ইসরায়েলবিরোধী সমালোচনার জেরে জাতিসংঘ প্রতিনিধির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা

জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের বিশেষ প্রতিবেদক (স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার) ফ্রান্সেসকা আলবানিজের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের একজন স্পষ্টভাষী সমালোচক হিসেবে তিনি পরিচিত। খবর বিবিসি'র।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও জানান, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রতি আলবানিজের সমর্থনের কারণেই এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আইসিসির কয়েকজন বিচারপতির ওপর আগেই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
রুবিও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলি নাগরিকদের বিরুদ্ধে আইসিসির মামলায় সরাসরি যুক্ত থাকার জন্য আলবানিজের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও অভিযোগ করেন, আলবানিজ জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য উপযুক্ত নন।
এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ফ্রান্সেসকা আলবানিজের যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ নিষিদ্ধ হতে পারে এবং সেখানে তার যদি কোনো সম্পদ থেকে থাকে, তাহলে তা জব্দ হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ (পূর্বতন টুইটার) দেওয়া এক পোস্টে ফ্রান্সেসকা আলবানিজ নিষেধাজ্ঞা নিয়ে সরাসরি কিছু বলেননি। তবে তিনি লিখেছেন, 'আজকের এই দিনে, আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি দৃঢ়ভাবে ও বিশ্বাস নিয়ে আমি ন্যায়বিচারের পক্ষে আছি—যেমনটি আমি সবসময়ই ছিলাম।'
ইতালিতে জন্ম নেওয়া জাতিসংঘের বিশেষ এই প্রতিবেদক বার্তাটিতে আইসিসির প্রতি সমর্থন জানিয়ে একটি থ্রেড পুনরায় শেয়ার করেন। সেখানে তিনি লেখেন, তিনি এমন একটি দেশ থেকে এসেছেন—যেটি আইসিসির প্রতিষ্ঠাকালীন রাষ্ট্র। সেই দেশের আইনজীবী ও বিচারকরা 'বিপুল ত্যাগ স্বীকার করে, কখনও কখনও জীবনের ঝুঁকি নিয়েও ন্যায়বিচার রক্ষা করেছেন।'
তিনি লেখেন, 'আমি সেই ঐতিহ্যকে সম্মান জানাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।'
বিবিসিকে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি আলবানিজ, তবে আল জাজিরাকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের এই নিষেধাজ্ঞাকে 'মাফিয়া স্টাইলের ভয়ভীতি প্রদর্শনের কৌশল' হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) বিরুদ্ধে ট্রাম্প প্রশাসনের চলমান অভিযানের অংশ হিসেবে এটি সর্বশেষ পদক্ষেপ। এর আগে আদালতের চারজন বিচারপতির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
গত বছর গাজায় কথিত যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আইসিসি। যদিও সেসব অভিযোগ নেতানিয়াহু ও গ্যালান্ট উভয়েই অস্বীকার করেছেন।
অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ফিলিস্তিনিদের অধিকার রক্ষায় পশ্চিমা দেশগুলো যথাযথ ভূমিকা রাখছে না—এমন অভিযোগ বহুদিন ধরেই করে আসছেন জাতিসংঘের এই বিশেষ প্রতিবেদক।
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের নীতির সমালোচনা ঠেকাতে ইহুদিবিদ্বেষের অভিযোগকে 'অস্ত্র' হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ যারা তুলেছেন, তাদের মধ্যে আলবানিজের স্পষ্ট অবস্থান ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে।
আলবানিজের সমালোচকরা অতীতে তার ব্যবহৃত কিছু ভাষা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এরমধ্যে তার ২০১৪ সালের একটি মন্তব্যও রয়েছে। তিনি বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন বিষয়ক সিদ্ধান্তে 'ইহুদি লবির' প্রভাব রয়েছে।
পরে অবশ্য তিনি ওই মন্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন; তবে মন্তব্যটি ইহুদিবিদ্বেষমূলক ছিল—এমন অভিযোগ তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন।
এদিকে রুবিও অভিযোগ করেন, আলবানিজ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছেন, কারণ তিনি কয়েকটি মার্কিন কোম্পানিকে 'হুমকিমূলক চিঠি' পাঠিয়েছেন, ভিত্তিহীন অভিযোগ এনেছেন এবং কোম্পানি ও তাদের নির্বাহীদের বিরুদ্ধে মামলা চালাতে আইসিসিকে সুপারিশ করেছেন।
রুবিওর ভাষায়, "আমরা এ ধরনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যুদ্ধের প্রচারণা বরদাশ্ত করব না, যা আমাদের জাতীয় স্বার্থ ও সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ফেলে।"
চলতি মাসের শুরুতে আলবানিজ কয়েক ডজন বহুজাতিক কোম্পানিকে ইসরায়েলের সঙ্গে ব্যবসা বন্ধ করার আহ্বান জানান। তিনি সতর্ক করে বলেন, এসব কোম্পানি গাজা ও দখলকৃত পশ্চিম তীরে যুদ্ধাপরাধে অংশীদার হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
তার ভাষায়, এসব প্রতিষ্ঠান "দখলদারিত্ব, বর্ণবৈষম্য এবং এখন গণহত্যার ওপর গড়ে ওঠা ইসরায়েলি অর্থনীতি থেকে মুনাফা করছে।"
তবে আলবানিজের এই প্রতিবেদনকে 'ভিত্তিহীন' আখ্যা দিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করে ইসরায়েল। দেশটি বলেছে, আলবানিজের প্রতিবেদনটি এক সময় 'ইতিহাসের আবর্জনার ঝুড়িতে চলে যাবে।'
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে গাজা উপত্যকা দখল এবং সেখানকার বাসিন্দাদের অন্যত্র সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা ঘোষণা করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেই পরিকল্পনার তীব্র সমালোচনা করেন আলবানিজ।
তিনি বলেন, "এটি অবৈধ, অনৈতিক এবং... সম্পূর্ণভাবে দায়িত্বজ্ঞানহীন, কারণ এতে আঞ্চলিক সংকট আরও বাড়বে।"
এদিকে, আলবানিজের ওপর এমন সময়ে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা এলো, যখন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ওয়াশিংটনে অবস্থান করছেন। স্থানীয় সময় বুধবার তিনি পেন্টাগনে একটি বর্ধিত সম্মাননা গার্ড অব অনার গ্রহণ করেন।