠটি ধ্বংস হয়। তবে এখনও সেখানে যে অবশিষ্ট পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে, স্থানীয়রাই তা যত্নে রক্ষা করে চলেছেন—বিশেষ করে এখন, যখন মঙ্গোল সরকার জাতীয় সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়কে উৎসাহিত করছে।
বেশিরভাগ বিদেশি পর্যটক দিনের মধ্যে ঘুরে ফিরে আসেন। তবে কেউ কেউ থেকে যান পাহাড়ের গের ক্যাম্পে—মঙ্গোলদের ঐতিহ্যবাহী গোলাকার তাঁবুতে। এই ক্যাম্পগুলো খুবই সাধারণ; আধুনিক সুযোগ-সুবিধা না থাকলেও, নির্জনতা আর তারাভরা আকাশের নিচে এমন এক রাত কাটানো যায় যা শহরের কোনো হোটেল দিতে পারে না।
কীভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন
উলানবাতারের কেন্দ্র থেকে বোগদ খান উল মাত্র ১০ মাইল দূরে, তবে যানজটে সময় লাগতে পারে এক ঘণ্টা। সকালে ভিড় কম থাকলে যাওয়াটা সহজ হয়। শহরে মেট্রো নেই, তাই বাস বা প্রাইভেট কারই ভরসা। ট্যাক্সি ধরতে হলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাত তুললেই হয়—স্থানীয়রাই এমনভাবে যানবাহন ভাগ করে নেয়।
ট্যুরিস্টদের জন্য আছে ইউবিক্যাপ অ্যাপ, যেখানে ইংরেজি ভাষা আছে, তবে নগদ টাকা ছাড়া চলবে না যদি স্থানীয় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকে।
যারা বিদেশ থেকে আসতে চান, তাদের জন্য রাজধানীর চেঙ্গিস খান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরই একমাত্র গেটওয়ে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে সিজনাল ফ্লাইট চালায় ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স, তবে টোকিওতে ট্রানজিট করতে হয়।
বোগদ খান উল শুধু একটিমাত্র উদাহরণ। গোটা মঙ্গোলিয়া জুড়ে আছে এরকম ২৯টি জাতীয় উদ্যান—গবি মরুভূমির বিস্তার, ইউনেস্কোর স্বীকৃত ওরখন উপত্যকা, বরফঢাকা আলতাই পর্বত আর সীমান্তবর্তী প্রাচীন লেক খুভসগুল—সবই যেন একেকটি দুর্লভ রত্ন।
তবে তাদের মাঝে বোগদ খান উল আলাদা। কারণ, এটা শুধু একটি পার্ক নয়—এটা ইতিহাস, আধ্যাত্মিকতা আর জাতিগত পরিচয়ের এক জীবন্ত প্রতীক।